শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

উন্নত রাষ্ট্রের সংজ্ঞাতেই গলদ

আপডেট : ০৮ মে ২০২১, ১০:১৪

১৯৮০-র দশকের একেবারে শেষ দিক পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনীতিবিষয়ক সব পাঠ্যপুস্তকে উল্লেখ করা হতো, আমাদের এ দেশটি দরিদ্র ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্র। স্বল্পোন্নত বা অনুন্নত রাষ্ট্রবিষয়ক কোনো ধারণাই দেওয়া থাকত না। সজ্ঞানে হোক কিংবা অজ্ঞানে, উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রসঙ্গে ‘উন্নয়নশীল’ টার্মটিই মস্তিষ্কে গেঁথে গিয়েছিল। কিন্তু বিভ্রাটটি ঘটাল সাম্প্রতিক কিছু বছর।

হালের একবারে তরতাজা খবর হচ্ছে, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের জন্যে জাতিসংঘের চূড়ান্ত সুপারিশটুকুও অর্জন করে ফেলেছে বাংলাদেশ। সে মোতাবেক, ২০২৪ সালের জাতিসংঘের সাধারণ সভায় আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল দেশের তকমা লাগানো হবে এ দেশের নামের পাশে। সঙ্গত কারণেই মনে প্রশ্ন জাগে, তাহলে ৮০-র দশক পর্যন্ত কোন বিশেষণটি জুড়ে ছিল? উত্তরটা এখন আর উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই। বোধগম্য হয়ে গেছে সবারই। সে যা-ই হোক, এবার ফিরি মূল প্রসঙ্গে। ২০২১ থেকে ২০৪১, এই সময়ের মধ্যে উন্নয়নশীল থেকে উন্নত দেশে রূপান্তরের প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা ও কর্মপন্থা প্রণয়নের কাজও শুরু করে দিয়েছে বাংলাদেশের সরকার। সংশ্লিষ্ট বলেই উল্লেখ করতে হয়, এ দেশ এখন নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশও।

ফের ধূম্রজাল সৃষ্টি না হওয়ার সুবিধার্থে উন্নত রাষ্ট্রের বিষয়ে যথাযথ জ্ঞান থাকাটা অত্যাবশ্যক। প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ হোক, অর্থনৈতিক উন্নয়নের যে কোনো আলোচনায় উন্নত ও উন্নয়নশীল (অথবা অনুন্নত) রাষ্ট্রসমূহের বৈশিষ্ট্যাবলির অনুপ্রবেশ ঘটে। কী কী বিষয় উন্নয়নকে বিকশিত করে এবং কীভাবে সবচেয়ে ভালোভাবে এটি অর্জন করা সম্ভব, এ দুই বিষয় নিয়ে অনেক তত্ত্ব থাকা সত্ত্বেও সব দেশের লক্ষ্য কিন্তু একটাই থাকে, আর সেটি হচ্ছে ঘটনাক্রমে উন্নত দেশে পরিণত হওয়া। এখানেই মূল প্রশ্নটার উদ্রেক হয়—উন্নত রাষ্ট্র আসলে কী? এ বিষয়ে অন্তত তিনটি সাধারণ সংজ্ঞা রয়েছে, যেগুলো নিচে উপস্থাপিত হচ্ছে। এই সংজ্ঞাগুলোও আবার অনেক ক্ষেত্রে কিছু বিষয় এড়িয়ে যায়। অন্যভাবে বললে মতভেদ বিদ্যমান। সাম্প্রতিক সময়ে কোভিড-নাইনটিন প্রাদুর্ভাব থেকে শুরু করে প্রাকৃতিক দুর্যোগে পর্যন্ত কিছু দেশের ব্যর্থতার দায়ে বৃহত্তর একটি সংজ্ঞার যৌক্তিকতা বেশ প্রবলভাবেই ফুটে উঠেছে।

প্রথম সংজ্ঞাটি  কার্যত কোনো সংজ্ঞাই নয়, বরং শ্রেণিবিন্যাস। বিশ্ব ব্যাংকের বিবেচনায়, কোনো দেশের মাথাপিছু মোট জাতীয় আয় (জিএনআই) ১২ হাজার ৫৩৬ মার্কিন ডলার কিংবা তারও বেশি হলে সেটি উচ্চ আয়ের দেশ এবং এরই ফলশ্রুতিতেই উন্নত। বাদবাকি দেশগুলো উন্নয়নশীল বলে বিবেচিত। কারণ, ঐ সীমায় এখনো পৌঁছুতে পারেনি। দেশসমূহ উপরন্তু আরো উপবিভাগে বিভক্ত, যেমন নিম্ন আয় (১,০৩৫ মার্কিন ডলারের নিচে), নিম্ন মধ্যম-আয় (১,০৩৬ থেকে ৪,০৪৫ ডলার) এবং উচ্চ মধ্যম-আয়ের (৪,০৪৬ থেকে ১২,৫৩৫ ডলার) দেশসমূহ। এই দৃষ্টিকোণ থেকে উন্নয়ন বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে সংখ্যাগত, অধিকন্তু চলমানও। একটি দেশ উন্নয়নের সিঁড়িতে চড়ে শুধুমাত্র সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে এবং একটি ধাপ থেকে এর ওপরের ধাপটিতে উঠে।

কেবল আয়ের পরিমাণ ব্যবহার করে উন্নয়নের স্তরের মূল্যায়ন নিঃসন্দেহে বড় একটা ত্রুটি। কিছু দেশের উচ্চ আয় সত্ত্বেও নানাভাবে তারা অনেক গরিব তথা দুর্বল। উদাহরণস্বরূপ ইকুয়েটরিয়াল গিনির প্রসঙ্গ টানা যেতে পারে। মাথাপিছু আয়ের সুবাদে তারা আছে উচ্চ মধ্য-আয়ের তালিকায়। ২০১৯ সালেই তাদের জনপ্রতি জিএনআই ছিল ৬,৪৬০ ডলার। এবার অন্য দিকগুলো দেখা যাক। গড় আয়ু ৫৮.৪ বছর। সেখানকার মানুষ লেখাপড়ার পেছনে ব্যয় করে গড়ে ৯.২ বছর।

জাতিসংঘের অঙ্গ সংগঠন ইউএনডিপি বাস্তবতা উপলব্ধি করেই মানব উন্নয়ন সূচকে শুধুমাত্র আয় নয়, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকেও হিসাবের মধ্যে নিয়ে আসে। ফলস্বরূপ ইকুয়েটরিয়ার গিনির র্যাংক ১৪৪ (মধ্য মানব উন্নয়ন)। অথচ সামোয়া এর চেয়ে ওপরে, ১১১ (উচ্চ মানব উন্নয়ন)। তাদের জনপ্রতি মোট জাতীয় আয় কিন্তু আগে উল্লিখিত দেশটির চেয়ে কম (মাত্র ৫,৮৮৫ ডলার)। সেখানে গড় আয়ু ৭৩.২ বছর আর নাগরিকেরা পড়াশোনার পেছনে সময় খরচ করে গড়পরতা ১২.৫ বছর।

উন্নত রাষ্ট্রের সংজ্ঞার প্রশ্নে আরেকটি পুরোনো দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে, উন্নয়ন আর শিল্পায়ন চলে হাত ধরাধরি করে। শিল্প বিপ্লব দিয়ে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক উন্নয়ন সংঘটিত হয়েছিল পুঁজি ও শ্রমের একটা বিরাট অংশকে কৃষি (যার আছে নিয়মিত কিংবা হ্রাসকৃত প্রতিদান) থেকে ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে (যার আছে বর্ধিষ্ণু মাপের প্রতিদান) স্থানান্তরের মাধ্যমে। এর মূল লক্ষ্যটা উত্পাদনশীলতা ও আয়ের ক্ষেত্রে নাটকীয় উন্নতি সাধন।

এই দর্শনে উন্নত দেশ মানেই শিল্পোন্নত। স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে এই মতাদর্শই বিশ্বকে বিভক্ত করে ফেলেছিল পুুঁজিবাদী পশ্চিম (প্রথম বিশ্ব) ও সমাজতান্ত্রিক পূর্বর (দ্বিতীয় বিশ্ব) নামে। আর শিল্পায়িত না হওয়া (উন্নয়নশীল) দেশগুলো পড়েছিল তৃতীয় বিশ্বের দলে। এখানে উল্লেখ্য যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপ নামমাত্র শিল্প ও অনেক কম আয় নিয়ে শুরু করেও ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে তারা শুধু ধরে ফেলাই নয়, পশ্চিমকে পেছনেও ফেলে দিয়েছিল।

চলবে, দ্বিতীয়াংশ আগামী অর্থনীতির পাতায়

ডেভেলপিং ইকোনমিকস অনুসরণে

ইত্তেফাক/জেডএইচডি