শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

বিশাল রাজস্বের লক্ষ্য আদায়ে গতি নেই

আপডেট : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৩:০৮

চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) প্রায় ৪৩ শতাংশ বাড়তি রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছিল অর্থ মন্ত্রণালয়। অথচ এনবিআরের রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি এর ধারে কাছেও নেই। গত জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত সাত মাসে এনবিআরের রাজস্ব আদায় বেড়েছে পূর্বের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে মাত্র

৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছর ২ লাখ ৯৬ হাজার ১৯০ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে গত সাত মাসে আদায় হয়েছে ১ লাখ ১৫ হাজার ৫৯৮ কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে বাকি পাঁচ মাসে আদায় করতে হবে প্রায় ১ লাখ ৮১ হাজার কোটি টাকা, যা কার্যত অসম্ভব। এমন পরিস্থিতিতে রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা অতীতের মতো সংশোধন করে কিছুটা কমিয়ে আনা হতে পারে বলে জানা গেছে।

অর্থনীতিবিদরা এ ধরনের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রাকে বাস্তবতাবর্জিত আখ্যা দিয়ে বলেছেন, এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে না। আদায়ের সঙ্গে লক্ষ্যমাত্রার এত ব্যবধান ক্রমাগত চলতে থাকলে সরকারের রাজস্ব নীতির উপর মানুষ আস্থা হারাবে। অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর ইত্তেফাককে বলেন, যেখানে অতীতে আদায়ে প্রবৃদ্ধি ছিল গড়ে ১৪ শতাংশ সেখানে ৪৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবতাবর্জিত।

অবশ্য গত সাত মাসে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ে এত কম প্রবৃদ্ধি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সূত্র জানিয়েছে, গত পাঁচ বছরে কখনোই এত কম হারে রাজস্ব আদায় বাড়েনি। গত পাঁচ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ১৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ। সর্বশেষ গত অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৭ শতাংশ। সূত্র জানিয়েছে, গত সাত মাসে মোট রাজস্ব আদায় হয়েছে ১ লাখ ১৫ হাজার ৬শ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে আদায় বেড়েছে ৫ দশমিক ৯৯ শতাংশ। আয়কর, ভ্যাট (মূল্য সংযোজন কর) ও আমদানি শুল্ক-এ তিনটি খাত থেকে এনবিআর মোটাদাগে রাজস্ব আদায় করে থাকে। এর মধ্যে গত সাত মাসে শুল্ক ও ভ্যাট আদায়ের প্রবৃদ্ধিতে তলানিতে এনবিআর। এ দুটি খাতে আদায় বেড়েছে যথাক্রমে ৩ দশমিক ৯৮ শতাংশ ও ৪ শতাংশ হারে। আলোচ্য সময়ে শুল্ক আদায় হয়েছে ৩৬ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা ও ৪৪ হাজার ৯৫৮ কোটি টাকা। আর ১১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে আয়কর আদায় হয়েছে ৩৩ হাজার ৯৭০ কোটি টাকা।

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে রাজস্ব আদায় এত কম হওয়ায় রাজস্ব বোর্ডেও অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। এ নিয়ে কয়েক দফা মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন এনবিআর চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া। আদায়ে গতি আনতে রাজস্বের মাঠ প্রশাসনে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ পদে রদবদলও করা হয়েছে। স্বল্প শুল্কের ঘোষণা দিয়ে উচ্চ শুল্কের পণ্য বন্দরে খালাস হয়ে যাচ্ছে কিনা-এমন আলোচনা সম্প্রতি বেশ জোরালো হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ প্রায়ই অভিযানে বেশকিছু মিথ্যা ঘোষণায় আনা পণ্য আমদানি করে। তাতে দেখা যায়, বন্দর থেকে ওইসব পণ্য স্বল্প শুল্কের হিসেবে খালাস হলেও বাস্তবে সেসব পণ্যে শুল্কের পরিমাণ ছিল কয়েকগুণ বেশি। এর অর্থ হলো মিথ্যা ঘোষণায় শুল্ক ফাঁকি দিয়ে ওইসব পণ্য বন্দর থেকে খালাস হয়েছে। সম্প্রতি চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে এ ধরনের বেশকিছু অনিয়ম বের হয়েছে। অবসরে যাওয়া একাধিক শুল্ক কর্মকর্তার আইডি ব্যবহার করে অভিনব উপায়ে পণ্য খালাস করে নেওয়ার ঘটনাও বের হয়েছে।

অন্যদিকে গেল বছর নির্বাচনের বছর হওয়ায় রাজস্ব আদায়ে মাঠপর্যায়ে খুব বেশি কড়াকড়ি করেননি কর্মকর্তারা। এ ছাড়া অর্থবছরের শুরুতে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে কিছুটা ধীরগতিও রাজস্ব আদায় কম হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ ইত্তেফাককে বলেন, বিগত বছরগুলোতে রাজস্ব আদায়ে যে প্রবৃদ্ধি ছিল, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে তা অনেক কম। এটি উদ্বেগের। এক্ষেত্রে এনবিআরের মনোযোগ কম ছিল কিনা— সে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, বিভিন্নভাবে ফাঁকি ও কারসাজি হতে পারে।

অবশ্য এনবিআরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ইত্তেফাককে বলেন, নির্বাচনের আগে সরকার কয়েকটি খাতে করছাড় দিয়েছে। এলএনজি আমদানিতে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক ছাড় দেওয়ায় এ খাত থেকে চলতি বছর প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকার সম্ভাব্য রাজস্ব কমবে। অন্যদিকে ইন্টারনেট সেবায় ভ্যাট ছাড় এবং কিছু খাতে কর ছাড়ও দেওয়া হয়েছে। সব ধরনের রপ্তানির উপর উেস কর এক শতাংশ থেকে দুই ধাপে শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনায় প্রায় ১ হাজার ২শ’ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় কম আসবে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে রাজস্বে। এ ছাড়া বিবিসি, পেট্রোবাংলাসহ কয়েকটি খাত থেকে বড় অঙ্কের রাজস্ব বকেয়া পড়ে থাকলেও সমন্বয়ের অভাবে ওই অর্থ আদায় হচ্ছে না। কেবল পেট্রোবাংলার কাছেই প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব বকেয়া রয়ে গেছে।

আরও পড়ুন: জাবিতে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপে সংঘর্ষ ও গুলি, প্রক্টরসহ আহত ৬

এনবিআর সূত্র জানিয়েছে, বকেয়া অর্থ আদায়ে সম্প্রতি জ্বালানি ও খনিজসম্পদ সচিবকে আধা সরকারিপত্র পাঠিয়েছেন এনবিআর চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া।

পাঁচ বছরে রাজস্ব আদায়

২০১৭-১৮ অর্থবছরের শুরুতে এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ৪৮ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। পরবর্তীতে বছরের শেষ দিকে এসে তা কমিয়ে ২ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা করা হলেও বছর শেষে আদায় হয়েছিল ২ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকা। প্রবৃদ্ধি হয়েছিল প্রায় ১৮ শতাংশ। এর আগের চার বছরে বছরের শুরুতে নেওয়া লক্ষ্যমাত্রা শেষদিকে এসে কমিয়ে আনা হতো। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে রাজস্ব আদায় হয়েছিল ১ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা। প্রবৃদ্ধি ছিল ১৯ শতাংশ। এর আগের ২০১৫-১৬ অর্থবছরে আদায় হয়েছিল ১ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকা, প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১৪ শতাংশ। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে আদায় হয়েছিল ১ লাখ ৩৫ হাজার ৭শ’ কোটি টাকা। প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১২ দশমিক ৩২ শতাংশ। আর ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে আদায় হয়েছিল ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা।

ইত্তেফাক/আরকেজি