শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

সিঙ্গেল ডিজিটে গড়িমসি সরল সুদের কথাই নেই

আপডেট : ০৮ আগস্ট ২০১৯, ০৩:২৬

ব্যাংক ঋণে সরল সুদ কার্যকর করার ঘোষণা দিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তার ঘোষণা অনুযায়ী গত মে মাস থেকেই ব্যাংক ঋণে সরল সুদ গণণা করার কথা। কিন্তু এখনো তা হয়নি।

অন্যদিকে, সিঙ্গেল ডিজিটে সুদ হার নামিয়ে আনার ঘোষণাও কার্যকর করেনি ব্যাংকগুলো। সরকারি দু’একটা ব্যাংক এটি কার্যকর করলেও অধিকাংশ ব্যাংকেই সুদ হার ডাবল ডিজিটে রয়েছে। অথচ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার সুদ হার কমানোর নির্দেশনা দিয়েছেন। সুদ হার কমানোর জন্য ব্যাংকগুলোকে বেশ কিছু সুবিধাও দিয়েছেন। সরকারি তহবিল প্রাপ্তির শর্ত হিসাবেও সিঙ্গেল ডিজিট সুদ হারের শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে। তথাপি রা করছে না ব্যাংকগুলো। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও এ ব্যাপারে তেমন তৎপর নেই। যদিও ব্যাংকের ‘দোষ’ খুঁজতে বরাবরই মরিয়া তারা।

দেশে গ্যাস, বিদ্যুতের সংকটের মধ্যে শিল্প টিকিয়ে রাখা যখন দুস্কর তখন উচ্চ সুদ হার ও দণ্ডসুদ আরোপের মাধ্যমে উদ্যোক্তাকে স্থায়ীভাবে ‘রুগ্ন’ করার পন্থা অব্যাহত রয়েছে। দণ্ড সুদের কারণে এদেশে নতুন উদ্যোক্তা বিকাশও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। উদ্যোক্তারা বলছেন, বিশ্বের কোথাও এতবেশি হারে ব্যাংক ঋণের সুদ নেওয়া হয় না। এমনকি সুদের ওপর সুদ আরোপের মাধ্যমে শিল্পকে রুগ্ন করে দেওয়ার নজিরও বিশ্বে নেই। একজন উদ্যোক্তা নানাবিধ সমস্যায় ভোগেন। গ্যাস বিদ্যুত সংকটের কারণে উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হলে বাণিজ্যে বিরূপ প্রভাব পড়ে। ফলে, ব্যাংক ঋণের কিস্তি খেলাপি হলেই উদ্যোক্তার ওপর দন্ডসুদের খড়গ নামে।

একইভাবে সেবাখাত কিংবা ভোক্তাখাতের ঋণের বেলায়ও তাই। যে সুদ হার চার্জ করা হয় বাস্তবে তারচেয়ে কয়েকগুণ বেশি সুদ নেয় ব্যাংকগুলো। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্সি একবার বলেছিলেন, দেশের ব্যাংকগুলো রীতিমত ডাকাতি করছে। তারপরও ব্যাংকগুলো সুদের হার কমানো কিংবা সরল সুদ হার চালুর ব্যাপারে রা করছে না। কিন্তু উন্নত দেশগুলো তাদের স্বল্প সুদের মধ্যেও সুদ হার কমাচ্ছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতেও সুদের হার কমানো হয়েছে।

ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বিএবি’র কাছ থেকে সব ঋণের ক্ষেত্রেই সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে করতে হবে এমন ঘোষণাই এসেছিল । গত ১ জুলাই ১৮ থেকে যা কার্যকর করা কথা। এ নিয়ে একাধিক বৈঠকও হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, বাস্তবায়ন না করলে ব্যবস্থা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বলেছে, যারা সুদ কমাবে না তাদের কর্পোরেট ট্যাক্স কমানো হবে না। কিন্তু ব্যাংকগুলো কারো কথার তোয়াক্কা করেনি। বরং ব্যাংকগুলো তাদের পরিচালন মুনাফার উল্লম্ফণ দেখিয়ে শেয়ারবাজারে প্রভাব ফেলতে তৎপর। বেশি সুদ, মুদ্রাবাজার ও শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের মাধ্যমে মুনাফার পথে হাটলেও শিল্পে পুঁজি জুগিয়ে কর্মসংস্থানমুখী প্রবৃদ্ধি অর্জনের দিকে ব্যাংকগুলোর নজর ছিল কম।

ব্যাংকগুলোর নিজস্ব তথ্য বিশ্লেষণ করেই দেখা যায়, শিল্প ঋণে মূলধনী ও মেয়াদি উভয় ঋণের ক্ষেত্রে অধিকাংশ ব্যাংকই সিঙ্গেল ডিজিটে সুদের হার নামিয়ে আনার নিয়ম মানছে না। এসব ব্যাংক মাঝারি ও বড় শিল্পের জন্য কিছুটা কম সুদ নিলেও ছোট শিল্পের জন্য অনেক বেশি সুদ নিচ্ছে। ফলে ছোট শিল্পগুলোর জন্য ব্যবসা পরিচালনা করা কষ্টসাধ্য হয়ে যাচ্ছে। আর নতুন বেশি সুদ পরিশোধ করে নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠা করাও সম্ভব হচ্ছে না।

অন্যদিকে, সরকার ক্ষুদ্র ও মাঝারি বিনিয়োগকে উৎসাহ দিতে বদ্ধপরিকর। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) প্রতিষ্ঠান উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসায় টেকসই হতে পারে না। সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে এসএমই খাতে সুদের হার বরং বেশি। অথচ এখাতে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। শ্রমঘণ অর্থনীতির জন্য এসএমইকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। একইভাবে অন্যান্য খাতেও উচ্চ সুদ হার মারাত্মক প্রভাব ফেলে। যেখানে দেশে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস—বিদ্যুত সরবরাহও নেই। জ্বালানি সংকট, বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা প্রভৃতি মোকাবেলা করে বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের টিকে থাকতে হয়।

সর্বশেষ চলতি সপ্তাহে ব্যাংকারদের সঙ্গে এক বৈঠকে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, সিঙ্গেল ডিজিটে সুদ হারের প্রজ্ঞাপন শীঘ্রই জারি করা হবে। উদ্যোক্তারা বলছেন, এর পাশাপাশি সরল সুদ হার বাস্তবায়নও জরুরি। কেননা, বর্তমান সুদ গণণার নিয়মে ব্যাংকগুলো অযৌক্তিকভাবে গ্রাহকের অর্থ লোপাট করছে। এর সুরাহা না হলে দেশে কর্মসৃজনে আগ্রহী উদ্যোক্তারা নিরুত্সাহিত হবেন।

ফিনান্সিয়াল ইকনোমিস্ট ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী বলেন, উদ্যোক্তা বিকাশের জন্য সুদ গণণায় ‘সিম্পল রেট’ চালু সময়ের দাবি। ২০২৩ সালের মধ্যে বর্তমান সরকারের কর্মসৃজনের যে লক্ষ্য ধরা হয়েছে তা বাস্তবায়ন করতে হলে উদ্যোক্তাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। সেক্ষেত্রে সরল সুদ ও সিঙ্গেল ডিজিট সুদ হার সহায়ক ভূমিকা রাখবে।

ইত্তেফাক/জেডএইচ