বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

সান্ধ্য কোর্স ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অকালমৃত্যু!

আপডেট : ১৪ জানুয়ারি ২০২০, ১০:২৫

‘বাণিজ্যিক কোর্স সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করছে। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশের পাশাপাশি সার্বিক পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে। অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এখন দিনে সরকারি আর রাতে বেসরকারি চরিত্র ধারণ করে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস সন্ধ্যায় মেলায় পরিণত হয়।’ সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫২তম সমাবর্তনে সান্ধ্য কোর্স নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য মহামান্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এমন মন্তব্য করেন।

মহামান্য রাষ্ট্রপতির এমন সমালোচনার পরপরই সন্ধ্যাকালীন কোর্স বন্ধে উদ্যোগ নিতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের চিঠি দেয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। কিন্তু আমি অত্যন্ত পরিতাপের সঙ্গে লক্ষ করেছি যে, সন্ধ্যাকালীন কোর্সের সঙ্গে শুধু নামের (উইকেন্ড বা সাপ্তাহিক) এবং ক্লাসের সময়ের (রাত আর দিন) পার্থক্যের কারণে এসব ‘বাণিজ্যিক কোর্স’ বন্ধে ইউজিসির নির্দেশনা মানছে না জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ইউজিসি বলছে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘উইকেন্ড’ কোর্স পরিচালিত হয়, সেটি তাদের জানা নেই। এমনকি এসব কোর্স পরিচালনায় ইউজিসির অনুমোদনও নেই। উদাহরণ হিসেবে তাই নিজের বিশ্ববিদ্যালয়কেই বেছে নিচ্ছি। বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৬টি বিভাগের মধ্যে ১৬টি এবং চারটি ইনস্টিটিউটের মধ্যে দুটি ইনস্টিটিউটে ‘উইকেন্ড’ কোর্স পরিচালিত হচ্ছে। এক থেকে দুই বছর মেয়াদি এসব কোর্স শেষ করতে একজন শিক্ষার্থীকে ৯৫ হাজার থেকে ২ লাখ ২৬ হাজার টাকা পর্যন্ত গুনতে হয়। এসব কোর্স পরিচালনা করে বিভাগ ও ইনস্টিটিউটগুলো প্রতি বছর প্রায় ৩৬ কোটি টাকার মতো আয় করে থাকে। এ আয় থেকে ৪০ শতাংশ অর্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে জমা দেওয়ার কথা থাকলেও সেটা পুরোপুরি মানা হচ্ছে না।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় আমার দীর্ঘদিনের পরিচিত—এর অন্তর্গত চরিত্রটি বাইরে থেকে সহজে বোঝা যায় না। স্বভাবে আবাসিক বলেই শিক্ষার্থীদের চেতনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাপ মুদ্রিত হয়েই যায়। কত দিন এর সঙ্গে পরিচয়? মনে হয়, এই তো সেদিন। ১৯৭২-৭৩ সেশনে রসায়ন বিভাগে ভর্তি হই। দীর্ঘদিনের পরিচিত অথচ এই ক্যাম্পাসটা এখন মাঝে মাঝে অচেনা লাগে। বিশেষ করে, সপ্তাহের দুই দিন। শুক্রবার ও শনিবার। সবুজ বাস এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য। সরকারি অনুদানের কিছু বিআরটিসির লাল বাস ক্যাম্পাসের গাড়ি বহরে যোগ হলো কয়েক বছর আগে। কিন্তু এখন ঘটনা ভিন্ন। সপ্তাহের বিশেষ এই দুই দিনে হরেক রকমের বাসের দেখা মেলে ক্যাম্পাসে। সামনে আবার প্ল্যাকার্ড ঝোলানো থাকে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। এই বাসগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের উইকেন্ড কোর্সের শিক্ষার্থীদের আনা নেওয়া করে। ভাড়া করা বাসগুলো শুধুই রঙেই ভিন্ন নয়, এর যাতায়াত, এর যাত্রীদের গতিবিধি, আচার-ব্যবহার পর্যন্ত আলাদা।

অর্থনীতির ক্রমসম্প্রসারণে ব্যাংক, বিমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে চাকরির ক্ষেত্রে ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে ব্যবসায়ের বিষয়ের একটি ডিগ্রি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উইকেন্ড কোর্স চালুকালে বলা হয়েছিল, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এসব কোর্সে ভর্তি হয়ে সর্বগুণে গুণান্বিত হয়ে মেধার দৌড়ে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাবে। আমরাও বিষয়টিকে সেভাবেই দেখেছি—ব্যাবসায়িক চিন্তা থেকে এর শুরু হয়নি। কিন্তু, হায়! এখন চিত্রটা ভিন্ন। বাণিজ্যিক দিক লক্ষ রেখে অনেকগুলো বিভাগেই সন্ধ্যাকালীন বা প্রফেশনাল কোর্স চালু করা হয়েছে। আজ যখন পুরো ক্যাম্পাসে হাঁটি শুক্রবার-শনিবার, দেখি বেশির ভাগ বিভাগের সামনেই উইকেন্ড কোর্সের শিক্ষার্থীদের ভিড়। এরই মধ্যে অনেকগুলো বিভাগ ও ইনস্টিটিউট এই উইকেন্ড বা প্রফেশনাল কোর্স চালু করেছে, বাকি বিভাগগুলোতেও খোলার চেষ্টা চলছে প্রাণান্তকর।

যে বিষয়ে বলছিলাম, বাজারের ক্রমবর্ধমান চাহিদা কাজে লাগিয়ে বেশির ভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট নানা বিষয় খুলে বসেছে সন্ধ্যাকালীন কোর্সের নামে। এতে চলে নিয়মিত পাঠদানও। নামমাত্র ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়মিত শিক্ষার্থীর দ্বিগুণ বা তারও বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করা হচ্ছে এসব কোর্সে। যদিও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় ভালো ফল করার পর তীব্র প্রতিযোগিতাপূর্ণ ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তির সুযোগ পায় খুব কমসংখ্যক শিক্ষার্থী। বিপরীতে সন্ধ্যাকালীন কোর্সে টাকার বিনিময়ে পড়ার সুযোগ পায় এদের কয়েক গুণ। অভিযোগ রয়েছে, শিক্ষকদের বেশি মনোযোগ, সান্ধ্যকালীন কোর্স নিয়েই। তারা নিয়মিত পাঠদানের চেয়ে এসব কোর্সেই বেশি সময় দেন।

উইকেন্ড প্রোগ্রামগুলোতে সপ্তাহের দুদিন ধরে ক্লাস নেওয়ার কথা থাকলেও বেশিরভাগ প্রোগ্রামগুলোতেই সপ্তাহের এক দিনে পুরো ক্লাস নিয়ে শেষ করা হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ ডিপার্টমেন্টেই উইকেন্ড কোর্স চালু করেছে। অথচ উইকেন্ড প্রোগ্রামগুলো সন্ধ্যাকালীন কোর্সের থেকেও নিম্নমানের। সন্ধ্যাকালীন কোর্সগুলোতে অন্তত সপ্তাহের তিন-চার দিন সন্ধ্যায় ক্লাস পরীক্ষা নেওয়া হয়। কিন্তু উইকেন্ড সপ্তাহের এক বা দেড় দিনে কতটুকুই-বা পড়ানো সম্ভব হয়? জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাব্যক্তিরা বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের উইকেন্ডকোর্সগুলো থেকে প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের টাকা সম্মানী গ্রহণ করেন কোনো কাজ না করেই। এ কারণে মহামান্য রাষ্ট্রপতির সমালোচনা ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের নির্দেশনা জারির পরও এসব কোর্স বন্ধ করার ব্যাপারে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫২তম সমাবর্তনে সান্ধ্য কোর্স নিয়ে মহামান্য রাষ্ট্রপতির বক্তব্যকে নির্দেশনা মনে করেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অনতিবিলম্বে এসব সান্ধ্য কোর্স বন্ধ করা উচিত বলে আমি মনে করি।

বাণিজ্যিক লক্ষ্য সামনে রেখে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্য কোর্সের প্রসার ঘটছে ঠিকই। কিন্তু তাতে মানসম্মত শিক্ষাপ্রদান নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। ফলে উচ্চশিক্ষার ডিগ্রির প্রসার বাড়ছে, গুণমানের শিক্ষা প্রদান হচ্ছে না, শিক্ষার্থীরাও গুণমানসম্পন্ন শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে; নীরব অসন্তোষ বাড়ছে তাদের মধ্যেও। শিক্ষার প্রসারে এই গ্র্যাজুয়েটদের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদাহানি ঘটছে। নামে, ভিন্ন নামে অসংখ্য সান্ধ্য মাস্টার্স কোর্স চালু করা হচ্ছে, কখনো কখনো নামমাত্র বা ভর্তি পরীক্ষা ছাড়াই নিম্নমানের শিক্ষার্থী ভর্তি করা হচ্ছে। উদ্দেশ্য বেশি ছাত্র, বেশি টাকা। নতুন নতুন এসব বিভাগ চালুর সঙ্গে শিক্ষার্থীর সংখ্যাবৃদ্ধি, অবকাঠামো, জনবল ও আবাসনে প্রতি বছরই বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ বাড়ছে। যদিও বলা হচ্ছে, নিজস্ব আয় বৃদ্ধি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে সান্ধ্য মাস্টার্স বা প্রফেশনাল কোর্স চালু করেছে। কিন্তু প্রকৃত বাস্তবতা তা নয়, এই আয়ের বা টিউশন ফির বড়ো অংশই যায় শিক্ষকদের পকেটে। এই কোর্সের ৩০ শতাংশ টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়, অর্থাত্ লাখ টাকা টিউশন ফি থেকে মাত্র ৩০ হাজার টাকা। ১০ শতাংশ টাকা বরাদ্দ রাখা হয় বিভাগ উন্নয়নে আর ৬০ শতাংশ কোর্স শিক্ষক ও সংশ্লিষ্টরা ভাগাভাগি করে থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের আয় বাড়ানোর লক্ষ্যে এসব কোর্স চালু করা হলেও কার্যত বৈষয়িক উন্নয়ন হচ্ছে শিক্ষকদের। কারণ আয়ের ৬০ শতাংশের অংশীদার শিক্ষকরা। যদিও প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘাটতির পরিমাণ বাড়ছেই। সান্ধ্য বা প্রফেশনাল কোর্স হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রমের বাইরে প্রফেশনাল কোর্স। নির্ধারিত টিউশন প্রদান সাপেক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত নন এমন শিক্ষার্থীরা ভর্তির সুযোগ পান, যা তাদের প্রফেশনাল কাজের সহায়ক হয়। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত কোনো শিক্ষার্থী চাইলে নির্ধারিত টিউশন ফি দিয়ে পড়তে পারেন। কিন্তু এসব কোর্সের শিক্ষাক্রম, ক্লাস প্রেজেন্টেশন, লেকচার, পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়েও সমালোচনা শুরু হয়েছে। মানসম্মত শিক্ষার অনুপস্থিতি এসব কোর্সের দুর্নাম বয়ে আনছে। আর, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত পাঠদানের বাইরে এই কোর্সগুলি চলে দ্রুতগতিতে। নিয়মিত কোর্সের পরীক্ষা নির্ধারিত সময়ের কয়েক মাস পরে বা বছর পেরিয়ে অনুষ্ঠিত হলেও শিক্ষকদের মাথাব্যথা কম দেখা যায়। তবে, এই কোর্সগুলো নির্দিষ্ট সময়ে শেষ করার একটা তাড়া দেখা যায় শিক্ষকদের মধ্যে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক নিজেদের ক্যাম্পাসের চেয়ে অনেক বেশি সময় দিচ্ছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। তুলনামূলকভাবে বেশি অর্থ আসে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও সান্ধ্য কোর্স থেকে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত পাঠদান তাদের কাছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনেকটাই গৌণ হয়ে পড়ে। বিভাগে যে ক্লাস রুটিন দেওয়া হয়, তা অনুসরণ করেন না বেশির ভাগ শিক্ষকই। সারা বছর ঠিকমতো ক্লাস না নেওয়ার ফলে সিলেবাস বাকি থেকে যায়। এরকম পরিস্থিতিতে শিক্ষকরা অনেক সময় বিশেষ সাজেশন্স দিয়ে দায়িত্ব থেকে মুক্তি পেতে চান। আবার অনেকে পরীক্ষার আগে আগে সিলেবাস শেষ করার তাগিদে এত বেশি অতিরিক্ত ক্লাস নেন যে, শিক্ষার্থীদের ওপর প্রচণ্ড চাপ পড়ে। উত্তরপত্র মূল্যায়নে সময়ের অভাব কিংবা শিক্ষার্থীদের তুষ্ট রাখার জন্য অবিবেচকের মতো নম্বরের হার বাড়িয়ে দিয়ে থাকেন। এমন চিত্র কেবল জাহাঙ্গীরনগর নয়, দেশের শীর্ষস্থানীয় বিদ্যাপীঠ থেকে শুরু করে, কদিন আগে প্রতিষ্ঠিত নবীনতম বিশ্ববিদ্যালয়েরও। বলতে গেলে প্রায় বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র একই রকম।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিপুল স্বাধীনতা। ইচ্ছে হলে ক্লাসে যান, না হলে যান না। পড়ানোয় জবাবদিহি করতে হয় না। প্রমোশনের সময় কিছু প্রকাশনা লাগে, দায়সারা গোছে তা করে ফেলেন। এমফিল-পিএইচডি হয়ে গেলে তাকে আর পায় কে! জোর দিয়ে বলতে পারি, এমন শিক্ষকের সংখ্যা নেহাত কম নয়, যারা কেবল প্রমোশনের জন্য জার্নালে লেখালেখি করেছেন, পরে আর তার ধারে কাছেও ঘেঁষেননি। এই চিত্র সারা দেশের বেশিরভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের। প্রায় প্রতিটি বিভাগের শিক্ষকরাই সান্ধ্য কোর্সের সঙ্গে জড়িত, সপ্তাহের কয়েকটা দিন কাটে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে। তাদের কাছে নিয়মিত কোর্সগুলো, যেটা পেশাদারিত্বের প্রধানতম দায়িত্ব, তা পালন হয় কতটুকু।

লেখক : ড. শরীফ এনামুল কবির

সাবেক সদস্য, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়