শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

রপ্তানি বাড়াতে নতুন বাজার তৈরি করতে হবে

আপডেট : ০৯ অক্টোবর ২০২১, ০৫:৪১

কোভিডের অভিঘাত কাটিয়ে বিশ্ব অর্থনীতি এখন চাঙ্গা হচ্ছে। গতি পেয়েছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য। দেশের রপ্তানি খাতেও এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর পরিসংখ্যানেও উঠে এসেছে, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশ থেকে বহির্বিশ্বে পণ্য রপ্তানি হয়েছে সরকারের প্রত্যাশার চেয়েও বেশি। রপ্তানির ঊর্ধ্বগতিতে বরাবরের মতো এবারো বড় ভূমিকা রেখে চলেছে তৈরি পোশাক খাত। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যসহ আরো বেশ কয়েকটি পণ্যের ক্ষেত্রেও রপ্তানির গতি ইতিবাচক। পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি গত প্রান্তিকে কিছুটা কমেছে। তবে সার্বিকভাবে গোটা রপ্তানির চিত্রকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে ইপিবির হালনাগাদকৃত নিয়মিত রপ্তানি প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে ১ হাজার ৪৩ কোটি ৩০ লাখ ডলারের (৮৮ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা) পণ্য রপ্তানির লক্ষ্য নিয়েছিল সরকার। এর বিপরীতে পণ্য রপ্তানি হয়েছে ১ হাজার ১০২ কোটি ১৯ লাখ ৫০ হাজার ডলারের (৯৩ হাজার ৬৮৬ কোটি টাকা)। অর্থাত্, এ সময় বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ থেকে পণ্য রপ্তানি হয়েছে লক্ষ্যের তুলনায় ৫ দশমিক ৬৫ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে গত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে পণ্য রপ্তানি হয়েছিল ৯৮৯ কোটি ৬৮ লাখ ৪০ হাজার ডলারের। সে হিসেবে এবার গত বছরের একই সময়ের তুলনায় রপ্তানি বেড়েছে ১১ দশমিক ৩৭ শতাংশ। বাংলাদেশ থেকে রপ্তানিকৃত শীর্ষ তিন ক্যাটাগরির পণ্য হলো তৈরি পোশাক, পাট ও পাটজাত পণ্য এবং চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য। এর মধ্যে তৈরি পোশাক এবং চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি বাড়লেও কমেছে পাট ও পাটজাত পণ।

গত প্রান্তিকে তৈরি পোশাক পণ্য রপ্তানি হয়েছে ৯০৫ কোটি ৯৪ লাখ ৪০ হাজার ডলারের। ২০২০-২১ অর্থবছরের একই সময় তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৮১২ কোটি ৬৩ লাখ ৮০ হাজার ডলারের। সে অনুযায়ী চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে তৈরি পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ১১ দশমিক ৪৮ শতাংশ। প্রথম প্রান্তিকে এসব পণ্যের রপ্তানি ৮৪২ কোটি ৮৯ লাখ ডলারে নেওয়ার লক্ষ্য ছিল সরকারের। সে হিসেবে গত প্রান্তিকে তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে লক্ষ্যের চেয়ে ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ বেশি। অর্থমূল্য বিবেচনায় গত অর্থবছরের মোট রপ্তানির ৮১ শতাংশই ছিল তৈরি পোশাক। ঐ সময় মোট রপ্তানির পরিসংখ্যানে এসব পণ্য রপ্তানির গতির ছাপ স্পষ্ট ছিল। এবারো অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে মোট রপ্তানির ৮২ শতাংশই ছিল তৈরি পোশাক। 

পোশাকশিল্প-সংশ্লিষ্ট মালিক সংগঠন বিজিএমইএর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, কোভিডের প্রভাব কাটিয়ে পোশাকের চাহিদা বাড়তে শুরু করেছে। কোভিডের প্রভাব কাটিয়ে পুনরুদ্ধারের জন্য খাতটিতে রপ্তানির উচ্চহারের প্রবৃদ্ধি কাঙ্ক্ষিত ছিল। তবে তৈরি পোশাকপণ্যের রপ্তানি অর্থমূল্য বৃদ্ধিতে কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধিরও একধরনের প্রভাব পড়েছে। ২০২০-এর তুলনায় চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ৪১ দশমিক ৬৬ শতাংশ, যা বিশ্বব্যাপী কোভিড পরিস্থিতির উন্নতি ও পোশাকের চাহিদা বৃদ্ধির প্রতিফলন। তবে রপ্তানির অর্থমূল্যে বর্ধিত পরিবহন খরচ ও সুতার মূল্যবৃদ্ধিরও কিছুটা প্রভাব দেখা যাচ্ছে। আশা করা হচ্ছে, আগামী মাসগুলোয় রপ্তানির এ ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত থাকবে।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত প্রান্তিকে আরো বেশ কিছু পণ্যের রপ্তানি ছিল ইতিবাচক ধারায়। এ সময় কৃষিপণ্য রপ্তানি বেড়েছে ২৬ দশমিক ৯ শতাংশ। এছাড়া হিমায়িত ও তাজা মাছ ১৫ দশমিক ৯৬ শতাংশ, প্লাস্টিক পণ্য ১৭ দশমিক ৫, সিরামিক পণ্য ২১ দশমিক ২২, ফার্নিচার ৩৩ দশমিক ২৫ ও ওষুধ ৩২ দশমিক ৯১ শতাংশ হারে রপ্তানি বেড়েছে। করোনা মহামারির মধ্যেও আমদানি ও রপ্তানি দুই-ই বেড়েছে। তবে আমদানি যে হারে বাড়ছে তার চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম হারে বাড়ছে রপ্তানি। রপ্তানির স্বার্থেই আমাদের দেশে আমদানির প্রয়োজনীয়তা বেশি। সাধারণত বাণিজ্য ঘাটতি বাড়লে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চাপে পড়ে। আর চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত হলে বিদেশের সঙ্গে চলতি লেনদেনের জন্য দেশকে কোনো ঋণ করতে হয় না। আর ঘাটতি থাকলে তা পূরণ করতে ঋণ নিতে হয়। তবে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ও বৈদেশিক অনুদান ও ঋণের ওপর ভর করে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। গত বছরের মার্চ মাস থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে করোনা ভাইরাসের প্রভাব পড়তে শুরু করে। এর পর টানা ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটির কবলে পড়ে দেশ। ঐ সময় কলকারখানাও বন্ধ রাখা হয়। এতে রপ্তানিতে বড় ধাক্কা আসার সঙ্গে আমদানিও কমে যায়।

রপ্তানি বাজারে হঠাৎ এভাবে ধস সৃষ্টি কারণ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, পণ্যের বৈশ্বিক চাহিদার পাশাপাশি মূল্যও কমে গিয়েছিল। সে জন্য অন্য দেশের পাশাপাশি বাংলাদেশের রপ্তানি আয়েও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ডলারের বিপরীতে টাকা শক্তিশালী হওয়ায় সেটি আরেকটু বড় হয়েছে। করোনার কারণে বৈদেশিক বাণিজ্য প্রায় বন্ধ ছিল। আমাদের প্রধান রপ্তানি পণ্য গার্মেন্ট খাতে রপ্তানি কমেছিল। গার্মেন্ট পণ্যে মূল বাজার ইউরোপ ও আমেরিকায় করোনার প্রকোপ বেশি ছিল। অন্যদিকে করোনার কারণে আমদানি বাণিজ্য যে স্থবির হয়ে পড়েছিল তাতেও এখন গতি এসেছে। বাংলাদেশের শীর্ষ রপ্তানি বাজারগুলো হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, স্পেন, ফ্রান্স, ইতালি, কানাডা, নেদারল্যান্ডস, জাপান, চীন, বেলজিয়াম, পোল্যান্ড, ডেনমার্ক, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, তুরস্ক, সুইডেন, রাশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত।

রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রবণতা দেখা গেলে দেশের সার্বিক কর্মসংস্থানসহ সেবা খাতেও এর প্রভাব পড়বে। নতুন বাজার অনুসন্ধান ও পণ্য বৈচিত্র্যকরণের যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল, তা বাস্তবায়নে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। একই সঙ্গে বর্তমান রপ্তানি পণ্যের দিকেও নজর দিতে হবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের রপ্তানি প্রবৃদ্ধির ধারা ইতিবাচক রাখতে হবে। সরকার পণ্য ও বাজারভিত্তিক একটি বিশ্লেষণ করে দেখতে পারে, এই মন্দা অবস্থার মধ্যেও রপ্তানি বাজারে কোনো ধরনের পণ্য ভালো চলছে। তাহলে সেই ধরনের পণ্যের ওপর জোর দেওয়া দরকার, এ ছাড়া অন্য দেশগুলো কী জন্য এত ভালো করছে, সেটিও খুঁজে দেখা প্রয়োজন। যদিও তাদের রপ্তানি পণ্যের বৈচিত্র্য বেশি। সেগুলো আমরা করতে পারি কি না, চেষ্টা করে দেখতে হবে। শুধু গার্মেন্টস খাতকে প্রাধান্য না দিয়ে পাশাপাশি অন্য খাতেও নজর দেওয়া প্রয়োজন। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির গতি বাড়াতে আঞ্চলিক বাণিজ্য বিরাট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি নানা চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ছে প্রায় সময়েই। অনেক বাধা-বিপত্তির কারণে মাঝেমধ্যে আমাদের রপ্তানি বাণিজ্য হোঁচট খাচ্ছে। তেমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলোর বাণিজ্যিক লেনদেন বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এর মাধ্যমে উপকৃত হবে বাংলাদেশ। বাণিজ্যের হাত ধরে এই অঞ্চলের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ঘটতে পারে।

রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে হয়তো নানা প্রতিকূলতা আছে, যা অতিক্রম করে সমৃদ্ধির ধারা বজায় রাখাটা নিঃসন্দেহে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। আমাদের প্রত্যাশা সব প্রতিকূলতা, বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকবে। রপ্তানি আয় বাড়াতে নানামুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। নির্দিষ্ট কিছু পণ্যের মধ্যে রপ্তানি বাণিজ্যকে সীমাবদ্ধ না রেখে বিভিন্ন ধরনের পণ্য রপ্তানির উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার কারণে বাংলাদেশি বিভিন্ন ধরনের পণ্যের চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন দেশে। বিশেষ করে খাদ্য ও কৃষিজাত শিল্পপণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে। বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি ব্রান্ডের পণ্য আন্তর্জাতিক খ্যাতি পাওয়ায় এর বাজার বিস্তৃতির উজ্জ্বল সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। সেই সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ এবং নতুন বাজার সৃষ্টির প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।

ইত্তেফাক/বিএএফ