বর্তমান বিশ্বে করোনা ভাইরাস মহামারী হিসেবে রূপ নিয়েছে। কেড়ে নিচ্ছে হাজারো মানুষের প্রাণ। প্রতিটি দেশেই এ রোগটি প্রথমভাগে ধীরে ধীরে ছড়াচ্ছে কিন্তু পরে হঠাৎ করেই বড় আকার ধরণ করছে, বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে exponential growth. তাই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসাবে যথেষ্ট সতর্ক থাকতে হবে। আর সাবধানতার সেসকল উপায় রয়েছে তারমধ্যে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার অন্যতম। কিন্তু বাজারে হ্যান্ড স্যানিটাইজারের সহজলভ্যতা না হওয়ায় বর্তমানে স্থানীয়ভাবে এর তৈরির গুরুত্ব বেড়ে গেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়মানুসারে স্থানীয়ভাবে হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরির উপায় বলেছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. নিজাম উদ্দিন। শনিবার (২১ মার্চ) সকালে দৈনিক ইত্তেফাককে তিনি এসব কথা বলেন।
হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরির দুই উপায়:
অধ্যাপক ড. মো. নিজাম উদ্দিন বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়মানুসারে দুই পদ্ধতিতে হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি করা যায়। প্রথম পদ্ধতিতে, ৯৬% ইথানল (ইথাইল এলকোহল) এর সাথে ৩% হাইড্রোজেন পারক্সাইড, ৯৮% গ্লিসারল ও ঠাণ্ডাকৃত ফোটানো পানি। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে, ৯৯,৮% আইসোপ্রোপাইল এ্যালকোহল (প্রোপানল) এর সাথে ৩% হাইড্রোজেন পারক্সাইড, ৯৮% গ্লিসারল ও ঠাণ্ডাকৃত ফোটানো পানি।
১০ লিটার তৈরিতে যতটুকু লাগবে:
১০ লিটার হ্যান্ড স্যানিটাইজার উৎপাদনের জন্য প্রথম ক্ষেত্রের নিয়মানুসারে, ইথানল ৮৩৩৩ মিলিলিটার, হাইড্রোজেন পারক্সাইড ৪১৭ মিলিলিটার, গ্লিসারল ১৪৫ মিলিলিটার এবং ১১০৫ মিলিলিটার ঠাণ্ডা করা ফোটানো পানি ।এবং দ্বিতীয় ক্ষেত্রে আইসোপ্রোপানল ৭৫১৫ মিলিলিটার, হাইড্রোজেন পারক্সাইড ৪১৭ মিলিলিটার, গ্লিসারল ১৪৫ মিলিলিটার এবং ১৯২৩ মিলিলিটার ঠাণ্ডা করা ফোটানো পানি।
অন্যান্য দ্রব্যাদি:
১০ লিটার এর গ্লাস অথবা প্লাস্টিক এর স্ক্রু থ্রেটেড মুখযুক্ত বোতল, কাঠ, প্লাস্টিক অথবা ধাতব প্যাডেল, মাপক দাগযুক্ত সিলিন্ডার/জগ, প্লাস্টিক অথবা ধাতব ফানেল, ১০০ মিলিলিটার প্লাস্টিক লিক প্রুফ মুখযুক্ত বোতল।
হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরির প্রক্রিয়া:
প্রথমে এ্যালকোহল ১০ লিটার বোতলে ঢালতে হবে। এরপর হাইড্রোজেন পারক্সাইড সিলিন্ডার দিয়ে মেপে মেশাতে হবে। সবশেষে গ্লিসারল ও পানি মিশিয়ে প্রয়োজন অনুযায়ী প্যাডেল দিয়ে নাড়তে হবে। এরপর ১০০ মিলিলিটার এর বোতলে মেপে ভরে ছিপি লাগিয়ে ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত রেখে দিতে হবে ব্যবহার উপযোগী করার জন্য।
আর, এখানে যেহেতু রাসায়নিক দ্রব্যাদির ব্যবহার হবে যেমন ইথানল অথবা আইসোপ্রোপানল, হাইড্রোজেন পারক্সাইড এবং গ্লিসারিন। তাই আপদকালিন সময় বিবেচনায় সরকারের অনুমতি ও সিদ্ধান্ত প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।
যে পদ্ধতি বেছে নিবেন:
যেহেতু আইসোপ্রোপানল ইথানলের চেয়ে অনেক সস্তা তাই ২য় পদ্ধতিটিই বহুল ব্যবহৃত। তাছাড়া, ২য় পদ্ধতিতে ১০০ মিলি. হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরিতে খরচ পড়বে মাত্র ৪৭ টাকা। যেখানে ১ম পদ্ধতিতে ১০০ মিলি হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরিতে খরচ পড়বে ২০০ টাকা।
রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহারে সতর্কতা:
যেহেতু বেশি কনসেন্ট্রেড এ্যালকোহল ব্যবহার করতে হবে তাই অনেক বেশী সতর্ক থাকতে হবে। রাসায়নিক দ্রব্য ত্বকে বা চোখে লাগলে সাথে সাথে প্রচুর পানি দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে ধৈত করতে হবে। প্রয়োজনে সাধারণ ত্বকের ক্ষেত্রে সাবান অথবা হালকা ডিটারজেন্ট দিয়ে ধৈত করতে হবে। এগুলো শুষ্ক ও ঠাণ্ডা জায়গায় আগুন হতে দূরে রাখতে হবে। হাইড্রোজেন পারক্সাইড ব্যবহারের ক্ষেত্রেও অনুরূপ সুরক্ষা রাখতে হবে।
অন্যদিকে, হ্যান্ড স্যানিটাইজারে এ্যালকোহল (আইসোপ্রোপাইল, ইথানল) ব্যবহার করা হয় যা ত্বককে শুষ্ক করে দেয়। এরা ত্বকের প্রাকৃতিক তেলকে দূর করে দেয় এবং ডার্মাটাইটিসের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। তাই অতিরিক্ত ব্যাবহার ত্বকের বাহিরের সুরক্ষা স্তরকে নষ্ট করতে পারে।
দ্রব্যগুলো যেভাবে সংগ্রহ করতে পারেন:
বাংলাদেশে সাধারণত বিভিন্ন ক্যামিকেল সাপ্লাইয়ার ও কোম্পানি আছে। যারা নিজেরা এ্যালকোহল ও হাইড্রোজেন পারক্সাইড তৈরি করে। অথবা বিদেশ থেকে আমদানি করে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, রিসার্চ অর্গানাইজেশন, ঔষধ কোম্পানিগুলোতে সরবরাহ করে। তাদের থেকে সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে স্থানীয় অনুমোদিত আপদকালীন একটা কাঠামোর মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সামগ্রী সংগ্রহ করা যেতে পারে।
আমার জানা মতে, এ্যালকোহল তৈরির একমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠান কেরু এ্যান্ড কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড। তাছাড়া ঢাকার কাওরান বাজারের Samuda Chemical Complex Limited (SCCL) নামের একটি প্রাইভেট কোম্পানি হাইড্রোজেন পারক্সাইড তৈরি করে।
এছাড়া, স্থানীয় সরকারি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যামিকাল নিয়ে কাজ করে এমন সব বিভাগের সহায়তা নিয়ে সংগ্রহ করা যেতে পারে।
স্থানীয়ভাবে যাদের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে:
বাংলাদেশের প্রতিটি উপজেলা / জেলায় সরকারি বেসরকারি অনেক হাইস্কুল, কলেজ, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় আছে যেখানে রসায়ন, পদার্থ, জীববিজ্ঞান ও অন্যান্য বিষয়ের অনেক সংশ্লিষ্ট বিষয়ের উপর অনার্স/মাস্টার্স/পিএইচডি করা এক্সপার্ট রয়েছেন। বিচ্ছিন্নভাবে না করে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অধীনে প্রতিজেলায় কারিগরি কমিটির একজন সরকারি কলেজের অধ্যক্ষের তত্ত্বাবধায়নে হতে পারে। যেখানে উল্লিখিত বিষয়ের উপর বিশেষজ্ঞদের সদস্য করা যেতে পারে। প্রশাসন সে ক্ষেত্রে লজিস্টিক সাপোর্ট প্রদান করতে পারে।
এছাড়া, সরকার চাইলে তাদেরকে কাজে লাগাতে পারে মানুষকে সচেতন করার ব্যাপারে এবং প্রাতিষ্ঠানিক/স্থানীয়ভাবে হ্যান্ড সেনিটাইজার তৈরি করতে। তারপর সেগুলো সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল, স্কুল কলেজ ও আপামর জনসাধারণের মাঝে বিতরণের করতে পারে। এ ক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধি, বিশেষকরে ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পরিষদ এর সম্মানিত সদস্যদের মাধ্যমে বিতরণ ও জনসচেতনতা বাড়াতে পারে।
সাবান ব্যবহারেও গুরুত্ব দিন:
সবশেষে সাবান ব্যবহারের উপরও গুরুত্ব দিতে বলেন শাবির এ অধ্যাপক। কেননা, সাবানের মাধ্যমে হাত থেকে অনেক কঠিন ময়লা (তৈল ও গ্রীজ জাতীয়) ও রোগজীবাণু দূর হয়। আর হ্যান্ড স্যানিটাইজারের মাধ্যমে ময়লামুক্ত হাতের রোগজীবাণু দূর হয়। তাছাড়া, যেখানে সাবান ও হ্যান্ড স্যনিটাইজার এর সরবরাহ সীমিত সেখানে লেবুর রস মিশ্রিত পানি হাত ধোঁয়ার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। আরো ভালো হয় হালকা গরম পানির সাথে লেবুর রস মিশিয়ে হাত ধৌত করতে পারলে। লেবুর রস দুর্বল এসিড, যা এন্টিব্যাক্টেরিয়া ও জীবাণুনাশক হিসাবে ভালো কাজ করে। তাছাড়া হালকা গরম পানিতে লেবুর রস হাত হতে তৈলাক্ত পদার্থ দূর করতেও সহায়তা করে।
ইত্তেফাক/বিএএফ