বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

সিন্ডিকেটের চাপে সরতে হচ্ছে জনতা ব্যাংক চেয়ারম্যানকে

আপডেট : ২৮ জুলাই ২০২০, ০০:৫৮

ব্যাংকিং খাতের আরেকটি আলোচিত ঘটনা ঘটে সোমবার। একটি ভিডিও, একজন চেয়ারম্যান এবং একটি প্রভাবশালী শিল্পগ্রুপ নিয়ে গতকালের ব্যাংকপাড়া ছিল সরব। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলেছে, প্রভাবশালী একটি ব্যবসায়ী গ্রুপের ‘আবদার’ রক্ষা না করায় সরে যেতে হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জামাল উদ্দিন আহমেদকে। ঐ শিল্পগ্রুপের সঙ্গে আরো কিছু প্রভাবশালী মিলে ‘ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট’ তাকে সরিয়ে দিতে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে বলে তথ্য দিয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র। সিন্ডিকেটের দাপটে টিকতে পারেননি তিনি। সরিয়ে দেওয়ার পেছনে অপবাদও ছিল। তা একটি ভিডিও, যদিও ভিডিওর ব্যাপারে আপত্তি জানিয়ে তা সংশ্লিষ্টদের কাছে বানোয়াট বলে জানিয়েছেন তিনি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং বিভাগের ঊর্ধ্বতন এই সূত্রমতে, আপস না করায় তাকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

সাম্প্রতিককালে ব্যাংকিং খাতে জনতা ব্যাংক ছিল অন্যতম আলোচিত ব্যাংক। ঋণ প্রদানে অনিয়ম তথা ঋণ কেলেঙ্কারির জন্য ব্যাংকটির নাম ছিল সবার মুখে মুখে। বিসমিল্লাহ, এ্যাননটেক্সসহ বেশ কয়েকটি গ্রুপের ঋণ জালিয়াতির ঘটনা ঘটে জনতা ব্যাংকে। নিয়মবহির্ভূতভাবে ঋণপ্রদানসহ নানা অনিয়মে এক সময়কার ‘তুলনামূলক ভালো’ ব্যাংকের সুখ্যাতির তালিকা থেকে ঝরে পড়ে ব্যাংকটি। ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট ঋণগ্রহীতার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনেও মামলা চলছে। তার পরও ব্যাংকের ‘চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সে’র বালাই ছিল না বলেই সূত্রগুলো জানিয়েছে।

সূত্রমতে, জনতা ব্যাংকে ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনার পর এর পরিচালনা পর্ষদ চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ নিয়েও এর আগে নানা ‘নাটক’ হয়। ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে সাবেক অর্থসচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুনকে নিয়োগ দিয়েও পরবর্তীকালে তা বাতিল করা হয়। চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হয় লুনা শামসুদ্দোহাকে। তার মেয়াদ শেষ না হতেই নিয়োগ দেওয়া হয় বাংলাদেশে অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. জামাল উদ্দিন আহমদকে। তিনি সরকারের বিশ্বস্ত এবং তিনি আওয়ামী লীগের হয়ে একবার সংসদ সদস্য পদে প্রার্থীও হয়েছিলেন নিজ এলাকা নোয়াখালীর সেনবাগে। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক পদেও রয়েছেন। ২০ আগস্ট ২০১৯ তারিখে তাকে জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেওয়া হয়।

সূত্রমতে, নিয়োগ পাওয়ার পর তিনি ব্যাংকটির অনিয়ম দূরীকরণসহ ঢেলে সাজানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের অসহযোগিতা ছিল বরাবরই। সর্বশেষ, একটি প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গ্রুপের রোষানলে পড়ে যান তিনি। ঐ গ্রুপের অনুকূলে ঋণসুবিধা দিতে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের প্রস্তাবে সম্মতি না দেওয়াই তার কাল হয়েছে বলে জানান ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ একটি সূত্র। এই সূত্র মতে, প্রায় ৫০০ কোটি টাকার ঋণপ্রস্তাবে রাজি হননি চেয়ারম্যান। তার পরও এই ঋণ দেওয়ার জন্য চাপ ছিল তার ওপর। তিনি সেটা শোনেননি। ঐ শিল্পগ্রুপকে অর্থায়ন করে এমন আরেকটি রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে একটি অভিযোগ তৈরি করা হয় ড. জামাল উদ্দিনের বিরুদ্ধে। নেপথ্যে থাকে ঐ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। অভিযোগটি সম্পর্কে সূত্রটি বলেছে, ৫ লাখ টাকার আর্থিক লেনদেনের একটি ভিডিও চিত্র নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে পাঠানো হয়। তার ওপর ঐ প্রভাবশালী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটটির চাপে তিনি নাকাল হয়ে যান। তিনি ঐ ভিডিও চিত্র অস্বীকার করেছেন এবং সংশ্লিষ্ট মহলে দুঃখ করে বলেছেন এমনটি হতেই পারে না। এটি বানোয়াট, এডিটেড। তবু শেষ রক্ষা হয়নি।

বিষয়টি নিয়ে গতরাতে ড. জামাল উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। অর্থমন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র বলেছে বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। আজ মঙ্গলবার প্রজ্ঞাপন জারি হতে পারে।

প্র্রসঙ্গত, ড. জামালউদ্দিন জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে তিন বছরের জন্য নিয়োগ পান। এর আগে চেয়ারম্যান ছিলেন দোহাটেক নিউ মিডিয়া নামের প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান লুনা শামসুদ্দোহা। ২০১৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি তিনি ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। তার আগে ২০১৬ সালের ৬ জুন থেকে জনতা ব্যাংকের পরিচালক ছিলেন তিনি।

জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান নিয়োগ বা অপসারণ নিয়ে নাটকীয়তা নতুন নয়। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে সাধারণত তিন বছরের জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু কাকতালীয়ভাবে বিগত কয়েকজন চেয়ারম্যান তাদের মেয়াদ শেষ করতে পারছেন না। তার আগেই বিদায় নিতে হচ্ছে। লুনা শামসুদ্দোহা যখন নিয়োগ পান, সে সময়ে ব্যাংকিং খাত ব্যাপক নাটকীয়তা দেখেছে। একক ঋণের বৃহত্ কেলেঙ্কারি নিয়ে আলোচনায় থাকা রাষ্ট্রমালিকানাধীন জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান নিয়োগ নিয়ে শেষ পর্যন্ত নাটক হয়েছিল। তিন দিনের মধ্যে পালটে গিয়েছিল সিদ্ধান্ত।

সাবেক অর্থসচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুনকে চেয়ারম্যান করতে ব্যাংকটির পর্ষদকে ২০১৮ সালেরর ২৫ ফেব্রুয়ারি চিঠি দিয়েছিল অর্থ মন্ত্রণালয়। চিঠিতে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো আপত্তি না থাকলে পর্ষদ হেদায়েতুল্লাহ আল মামুনকে চেয়ারম্যান নিয়োগ দিতে পারে। তবে জনতা ব্যাংক ঐ চিঠি আমলে নেয়নি। তাকে চেয়ারম্যান করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে কোনো আবেদনও করেনি।

ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো জানায়, হেদায়েতুল্লাহ আল মামুনকে চেয়ারম্যান করার উদ্যোগের কারণে ব্যাংকটির শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী গ্রাহকদের কয়েক জন ও শীর্ষ পর্যায়ের কয়েক জন কর্মকর্তা বেশ অস্বস্তিতে পড়েন। এরপরই তার নিয়োগ বাতিল হয়।

ইত্তেফাক/এসআই