শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

কমে গেছে রাজস্ব আয়, দরকারি ব্যয়ে অসংগতি

আপডেট : ০৫ মে ২০২১, ০৭:৩৭

করোনাকালে সরকারের রাজস্ব আয় কমেছে। ফলে ব্যয় করার সংগতিও কমেছে। আদায় কম হওয়ায় সব প্রকল্পে অর্থায়নও সম্ভব হচ্ছে না। চলতি অর্থবছরে আর নতুন কোনো পূর্তকাজ বা স্থাপনা তৈরির কার্যাদেশ না দেওয়ার নির্দেশনা জারি করা হয়েছে।

কয়েকটি প্রকল্প ছাড়া বাকিগুলো চলছে ঢিমেতালে। অর্থসংকটের কারণে অগ্রাধিকার নির্ধারণ করা হলেও সর্বশেষ তথ্যে সামগ্রিক বাজেটের বাস্তবায়ন দেখানো হয়েছে মাত্র ৩৩ শতাংশ। এ অবস্থায় আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রণয়ন প্রক্রিয়া প্রায় শেষের পথে।

করোনাজনিত ‘লকডাউনে’ স্থবির হওয়া অর্থনীতি আগামী দুই-তিন বছরেও ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কি না, তা নিয়ে বেশ সন্দেহ পোষণ করেছেন অর্থনীতিবিদেরা। তবে তারা বলেছেন, এই মুহূর্তে টিকার দিকে নজর দিয়ে মানুষকে রক্ষাই হতে পারে আসছে বাজেটের মূল দিক। পাশাপাশি অর্থসংস্থান করা গেলে চলমান অগ্রাধিকার প্রকল্পগুলোর দিকে নজর দেওয়া যেতে পারে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলেছে, সরকারের রাজস্ব আদায়ে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির কারণে মূলত টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়। গত অর্থবছরে সরকারের রাজস্ব আদায়ের চিত্র ছিল করুণ। লক্ষ্যমাত্রা অর্জন তো দূরের কথা, আগের বছরে যে অর্জন ছিল, তা-ও সম্ভব হয়নি। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত আদায় হয়েছে পৌনে ২ লাখ কোটি টাকার মতো। তা-ও লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অনেক পিছিয়ে। এ অবস্থায় দৈনন্দিন ব্যয় মেটানোর পাশাপাশি উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর অর্থায়ন চালু রাখা দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে।

রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে এই পরিস্থিতির জন্য করোনাকে দায়ী করেছেন অনেকে। এ সময় লকডাউনে বেসরকারি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়েছে। করোনার দ্বিতীয় ধাক্কা সামাল দিতে গিয়েও হিমশিম খাচ্ছে বেসরকারি খাত। লকডাউন দিয়ে সরকারি অফিস কার্যত বন্ধ রাখায় বেসরকারি খাতের চাকাও মন্থর গতি পায়। এমনকি লকডাউনের কারণে সরকারি অফিসের বকেয়া বিলও পায়নি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে বেসরকারি খাতে এই ঈদে বেতন-বোনাস দেওয়াও কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঈদের আগে বেসরকারি ব্যবসা—বাণিজ্য, কলকারখানায় বেতন-বোনাস দেওয়া নিয়ে উত্কণ্ঠায় রয়েছেন মালিকেরা। কেউ কেউ বলেছেন, সর্বত্রই একধরনের ‘মিসম্যাচ’ দেখা দিয়েছে। এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সার্বিক অর্থনীতি।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বেসরকারি খাত চাঙ্গা থাকলে সরকারের রাজস্ব আদায় বাড়ত। পাশাপাশি রাজস্ব খাতে সংস্কারও অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। সংস্কার না করে শুধু উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা নিলেই রাজস্ব আদায় বাড়বে না বলে জানান অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, রাজস্ব খাতে সংস্কার দরকার। তা করা গেলে আদায় বাড়বে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, জিডিপির আকার বাড়লে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি পাওয়ার কথা। অথচ কর-জিডিপির অনুপাত কমে গেছে। ‘জিডিপির ট্র্যাপে’ পড়ে গেছে কর-জিডিপির অনুপাত, যা এখন সাড়ে ৮ শতাংশ। অথচ সরকারের অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুযায়ী এটি ১৪ শতাংশ হওয়ার কথা। যদিও নীতিনির্ধারকদের অনেকে মনে করেন এখানকার লোকজন ঠিকমতো কর দেয় না, যে কারণে কর-জিডিপির অনুপাত কম। বাস্তবে অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, এদেশের সবাই কর দিচ্ছে।

সরকারের কর আদায়ের সহজ মাধ্যম পরোক্ষ কর ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী হওয়ায় ধনী-গরিব সবাই এখন করজালে বন্দি। তাদের মতে, বাজারমূল্যের প্রবৃদ্ধির সঙ্গে রাজস্ব না বাড়লে ধরে নিতে হবে এটি পশ্চাত্মুখী। বাস্তবে তাই হচ্ছে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সামগ্রিক অর্থনীতিতে, যা বর্তমানে উন্নয়নকাজে ধীরগতি, দরকারি ব্যয়ে অসংগতির উল্লেখযোগ্য কারণ।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্রমতে, চলতি বছরের বাজেট ঘোষণার পর থেকেই নানাভাবে কাটছাঁট বা কৃচ্ছ্রসাধনের পথে হেঁটেছে সরকার। উন্নয়ন ব্যয়ও প্রতি বছরের ন্যায় কমিয়েছে। তথাপি আয় কম হওয়ায় নতুন করে চলতি বছরের পূর্তকাজের কার্যাদেশ প্রদান বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি অর্থ বিভাগের এক পরিপত্রে বলা হয়েছে, চলমান কোভিড-১৯ পরিস্থিতি মোকাবিলা এবং সরকারের কৃচ্ছ্রসাধন নীতির আলোকে চলতি অর্থবছরের (২০২০-২০২১) অবশিষ্ট সময়ে পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটের আওতায় নতুন কোনো পূর্তকাজ (নির্মাণ/স্থাপনা)-এর কার্যাদেশ প্রদান করা যাবে না। তবে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও কৃষি মন্ত্রণালয় এই পরিপত্রের বাইরে থাকবে।

সরকারের ব্যয়ের চাপ কমাতে বছরের শুরুতেই বাজেট সংশোধনের আগে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়, কোনোভাবে নতুন করে অতিরিক্ত বরাদ্দ দেওয়া হবে না। আর কোনোক্রমইে উন্নয়ন খাতের অব্যয়িত অর্থ ভিন্ন খাতে স্থানান্তর করা যাবে না। এ ধরনের মোট ২৪ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে। মূলত, অগ্রাধিকার খাতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দের মাধ্যমে সীমিত সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করাই এই মুহূর্তে সরকারের মূল লক্ষ্য। ফলে ব্যয় নিয়ন্ত্রণেই বেশি জোর দেওয়া হয়েছে।

উল্লেখ্য, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আওতায় রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। অর্থবছরের প্রথম আট মাস, অর্থাত্ জুলাই-ফেব্রুয়ারিতে আদায় হয়েছে মাত্র ১ লাখ ৫১ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা।

চলতি অর্থবছরের বাজেটে সরকারের পরিচালনা খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৩ লাখ ১১ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। অন্যদিকে সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আকার ২ লাখ ৯ হাজার ২৭২ কোটি টাকা। জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত এই ৯ মাসে সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির মাত্র ৪১ দশমিক ৯২ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে, যা বিগত বছরগুলোর গড় (৪৫ শতাংশ) বাস্তবায়ন থেকে অনেক কম।

ইত্তেফাক/এএএম