বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

এমসি কলেজ ঘিরে অপরাধী সিন্ডিকেট

আপডেট : ০২ অক্টোবর ২০২০, ০১:৪৭

সিলেটের এমসি কলেজ ও আশপাশের এলাকায় অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিল ধর্ষণকাণ্ডে গ্রেফতার হওয়া ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত বখাটে তরুণরা। কলেজ ঘিরে গড়ে তোলা হয়েছিল অপরাধ সিন্ডিকেট। গত এক দশকে ঐ এলাকায় আধিপত্য নিয়ে কোন্দলে খুন হয়েছেন অন্তত পাঁচ ছাত্রলীগ কর্মী। বান্ধবী বা স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে কেউ ক্যাম্পাসে বেড়াতে গেলে এই বখাটেদের হাতে লাঞ্ছিত হতে হয়েছে।

এমনকি কোনো তরুণীর বন্ধু প্রতিবাদ করলে ঐ তরুণীকে গণধর্ষণও করেছে গ্রুপটি। আর বেড়াতে আসা অতিথিদের কাছ থেকে ছিনতাই, লুট ও মারধরের ঘটনা ছিল নিয়মিত। স্থানীয় কয়েক জন আওয়ামী লীগ নেতা নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতে এদের নিয়মিত ব্যবহার করেছেন। আর এই সুযোগে দিনের পর দিন অপকর্ম করেও পার পেয়ে গেছে সাইফুর বাহিনী। এই সাইফুর বাহিনীই গত ২৫ সেপ্টেম্বর রাতে স্বামীকে বেঁধে রেখে কলেজ ছাত্রাবাসে নিয়ে নববধূকে দলবেঁধে ধর্ষণ করে। এ ঘটনায় সাইফুরসহ আট অভিযুক্ত গ্রেফতার হয়ে এখন রিমান্ডে রয়েছে।

সরেজমিনে জানা গেছে, এমসি কলেজের আশপাশে ছাত্রলীগ-যুবলীগের ব্যানারে গড়ে উঠেছে অপরাধ সিন্ডিকেট। চাঁদাবাজি, ছিনতাই, অপহরণ, নারী লাঞ্ছনার ঘটনা প্রায়ই ঘটে ঐ এলাকায়। সম্প্রতি জগন্নাথপুরের এক তরুণ তার দূরসম্পর্কের বোনকে নিয়ে এমসি কলেজের বাংলোর পেছনে গিয়ে বসেন। এমন সময় সাইফুর চক্রের সদস্যরা তাদের দেখে অসামাজিক কাজের অভিযোগ তুলে ঐ তরুণ-তরুণীর ছবি তোলে। এরপর ছেলেটিকে বেঁধে তরুণীকে গণধর্ষণ করে। টাকাও নেয় তরুণীর কাছ থেকে। শুধু এই ঘটনাই নয়, খোদ এমসি কলেজের ভেতরে এ ধরনের বহু ঘটনা ঘটেছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। এক তরুণীকে ধর্ষণের অভিযোগে এমসি কলেজের গার্ড মাইকেলকে ক্যাম্পাসেই গণধোলাই দেওয়া হয়েছিল। সাইফুর-রনি সিন্ডিকেটের হয়ে কাজ করত মাইকেল। কেউ ক্যাম্পাসে গেলেই মাইকেল খবর দিত ঐ সিন্ডিকেটকে। এক শিক্ষার্থী ওদের হাতে লাঞ্ছিত হয়ে কলেজই ছেড়ে দেয়। গত পাঁচ বছরে ক্যাম্পাসের পেছনের টিলায় অন্তত ১০টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। অনেক ঘটনাই প্রশাসন জানত। কিন্তু তারা কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারত না। ওদের কাছে জিম্মি ছিল কলেজ প্রশাসন।

স্থানীয়রা জানান, এসব ঘটনার অনেকটাই চাপা পড়ে গেছে মান-ইজ্জতের ভয়ে। বিচার হয় না বলে অনেকে থানা পর্যন্ত যান না। এলাকাবাসীর অভিযোগ, এসবের নেপথ্যে আওয়ামী লীগের দুই নেতা কাউন্সিলর আজাদুর রহমান আজাদ ও রনজিত সরকার। দুজন দুই মেরুর হলেও ব্যক্তিস্বার্থে তারা অভিন্ন। তবে সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক রনজিত সরকার বলেন, ‘২০ বছর আগে ছাত্র রাজনীতি ছেড়েছি। তার পরও আমাকে জড়িয়ে বিভিন্ন সময়ে যেসব অভিযোগ তোলা হয়, তার কোনোটি সত্য নয়।’ আওয়ামী লীগের সাবেক শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক ও কাউন্সিলর আজাদুর রহমান আজাদ বলেন, ‘ছাত্রলীগ আমি নিয়ন্ত্রণ করি না।’ তাকে নিয়ে এসব বিষয়ে না লেখার জন্য তিনি বিবৃতিও দিয়েছেন বলে জানান।

অর্জুনের ফ্ল্যাটে অপরাধের আখড়া

এমসি কলেজের টিলাগড় গেট থেকে ২০০ গজ দূরে সুরভী নামের একটি পাঁচতলা ভবনের চতুর্থ তলায় ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকতেন বখাটেদের একজন অর্জুন লস্কর। এই ফ্ল্যাট ছিল বখাটেদের অন্যতম আড্ডাস্থল। কখনো জোর করে, কখনো ভাড়া করে নারীদের এই ফ্ল্যাটে নিয়ে জলসার আয়োজন করা হতো। এই জলসার মধ্যমণি থাকতেন সাইফুর। গতকাল সরেজমিন ঐ ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখা গেছে, রুমটি খোলা রয়েছে। তোশক-বালিশ নিচে পড়ে রয়েছে। এই ফ্ল্যাটকে কেন্দ্র করে সাইফুরের নেতৃত্বে তরুণদের একটি গ্যাং তৈরি হয়েছিল। এই চক্রের হাতে একাধিক আগ্নেয়াস্ত্র থাকার তথ্যও মিলেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনুসন্ধানে।

জানা গেছে, এই ফ্ল্যাট অর্জুন ভাড়া নিলেও তার গ্যাংয়ের সদস্যরাই নিজেদের মতো করে ব্যবহার করত। ফ্ল্যাটের চাবিও থাকত সামনের একটি দোকানে। যখন যার প্রয়োজন সে নিয়ে ব্যবহার করত। বাড়িটির মালিক একজন প্রবাসী বৃদ্ধ। গতকাল ঐ ভবনের একাধিক বাসিন্দা আলাপকালে জানালেন, প্রায়ই জিন্স প্যান্ট পরা অপরিচিত নারীদের আনাগোনা ছিল এই ফ্ল্যাটে। মাঝেমধ্যেই চিত্কার চেঁচামেচির শব্দ ভেসে আসত। এমনকি রাতেও তারা উচ্চ আওয়াজে গান ছেড়ে নৃত্য করত। তারা এতটাই প্রভাবশলী ছিল যে, তাদের ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করতে সাহস পেত না।

তিন মাস আগে বিয়ে হয় ঐ তরুণীর

বুধবার সরেজমিনে ভুক্তভোগী তরুণীর ওসমানীনগর উপজেলার তাজপুর ইউনিয়নের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে তার মায়ের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। মেয়ের ঘটনা নিয়ে পরিবারের কেউ কোনো কথা বলতে রাজি নন। তাদের ভাষ্য, জামাই বিষয়টি দেখছে, তিনিই সব বলবেন। আমাদের কিছু বলতে নিষেধ করেছে। তিন মাস আগে গত ২০ জুলাই ৬ লাখ টাকা দেনমোহরে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। সম্পর্ক থেকে বিয়ে হওয়ায় মেয়ে বিয়ের পরও এই বাড়িতেই থাকতেন। তবে তরুণীর স্বামীর বাবা এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ছেলের বিয়ের কোনো খবর তিনি জানেন না। ছেলের সঙ্গে তিন মাস ধরে কোনো ধরনের যোগাযোগ নেই। এমনকি তার ছেলের বউ হিসেবে যে তরুণীর ধর্ষিত হওয়ার কথা বলা হচ্ছে ঐ তরুণীকে তারা কখনো দেখেননি।

এ প্রতিবেদকের সঙ্গে বেশ কয়েক জন এলাকাবাসীর কথা হয়। তারা জানান, ঐ তরুণী পার্শ্ববর্তী বলাগঞ্জ চান্দাইপাড়া মাদ্রাসায় দাখিল শেষ করে তাজপুর ডিগ্রি কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছেন। ধর্ষকদের মূল হোতা সাইফুরের বাড়িও চান্দাইপাড়া। সেখানেই তাদের পরিচয় হয় বলে একাধিক ব্যক্তি ইত্তেফাককে নিশ্চিত করেছেন। তবে খুব বেশি সখ্য তাদের ছিল না। ধর্ষিতার সম্পর্কেও তার এলাকার কেউ খুব ভালো কিছু বলেননি। একটু উচ্ছৃঙ্খল প্রকৃতির এই তরুণীকে মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন ছেলের সঙ্গে দেখেছেন এলাকার মানুষ। তরুণী সম্পর্কে জানতে চাইলে তাজপুর ডিগ্রি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মনু মিয়া ইত্তেফাককে বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে মেয়েটিকে চিনি না। কাগজপত্রে দেখলাম আমার কলেজের শিক্ষার্থী।’

ধর্ষকদের সঙ্গে তরুণীর আগেই পরিচয় ছিল!

অনুসন্ধানকালে বেশ কিছু সিসিটিভির ফুটেজ, অডিও ক্লিপসহ অন্যান্য তথ্য-প্রমাণ ইত্তেফাকের হাতে এসেছে। সেগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ঘটনার দিন ভুক্তভোগী গৃহবধূর সঙ্গে ধর্ষকদের অন্যতম আইনুদ্দিনের ২৭ বার কথা হয়েছে। বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে ঐ তরুণী আইনুদ্দিন ও রাজনের সঙ্গে অর্জুনের ফ্ল্যাটে অবস্থান করেছেন। তখন ঐ তরুণীর স্বামী ভবনের নিচে গাড়িতে বসে ছিলেন। যা সিসিটিভির ফুটেজেও দেখা গেছে। ঐ ফ্ল্যাটে দেড় ঘণ্টা অবস্থানের পর খবর পেয়ে সাইফুর সেখানে যায়। এরপর তরুণী জরুরি কাজের কথা বলে বেরিয়ে যেতে চাইলে ঝামেলা শুরু হয়। এক পর্যায়ে তরুণী নেমে স্বামীর সঙ্গে গাড়িতে করে চলে যান। কিন্তু ক্ষমতাধর সাইফুর এটা মেনে নিতে পারেনি। সে সঙ্গে সঙ্গে হোস্টেলে ফোন করে তার বাহিনীর সদস্যদের এমসি কলেজের গেটে আসতে বলে। সেখানেই আটকে সাইফুরের ক্যাডাররা তরুণীকে গাড়িতে করে হোস্টেলের দিকে নিয়ে যায়। তার স্বামীকে মারধর করে বাইরে এনে পেটাতে থাকে। এক পর্যায়ে হোস্টেলের সামনে গাড়িতেই সাইফুর আর অর্জুন ঐ তরুণীকে ধর্ষণ করে। এমনকি অর্জুনের ফ্ল্যাট থেকে পাওয়া সাড়ে ৫ হাজার টাকাও তরুণীর কাছ থেকে কেড়ে নেয়। এরপরও তারা ক্ষান্ত হয়নি। গাড়ি আটকে রেখে তরুণীর স্বামীর কাছে ৫০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে। এরপর তরুণীর স্বামী তার এক বন্ধুকে ফোনে ঘটনা জানায়। সেই বন্ধুই শাহ পরান থানার ওসিকে ফোন করে বিষয়টি অবহিত করে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে শাহ পরান থানার ওসি আব্দুল কাইয়ুম ইত্তেফাককে বলেন, ‘আমাদের কথা বলতে নিষেধ করা হয়েছে।’

এক দশকে ৫ খুন

গত ৬ ফেব্রুয়ারি নগরীর টিলাগড় এলাকায় চাঁদার ভাগাভাগি নিয়ে খুন হন বেসরকারি গ্রিনহিল স্টেট কলেজের শিক্ষার্থী ছাত্রলীগ কর্মী অভিষেক দে (দ্বীপ)। ২০১৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর নগরীর শিবগঞ্জে ফোন করে ডেকে এনে ছাত্রলীগ কর্মী জাকারিয়া মোহাম্মদ মাসুমকে খুন করা হয়। একই বছরের ১৬ অক্টোবর টিলাগড়ে খুন হন আরেক ছাত্রলীগ কর্মী ওমর মিয়াদ। তিন মাসের মধ্যে ২০১৮ সালের ৭ জানুয়ারি টিলাগড়ে ছাত্রলীগ কর্মী তানিম খানকে খুন করা হয়। ২০১০ সালের ১২ জুলাই টিলাগড়ে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে খুন হন উদয়ন সিংহ পলাশ। এমসি কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র পলাশ হত্যাকাণ্ডের ১০ বছর পরও বিচার শেষ হয়নি।

টিলাগড় এলাকার ব্যবসায়ীরা বলেন, একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে তারা পার পেয়েছে। সবাই তাদের সঙ্গে মানিয়ে চলতে অভ্যস্ত। কোনো বিচার হয় না, বড় ঘটনা ঘটলে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর তত্পরতা দেখা যায়। কিছুদিন পর সব ঠান্ডা। তারা জানান, আইনশৃঙ্খলার লোকজনকেও তাদের সঙ্গে মাঝেমধ্যে চলতে দেখা যায়।

ইত্তেফাক/জেডএইচ