শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

সরকারি উদ্যোগেও কমছে না পেঁয়াজের দাম

আপডেট : ০২ অক্টোবর ২০১৯, ০১:২০

সরকারি নানা উদ্যোগেও কমছে না পেঁয়াজের দাম। গতকাল মঙ্গলবারও রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ১১০ থেকে ১৩০ টাকায়। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন স্বল্প আয়ের মানুষ। অবস্থা এমন যে, বাজার থেকে শুরু করে অফিস-আদালত সব জায়গায় এখন আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘পেঁয়াজ’।

সরকারের বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণে স্বল্প মূল্যে পেঁয়াজ বিক্রি শুরু করলেও তার কোনো প্রভাব নেই বাজারে। কারণ তা চাহিদার তুলনায় খুবই কম। গতকাল সকালে রাজধানীর শান্তিনগর বাজারের সামনে গিয়ে দেখা যায়, টিসিবির পেঁয়াজ বিক্রির ট্রাক ঘিরে ক্রেতাদের দীর্ঘ লাইন। অথচ প্রতি ট্রাকে মাত্র এক টন পেঁয়াজ বিক্রি করা হচ্ছে। ৪৫ টাকা কেজি দরে একজন ক্রেতাকে দেওয়া হচ্ছে দুই কেজি করে পেঁয়াজ। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসেবে, সারাদেশে প্রতিদিন পেঁয়াজের চাহিদা ৬ হাজার টন। এই হিসেবে রাজধানীতেই চাহিদা প্রায় দেড় হাজার টন। কিন্তু টিসিবি রাজধানীতে বিক্রি করছে মাত্র ৩৫ টন পেঁয়াজ। এই সামান্য পরিমাণ পেঁয়াজ দিয়ে কীভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব? এ প্রশ্ন ভোক্তাদের।

এদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পেঁয়াজের দরের ঊর্ধ্ব গতিরোধে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিলেও এখন পর্যন্ত তার কোনো ইতিবাচক প্রভাব পড়েনি বাজারে।

বাণিজ্য সচিব ড. মো. জাফর উদ্দীন পেঁয়াজের ঊর্ধ্বমূল্য নিয়ে ভোক্তাদের আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই জানিয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, সার্বিক পরিস্থিতি মনিটরিংয়ের জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায়ের ১০ জন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা গতকাল থেকে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, যশোর, দিনাজপুর, পাবনা, সাতক্ষীরা, সিরাজগঞ্জ ও শরীয়তপুর জেলার বাজারগুলোতে তদারকি শুরু করেছেন। এছাড়াও প্রতিটি জেলা প্রশাসন থেকেও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

তিনি বলেন, পেঁয়াজ আমদানির ক্ষেত্রে এলসি মার্জিন এবং সুদের হার হ্রাস করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক পদক্ষেপ নিয়েছে। স্থল ও নৌবন্দরগুলোতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আমদানিকৃত পেঁয়াজ খালাস করা হচ্ছে। পেঁয়াজ পরিবহন নির্বিঘ্ন করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানিয়েছেন, এলসির মাধ্যমে মিয়ানমার, মিশর ও তুরস্ক থেকে আমদানিকৃত পেঁয়াজ বন্দরে খালাস করা শুরু হয়েছে। এছাড়া মিয়ানমার থেকে বর্ডার ট্রেডের মাধ্যমে টেকনাফ বন্দর দিয়ে আমদানিকৃত পেঁয়াজ এবং দেশের বিভিন্ন জেলার পাইকারি হাটগুলোতে বিক্রীত পেঁয়াজ দ্রুত সারাদেশে নির্বিঘ্নে পৌঁছে যাচ্ছে। আশা করছি, দ্রুত পেঁয়াজের দাম কমে যাবে।

এদিকে এখনো রাজধানীসহ সারাদেশে প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১৩০ টাকায়।

সৈয়দপুর (নীলফামারী) সংবাদদাতা জানান, সৈয়দপুরে দফায় দফায় বাড়ছে পেঁয়াজের দাম। ভারত রপ্তানি বন্ধ করায় ও অব্যাহত বৃষ্টির কারণে পেঁয়াজের বাজারে আগুন লেগেছে। বর্তমানে বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজ ১১০ থেকে ১৩০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।

নতুন বাবুপাড়ার গৃহিণী হোসনে আরা লিপি, বাঁশবাড়ির রহিমা খাতুন জানান, তারা প্রতিদিনই সংসারের বাজার সদাই করে থাকেন। কিন্তু পেঁয়াজ কিনতে এসে তারা চোখে অন্ধকার দেখছেন। ফলে চাহিদার অর্ধেক পেঁয়াজ কিনতে বাধ্য হয়েছেন তারা।

এ ব্যাপারে সৈয়দপুর বণিক সমিতির সভাপতি মো. ইদ্রিস আলী বলেন, ভারত রপ্তানি বন্ধ করার ঘোষণায় আমদানি কমে গেছে। ফলে বাজারে পেঁয়াজের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে।

বগুড়া থেকে স্টাফ রিপোর্টার জানান, বগুড়ার বাজারে দুদিন আগেও এক কেজি ভারতীয় পেঁয়াজ কেনা যেত ৮০ টাকায়। সেই পেঁয়াজের দাম এক লাফে প্রতি কেজিতে ৪০ টাকা বেড়ে এখন ১২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

বগুড়ার পেঁয়াজের পাইকারি বাজার রাজাবাজারের ব্যবসায়ীরা জানান, বগুড়া ছাড়াও পাইকারি এ মোকাম ও আড়ত থেকে পার্শ্ববর্তী জয়পুরহাট, নওগাঁ, নাটোর, সিরাজগঞ্জ এবং গাইবান্ধার ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজ কেনেন। এই পাইকারি মোকামে পেঁয়াজের বাজার নির্ভরশীল আমদানি করা ভারতীয় পেঁয়াজের সরবরাহের ওপর। ভারত থেকে হিলি, ভোমরা, বেনাপোল এবং সোনামসজিদ স্থলবন্দর হয়ে এতোদিন বগুড়ার রাজাবাজার আড়তে পেঁয়াজ আসত। ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধের প্রভাব পড়েছে বাজারে।

রাজাবাজারের অন্যতম আমদানিকারক আবদুল গফুর ফকির আশ্বস্ত করেন, দুয়েকদিনের মধ্যে মিয়ানমার, তুরস্কসহ কয়েকটি দেশ থেকে আমদানি করা পেঁয়াজ বগুড়ার আড়তে পৌঁছাবে। সরবরাহ স্বাভাবিক হলে বাজারও স্থিতিশীল হবে।

আরও পড়ুন: হংকংয়ে চীন ও গণতন্ত্রপন্থিরা মুখোমুখি, পুলিশের গুলি

কক্সবাজার প্রতিনিধি জানান, মিয়ানমার থেকে রেকর্ড পরিমাণ পেঁয়াজ আমদানি হলেও জেলার স্থানীয় বাজারগুলোতে এখনো পেঁয়াজের দাম কমেনি। সরকারের কঠোরতার মাঝেও মুনাফালোভী অসাধু ব্যবসায়ীরা ইচ্ছামতো পেঁয়াজের দাম বাড়াচ্ছেন।

টেকনাফ স্থলবন্দর শুল্ক বিভাগ সূত্র জানায়, গত পক্ষকাল থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত মিয়ানমার থেকে টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে প্রায় ৪ হাজার ৩৮০ টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। খালাসের অপেক্ষায় রয়েছে পেঁয়াজভর্তি আরো একাধিক ট্রলার।

টেকনাফ স্থলবন্দরকেন্দ্রিক আমদানিকারকদের অভিযোগ, শ্রমিক অপর্যাপ্ততার কারণে পেঁয়াজ বোঝাই ট্রলারগুলো বন্দরে নোঙর করে আছে। বন্দরের শ্রমিক অব্যবস্থাপনার ফলে শ্রমিক সংকটে পেঁয়াজ ট্রলার থেকে খালাস করা সম্ভব হচ্ছে না।

ব্যবসায়ীরা জানান, মিয়ানমার থেকে আমদানিকৃত পেঁয়াজ স্থানীয় বাজারে চাহিদা মেটানোর পর নিয়ে যাওয়া হচ্ছে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে। সেখান থেকে একাধিক হাত বদল হয়ে তা সরবরাহ হচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।

অভিযোগ উঠেছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে পেঁয়াজ গুদামজাত করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে পেঁয়াজের বাজার অস্তিতিশীল করার চেষ্টা করছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা।

চট্টগ্রাম অফিস জানায়, গতকাল চট্টগ্রামের পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে পেঁয়াজের আড়তে অভিযান চালিয়েছে জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত। অভিযানে নেতৃত্ব দেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. তৌহিদুল ইসলাম এবং মো. আশরাফুল আলম।

অভিযানে খাতুনগঞ্জে পেঁয়াজের আড়তদার মেসার্স হাজী অছিউদ্দিন সওদাগর, মেসার্স আবদুল আউয়াল, মেসার্স শাহজালাল ট্রেডার্স, বাগদাদী করপোরেশন এবং এসএন ট্রেডার্সে পেঁয়াজের ক্রয় ও বিক্রয়মূল্য খতিয়ে দেখা হয়। ভ্রাম্যমাণ আদালত সূত্র জানায়, খাতুনগঞ্জে পেঁয়াজের আড়তগুলোতে মিয়ানমারসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আসা পেঁয়াজ ক্রয়মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছিল। কয়েকটি আড়ত মিয়ানমারের পেঁয়াজ ৪২ টাকায় কিনলেও বিক্রি করেছে ৭৫-৮০ টাকায়। কয়েকটি আড়ত গত মাসে ভারতের পেঁয়াজ ৪২ থেকে ৬০ টাকায় কিনলেও এখন বিক্রি করছে ৯০ টাকায়। অভিযানে পেঁয়াজের দাম কৃত্রিমভাবে যাতে না বাড়ানো হয়, সেজন্য ব্যবসায়ীদের সতর্ক করা হয়েছে।

ইত্তেফাক/অনি