করোনা মহামারি ও অর্থনৈতিক মন্দা চলমান থাকলেও আসিয়ান (অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথইস্ট এশিয়ান ন্যাশনস) অর্থনীতিতে খুব একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে স্টক এক্সচেঞ্জ অব থাইল্যান্ডে (এসইটি) নিবন্ধিত কোম্পানিগুলোর সমন্বিত মুনাফা বৃদ্ধি পেয়েছে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৩৭ শতাংশ বেশি। এটি মূলত সম্ভব হয়েছে জ্বালানি খাতের কোম্পানিগুলোর কারণে।
এসইটি মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশনের ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ হিস্যা হচ্ছে জ্বালানি খাতের। বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের মূল্য লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকার সময়টাতেও দারুণ নৈপুণ্য দেখিয়েছে থাইল্যান্ডের জ্বালানি কোম্পানিগুলো। এখন তারা হয়ে উঠেছে আঞ্চলিক পাওয়ার হাউজ। নবায়নযোগ্য ও স্মার্ট জ্বালানি উত্পাদন থাইল্যান্ডের অর্থনীতিতে কী বিশাল ভূমিকা রেখে চলেছে, তা এখন আর বিশেষভাবে বলার প্রয়োজনই পড়ে না। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সর্বোচ্চ নবায়নযোগ্য জ্বালানি উত্পাদকের স্থানটি বেশি দিন আগে থাইল্যান্ডের হাতছাড়া হয়নি, যে সম্মানে এখন বিশেষ গর্বিত ভিয়েতনাম। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মোট নবায়নযোগ্য জ্বালানির ৩৪ শতাংশই এখন তারা উৎপাদন করছে। ১৭ শতাংশ নিয়ে এর পরের স্থানটিতেই আছে থাইল্যান্ড। সৌরশক্তি উৎপাদনেও একসময় তারা ছিল আঞ্চলিকভাবে দ্বিতীয়।
ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ড, উভয়ই উপভোগ করে পর্যাপ্ত সূর্যকিরণ। এক জার্মান বিনিয়োগকারী হিসেব করে দেখিয়েছেন, তার দেশের একই আকারের সোলার প্ল্যান্টের চেয়ে ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডে দেড় থেকে দুই গুণ বেশি বিদ্যুত্ উত্পাদন খুব সহজেই সম্ভব। অথচ বড় আকারের দেশ হওয়া সত্ত্বেও বৃহৎ পরিসরের সৌর প্রকল্প স্থাপনের জন্য পর্যাপ্ত ভূমির অভাব লক্ষ্য করা যায়। তার পরেও যতটা এগিয়েছে, তাই বা কম কীসে? কিন্তু এ বিষয়ে কারো দ্বিমত নেই, সৌর বিদ্যুেক কাজে লাগিয়ে তাদের অর্থনীতি আরো অনেক এগিয়ে যাওয়ার অফুরন্ত সম্ভাবনা রয়েছে। সৌর বিদ্যুত্ উত্পাদনে লোকজন ভূমি ছাড়তে রাজি না হওয়ায় এ সংকটেরও কয়েকটি উদ্ভাবনী সমাধান রয়েছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে, ভাসমান বিদ্যুত্ প্রকল্পসমূহ। থাইল্যান্ডের বিদ্যুৎ উৎপাদন কর্তৃপক্ষ বর্তমানে নির্মাণ করছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ জল ও সৌর ফার্ম, সেটি উবন রাচাথানির সিরিনধর্ন বাঁধের জলাশয়ে। স্থানীয় অনেক কোম্পানি তাদের সৌর খাত সম্প্রসারিত করছে নিজেদের দেশের পর ভিয়েতনামে বিনিয়োগের মাধ্যমে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উন্নয়ন এবং আসিয়ানভুক্ত প্রত্যেকটি দেশের অর্থনীতি ও জ্বালানি স্বাধীনতায় নবায়নযোগ্য জ্বালানি ক্রমশই গুরুত্বপূর্ণ গল্প হয়ে উঠছে। আসিয়ান একটা লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করেছে যে, ২০২৫ সাল নাগাদ প্রয়োজনীয় মোট জ্বালানির ৩৫ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে উৎপাদিত হবে, যেমন—সৌর, বায়ু, জৈববস্তুপুঞ্জ, জল ও বর্জ্য। এ ক্ষেত্রে থাইল্যান্ড তাদের শীর্ষস্থানটিই শুধু ফেরত পেতে চায় না, নবায়নযোগ্য জ্বালানি উত্পাদনে আঞ্চলিক পরাশক্তি। উদ্বৃত্ত বিক্রি করতে চায় প্রতিবেশি মিয়ানমার ও কম্বোডিয়ার মতো দেশগুলোতে। সেজন্যে পরিকল্পনা রয়েছে ট্রান্সমিশন লাইন দীর্ঘায়িত করার, যাতে করে যখন যেখানে প্রয়োজন, সেখানে সেসময়েই পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়। আসিয়ানভুক্ত গরিব দেশ মিয়ানমারেরও জ্বালানির উেসর অভাব নেই। কিন্তু প্রচুর গ্যাস ও কয়লা থাকলেও বিনিয়োগের অভাবে প্রত্যেক খানায় এসবের সুফল পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। মিয়ানমারের অসংখ্য বাড়িতে এখন পর্যন্ত বিদ্যুৎই নেই।
বিশ্বব্যাপী প্রায় সব কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় মালয়েশিয়ার প্রায় সব প্রতিষ্ঠানেরই উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। কিন্তু গ্রিন এনার্জি এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। জলবায়ুবান্ধব উদ্যোগের অংশ হিসেবে সম্প্রতি প্রকাশিত একটি রিপোর্ট থেকে জানা গেছে গ্রিন এনার্জি বিষয়ে বিশ্বের শীর্ষ কয়েকটি দেশের একটি হচ্ছে মালয়েশিয়া। বিদ্যুত্ উত্পাদনের জন্য একের পর এক বিশাল সৌর প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে দেশটি। প্রয়োজনীয় বিদ্যুতের অর্ধেকই উৎপাদন করার ইচ্ছে রয়েছে সৌর প্যানেল থেকে। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে মালয়েশিয়া ছাড়া আসিয়ানের প্রায় সদস্যেরই গ্রিন এনার্জির প্রশ্নে স্বচ্ছ ধারণা নেই। এর মধ্যে কিছুটা অগ্রগতি অবশ্য হয়েছে। আসিয়ান তার নিজ অঞ্চলে সবুজ বিনিয়োগের জন্য একটা কাঠামো স্থাপন করেছে, যার মূল্য হতে পারে ১২.৩ মালয়েশিয়ান রিংগিত বা ৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার।
আসিয়ান শ্রমশক্তি বোর্ড অবশ্য একটা বড় কাজের ঘোষণা দিয়েছে, টেকসই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিষয়ে এর সদস্য রাষ্ট্রদের পরিচালনা করার উদ্দেশ্যে গ্রিন এনার্জিও নতুন সংজ্ঞা ও শ্রেণিবিন্যাস নির্ধারণ করে দেবে। বলাবাহুল্য, এখানে মূল কারিগরের ভূমিকা পালন করবে মালয়েশিয়া। আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, গ্রিন ইকোনোমি না হলে যে কোনো সময়ই যে অর্থনীতির অবস্থা নাজুক হয়ে পড়তে পারে, সেটি হূদয়ঙ্গম করতে পেরেছে আসিয়ান। সংস্থাটি আসছে ৮ আগস্ট তার ৫৪তম জন্মদিন পালন করবে ঘটা করে।
আসিয়ানের লক্ষ্য তার সদস্যদের মধ্যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক অগ্রগতি ও সাংস্কৃতিক বিবর্তন ত্বরান্বিত করা, আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা সুরক্ষা এবং নিজেদের মতপার্থক্য নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান বের করা। দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় জাতি সংস্থা (অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথইস্ট এশিয়ান ন্যাশনস) সংক্ষেপে আসিয়ান। এর যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৬৭ সালের ৮ আগস্ট। এই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্থার প্রাচীন সদস্য হচ্ছে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড। পরবর্তী সময়ে লাওস, কম্বোডিয়া, ব্রুনাই, মিয়ানমার ও ভিয়েতনাম যুক্ত হওয়ায় এর বর্তমান সদস্য সংখ্যা সর্বমোট ১০। আসিয়ানের মিলিত ভূখণ্ড ৪৪.৬ লাখ বর্গকিলোমিটার, যা এই পৃথিবীর মোট আয়তনের ৩ শতাংশ এবং এর মিলিত জনসংখ্যা প্রায় ৬০ কোটি। একক সত্তা যদি হতো, তাহলে এটি হতো বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম অর্থনীতি।
—ব্যাংকক পোস্ট অনুসরণে
ইত্তেফাক/জেডএইচডি