বাংলাদেশে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছর শেষে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে আসার পূর্বাভাস দিল বিশ্বব্যাংক। সরকারি প্রত্যাশা ৮ দশমিক ২ শতাংশের চেয়ে কম হলেও এ প্রবৃদ্ধিকে ইতিবাচক দেখছে সংস্থাটি।
বিশ্বব্যাংকের হিসাবে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধি হবে সর্বোচ্চ। সংস্থাটির পূর্বাভাস অনুযায়ী চলতি অর্থবছরের শেষ নাগাদ দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের পর নেপাল (০.৬) এবং পাকিস্তানের (০.৫) ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি অর্জিত হতে পারে। অন্যদিকে ভারতের জিডিপি ৯ দশমিক ৬ শতাংশ এবং ভুটানের শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ সংকোচনের পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। গতকাল প্রকাশিত ‘গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্ট ২০২১’ শিরোনামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এমন পূর্বাভাস দেওয়া হয়। তবে আগামী বছর দক্ষিণ এশিয়ার প্রবৃদ্ধির উন্নতির প্রত্যাশা করা হয়েছে। আর ২০২২ সালে ভারতের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্ভাভাস দেওয়া হয়েছে।
গত বছর ২০২০ সালে বিশ্ব অর্থনীতি ৪ দশমিক ৩ শতাংশ সংকুচিত হবার পর চলতি বছর নিয়ে আশাবাদী বিশ্বব্যাংক। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনার ভ্যাক্সিন প্রয়োগ শুরু এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে গতিশীলতা বৃদ্ধি পাওয়ায় এ বছর শেষ নাগাদ বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে।
বাংলাদেশ বিষয়ে বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্য অতিমাত্রায় তৈরি পোশাক শিল্পনির্ভর। তবে আশার আলো জুগিয়েছে রেমিট্যান্স। দেশের তৈরি পোশাক শিল্পের প্রধান গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ। রেমিট্যান্সের প্রধান উত্স মধ্যপ্রাচ্য। তবে বিশ্ববাজারে তেলের দাম পতন হলে বাংলাদেশও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ তেল উত্তোলনকারী দেশগুলোর জোট ওপেক তাদের নীতি পরিবর্তন করলে এর প্রভাব আরব বিশ্বের অর্থনীতিতে পড়বে। উপসাগরীয় দেশগুলোর অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ধীরগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে নতুন করে করোনার প্রকোপ বাড়ায় বাংলাদেশের রপ্তানি গন্তব্যে ঝুঁকি রয়েছে।
আরো পড়ুন : সিরামের নামে ৫০০ কোটি টাকার চেক জমা
করোনার ভ্যাক্সিন প্রয়োগ শুরু এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতিশীলতা আসায় এ বছর সারা বিশ্বে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধির প্রত্যাশা করা হচ্ছে। তবে বিশ্বব্যাংক সতর্ক করে বলেছে, প্রবৃদ্ধির জন্য মহামারি পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে দেশগুলোর নীতিনির্ধাকদের বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। এছাড়া অর্থনৈতিক সংস্কারও করতে হবে। বিশ্ব অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে আরো সময় প্রয়োজন হবে। কারণ ২০২০ সাল জুড়েই করোনা অতিমারির প্রভাবে বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। সেই সঙ্গে লাখ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়ে পড়েছে। মানুষের আয়ের উত্স দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অতিমারি মোকাবিলাই ছিল দেশগুলোর প্রধান অগ্রাধিকার। এখন অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে হবে। পুনরায় বিনিয়োগ করতে হবে। তবে সরকারি ঋণ নির্ভরতা বাড়ানো যাবে না।
প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড ম্যালপাস উল্লেখ করেন, নীতিনির্ধারকরা স্বাস্থ্য, ঋণ ব্যবস্থাপনা ও ব্যাংকিং খাতসহ কাঠামোগত সংস্কার নিয়ে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। ফলে বিশ্ব অর্থনীতির পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় ধীরগতি দেখা যাচ্ছে। করোনার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিনিয়োগ বাড়ানোর পাশাপাশি ব্যাবসায়িক পরিবেশ উন্নত করতে বড় ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে। সেই সঙ্গে শ্রম ও পণ্য বাজারেও নমনীয়তা থাকতে হবে এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বাড়াতে হবে।
প্রতিবেদনে সতর্ক বার্তা দিয়ে বলা হয়, বিশ্বের সাধারণ মানুষের মধ্যে যদি করোনার ভ্যাক্সিন দেরিতে পৌঁছায় সেক্ষেত্রে বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি এ বছর ১ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে আসতে পারে। যদি দ্রুত ভ্যাক্সিন পৌঁছে যায় সেক্ষেত্রে অর্থনীতি চাঙ্গা হবে এবং প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্রে এ বছর প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৩ শতাংশ হবার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। গত বছর দেশটির প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৬ শতাংশ সংকুচিত হয়। ইউরোপ জুড়ে গড় বছর ৭ দশমিক ৪ শতাংশ সংকুচিত হবার পর এ বছর ৩ দশমিক ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলো এ বছর গড়ে ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। এই দেশগুলোতে গত বছর ২ দশমিক ৬ শতাংশ সংকুচিত হয়। গত বছর চীনে ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও এ বছর আশা করা হচ্ছে প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৯ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। তবে এ বছর উদীয়মান দেশগুলোতে ঋণ বৃদ্ধি পাবার বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে প্রতিবেদনে। মহামারি থেকে দীর্ঘমেয়াদি পুনরুদ্ধারের অর্থনৈতিক পরিণতি হিসেবে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে অভ্যন্তরীণ ব্যাংক খাতের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করতে পারে। এর ফলে দেউলিয়াত্ব বাড়ার পাশাপাশি ব্যাংকসহ আর্থিক খাতের ব্যালান্স শিট দুর্বল হতে পারে। এছাড়া চরম আবহাওয়ার প্রভাবও আঞ্চলিক ঝুঁকি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
ইত্তেফাক/ইউবি