শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

বৈশাখে পোশাক বিক্রি ১৭ হাজার কোটি টাকার!

আপডেট : ১১ এপ্রিল ২০১৯, ০৩:১৬

ভেতরে ভেতরে একটা বিপ্লব হয়ে গেছে। একটা রীতি কখন যে জাতীয় উত্সব হয়ে উঠল, সেটা ভাবলে অবাক না হয়ে উপায় নেই। বাদশাহ আকবরের রাজত্বকালে কর আদায়ের জন্য যে বছর গণনার সূত্রপাত সেটাই আজ বাংলাদেশের সর্বজনীন উত্সব হয়ে উঠেছে। ঈদ ও পূজায় যেভাবে সবাই উত্সব আয়োজনের প্রস্তুতি নেয়, আয়োজনের দিক থেকে বৈশাখ তারচেয়ে কোনোভাবেই কম যায় না। ঈদ ও পূজা দুটোই ধর্মীয় উত্সব। সে অর্থে পহেলা বৈশাখ উদযাপন জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বাঙালির প্রাণের উত্সব। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উদাহরণ।

খুব কাছাকাছি সময়ে ঈদ বা পূজা নেই। কিন্তু শাড়ির দোকানে, বিভিন্ন বুটিক বা ডিজাইনারস হাউসগুলোতে এত ভিড় কেন! দেশীয় পোশাক প্রতিষ্ঠান প্রাইডের ধানমন্ডি শাখার বিক্রয় প্রতিনিধি বললেন, ঈদের পরে বৈশাখেই সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়, তাই এই ভিড়। ফ্যাশন হাউসগুলোও মানুষের চাহিদার কথা মাথায় রেখে বৈশাখী ডিজাইনকেন্দ্রিক পোশাকও তৈরি করে। শাড়ি ও পাঞ্জাবি আসে নতুন নতুন ডিজাইনের।

সাধারণ হিসাবে জানা গেছে, ঈদে এই অভ্যন্তরীণ পোশাকের বাজার প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। আর পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে এবার বিক্রি হবে ১৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকার পোশাক।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ পোশাক প্রস্তুতকারক মালিক সমিতির সভাপতি মো. আলাউদ্দিন মালিক ইত্তেফাককে জানান, ‘সারা দেশে অভ্যন্তরীণ পোশাকের চাহিদা মেটায় প্রায় ২৫ লাখ কর্মী। আমাদের সংগঠনের সদস্য সংখ্যা ছয় হাজার হলেও দেশের আনাচে কানাচে পোশাক প্রস্তুত কর্মীরা পোশাক বানাচ্ছে। এটা একটি বিশাল বাজার। গার্মেন্টস কর্মীরা বিদেশের রফতানির কাপড় বানান, কিন্তু আমাদের অভ্যন্তরীণ পোশাক কর্মীর সংখ্যা রফতানিকারক গার্মেন্টস কর্মীর চাইতে কম নয়।’

সুতরাং দেশের বিশাল একটি কর্মীবাহিনী এই কাপড় প্রস্তুতের সঙ্গে যুক্ত এবং সেসব কাপড়ের বিক্রির পরিমাণ আমাদের ধারণার বাইরে।

এ প্রসঙ্গে ফ্যাশন এন্টারপ্রেনর অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশের সাবেক সভাপতি এবং সাদাকালোর স্বত্বাধিকারী আজহারুল হক আজাদ বললেন, দেশীয় ফ্যাশন হাউজগুলোর বছরে বিক্রি আনুমানিক সাত হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি। এর মধ্যে দুই ঈদ মিলে বিক্রি হয় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা। আর শুধু বৈশাখে বিক্রি হয় প্রায় এক হাজার ৭০০ কোটি টাকার পোশাক। সে হিসাবে বৈশাখে বিক্রি একটি ঈদের প্রায় সমান।

দোকানগুলোতে মানুষের ভিড়, পোশাকের দোকানগুলোতে লাল-সাদা পোশাকের বিচ্ছুরণ— বুঝতে কষ্ট হয় না বৈশাখী আয়োজনে ভরে উঠেছে বুটিক হাউসগুলো। নতুন ডিজাইন, রঙের নিরীক্ষা— সবকিছুই চোখে পড়ছে এবারের বৈশাখী পোশাকের আয়োজনে।

বৈশাখের রঙ লেগেছে শাড়ি ও পাঞ্জাবিতে। ক্রেতারাও বৈশাখী সাজে নিজেকে রাঙিয়ে তুলতে ঘুরছেন দোকানে দোকানে। পছন্দের পোশাকটি খুঁজে নিতে। বেশ কয়েক বছর ধরেই ঈদ বা পূজার পরেই বৈশাখ যেন সর্বজনীন উত্সবের আমেজ নিয়ে উপস্থিত হয় জাতির সামনে। গতকাল রাজধানীর বসুন্ধরা শপিং মল, দেশি দশ, ইয়েলো, আড়ং, ফ্রিল্যান্ডসহ সব দোকানেই মানুষের উপচে পড়া ভিড়।

স্বনামধন্য ডিজাইনার চন্দ্রশেখর সাহা বলেন, একদিনের জন্য হলেও পহেলা বৈশাখে বাঙালি পোশাক কিনে পরবার চল সৃষ্টি হয়েছে। এটা সারা দেশের মানুষ গ্রহণ করেছে। এটা খুব লক্ষণীয় একটি দিক। বিশ্বজুড়েই শহর অঞ্চলে পোশাকে পশ্চিমা ধারার আধিপত্য। সব দেশেই শহুরে পোশাকের চল একরকম তারা আধুনিক পশ্চিমা ধারায় অভ্যস্ত। গ্রামীণ ধারা আরেক রকম। আর এক শ্রেণির মানুষ থাকেন যারা নিজেদের ঐতিহ্যকে সম্মান করে তাকে আঁকড়ে ধরে থাকেন। তারা শাড়ি, পাঞ্জাবি ফতুয়া পরেই জীবন পার করে দেন।

অঞ্জনস-এর স্বত্বাধিকারী শাহীন আহমেদ দৈনিক ইত্তেফাককে বলেন, বৈশাখে এখন প্রতিটি ফ্যাশন হাউজ নতুন নতুন থিম নিয়ে কাজ করে থাকে। লোকজ মোটিফ বিশেষভাবে গুরুত্ব পায়। তাছাড়া, কাটিং, প্যাটার্নের ক্ষেত্রে নির্ভর পোশাকের পাশাপাশি দেশি প্যাটার্নের দিকে ঝোঁক থাকে পোশাক ডিজাইনের সময়।

এবছর বৈশাখের ডিজাইনে এসেছে ভিন্নতা, নতুনত্ব। বাংলার লোকজ মোটিফ উঠে এসেছে মেয়েদের সালোয়ার কামিজ, শাড়ির আঁচল ও পাড়ে এবং পাঞ্জাবির বুকে। স্ক্রিন প্রিন্ট, ব্লক এবং স্টিচে এসব ডিজাইন পোশাককে করে তুলেছে আরো বর্ণিল আকর্ষণীয়। এখন গরমকাল। তাই, ডিজাইনাররা গরমকে মাথায় রেখে নিয়ে এসেছে ফ্লোরাল মোটিফ। বিশেষ করে মেয়েদের ফতুয়া, কামিজ ও শাড়িতে অলওভার ফ্লোরাল মোটিফের অনন্য সব ডিজাইন মন ভরিয়ে দেয়।

ফ্যাশন হাউজ ইয়েলো এবার মেয়েদের পোশাকে প্রাধান্য দিয়েছে ফ্লোরাল মোটিফের ডিজাইনের প্রতি। আর ছেলেদের পাঞ্জাবিতে এসেছে লোকজ মোটিফের কাজ নিয়ে। আড়ং সবসবময়ই তাদের ডিজাইনে আভিজাত্যের ছাপ রাখে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। লোকজ মোটিফে কাঁথা স্টিচের সালোয়ার কামিজ ও শাড়ি নিয়ে এসেছে তারা। ফ্যাশন হাউজ দেশাল ধনেখালি ও তাঁতের শাড়িতে তাদের ডিজাইনের অনন্যতার ছাপ রেখেছে।

ফ্যাশন হাউজগুলোতে যেসব ডিজাইন আসে তার ছাপ থাকে ধানমন্ডির হকার্স মার্কেট, মিরপুর ও মোহাম্মদপুরের বুটিক শপগুলোতে। মিরপুর ২ ও ১ নম্বরে ললনা, পাতাবাহার, মৃত্তিকা প্রভৃতি ফ্যাশন হাউজের দোকানিরা বললেন, ঈদের চাইতেও সংখার দিক থেকে বৈশাখে আমাাদের বিক্রি বেশি হয়। বৈশাখে খুব দামি শাড়ি বা পাঞ্জাবি বিক্রি কম হয়। তবে, মাঝারি দামের পোশাকের বিক্রি বেশি। বাড়ির প্রতিটি সদস্যই বৈশাখে নতুন কাপড় কেনার চল সৃষ্টি হয়েছে। যা ধীরে ধীরে সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়ছে।

ধানমন্ডির বাসিন্দা মিফতাহ তাবাসসুম স্বামী খালিদ আবদুল্লাকে নিয়ে শাড়ি কিনতে এসেছিলেন বসুন্ধরা শপিং মলে। তিনি বললেন, বৈশাখে উত্সবে মেতে ওঠা বাসায় ভালো কিছু রান্না করা এখন একটা সামাজিক রীতিতে পরিণত হয়েছে। তাছাড়া বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য সবাই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসেন বাইরে। আনন্দে মেতে উদযাপন করেন নতুন বাংলা বছরকে। তাই নতুন পোশাক, রঙিন পোশাক কেনাটা উত্সব পালনের জন্য যেন একটা নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

ইত্তেফাক/আরকেজি