মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

জবিতে নিয়োগে স্বজনপ্রীতির বলয়

আপডেট : ২১ এপ্রিল ২০২১, ০০:১১

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) অসংখ্য শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মাঝে আত্মীয়তার ও স্বজনপ্রীতির সম্পর্ক দেখা গেছে। তাদের কারো স্ত্রী, কারো ভাই, কারো ভাতিজা, কারো ভাগ্নে, কারো বোনজামাই, কারো শ্যালিকা বা কারো দেবর একসাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করছেন। 

স্বজনদের কোন একজন বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পেলে পরের জনের চাকরি পেতে সহজ হয়ে যায়। এতে স্বজনের লিংক-লবিং, প্রভাব ও অর্থ বড় ধরনের সহায়তা করে বলে জানা যায়। এই নিয়োগের অধিকাংশই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. মীজানুর রহমানের দুই মেয়াদের মধ্যে নিয়োগপ্রাপ্ত। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ ও বিভিন্ন দপ্তরের কর্মযজ্ঞে স্বজনপ্রীতির এক বলয় গড়ে উঠেছে।

মনোবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. অশোক কুমার সাহার স্ত্রী উজ্জলা সাহা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা, উন্নয়ন ও ওয়ার্কস দপ্তরের ৩য় শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে কর্মরত আছেন। 

অন্যদিকে কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. উজ্জ্বল কুমার আচার্যের স্ত্রী গত সিন্ডিকেটে (সাবেক ভিসি ড. মীজানের শেষ সিন্ডিকেট) ৩য় শ্রেণি থেকে পদন্নোতি পেয়ে কর্মকর্তা হিসেবে রেজিস্ট্রার দপ্তরের কর্মরত আছেন। এছাড়া লাইফ এন্ড আর্থ সায়েন্স অনুষদের ডীন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সাইফুল ইসলামের স্ত্রী সহকারী রেজিস্ট্রার দিলরুবা বেগম কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে কর্মরত আছেন। বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শামীম আরার দেবর সাইফুল আলম রেজিস্ট্রার দপ্তরে সহকারী রেজিস্ট্রার হিসেবে কর্মরত।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট কর্মকর্তার সংখ্যা ২১২ জন। এর মধ্যে প্রায় সত্তরোধিক কর্মকর্তার সাথে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সাথে রক্তের বা আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে। প্রকৌশল দপ্তরের উপপ্রধান প্রকৌশলী সুকুমার চন্দ্র সাহার ভাগিনা নির্বাহী প্রকৌশলী অপূর্ব কুমার সাহা, ডেপুটি রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ জাহিদ আলমের স্ত্রী কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের ডেপুটি রেজিস্ট্রার আশরা-উন-আক্তার-তুহিন, ডেপুটি রেজিস্ট্রার মশিরুল ইসলামের স্ত্রী (ছনিয়া) প্লানিং এ কর্মচারী, ডেপুটি রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামানের স্ত্রী কর্মচারী হিসেবে, আইটি সেলের কম্পিউটার প্রোগ্রামার হাফিজুর রহমানের শালিকা (হাসিনা), সহকারী রেজিস্ট্রার রিফাত আলী খানের স্ত্রী ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের কর্মচারী, সহকারী রেজিস্ট্রার জামাল হোসেনের ভাই আবুল হোসেন ইংরেজি বিভাগের কর্মচারী, সহকারী রেজিস্ট্রার জাহাঙ্গীর আলমের ভাই নুর ইসলাম ভিসি দপ্তরে, কর্মকর্তা সমিতির সভাপতি সহকারী রেজিস্ট্রার কামাল হোসেন সরকারের ভাই জামাল হোসেন গণিত বিভাগের কর্মচারী, পরিবহনের প্রকৌশলী আজিজুর রহমানের ভাই প্রকৌশল দপ্তরের প্রকৌশলী আনিছুর রহমান, সহকারী লাইব্রেরিয়ান লায়লা আক্তারের স্বামী সহকারী রেজিস্ট্রার খসরু আলম, আইটি দপ্তরের নাজমুল হাসানের ভাই মাহবুব গণিতের কর্মচারী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের উত্তম কুমারের ভাই দিলিপ কুমার ট্রেজারার দপ্তরে পিওন ও রিদয় পরিবহন পুলের হেলপার, সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মাকসুদুর রহমানের ভাই কুদ্দুস অর্থ দপ্তরের কর্মচারী, একই দপ্তরের আবু ইমরানের ভাই এহসান মাইক্রোবায়োলজির কর্মচারী ও সুজন রায়ের স্ত্রী ভূমি ও ব্যবস্থাপনা আইনে কর্মচারী হিসেবে কর্মরত আছেন।

এছাড়া সেকশন অফিসার আইনুন নাহারের বোন ও মেডিক্যালের টেকনিশিয়ানের স্ত্রী কর্মচারী হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত রয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সহায়ক কর্মচারী সমিতির (৪র্থ শ্রেণি) সভাপতি আবু সাঈদ দর্শন বিভাগে কর্মরত। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়েই তার বাবা, বোনজামাই চাকরি করে গেছেন। এখন করছেন আরেক বোন জামাই, তিন ভাগিনাসহ তিনি। প্রক্টর দপ্তরের সহায়ক কর্মচারী হাসান আলীর আপন ভাই, চাচাতো ভাই দুইজন, শালিকাসহ নিজ এলাকা চাঁদপুরের মতলবের আত্মীয়ের সম্পর্কের আছেন আরও অনেকে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কর্মচারী ইলিয়াসের স্ত্রী, রেজিস্ট্রার দপ্তরের কর্মচারী মোতাহারের ভাগনি দুইজনই রেজিস্ট্রার দপ্তরের কর্মচারী। ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারিদের থেকে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শতকরা ৮০-৯০ ভাগ কর্মচারিই কারো না কারোর আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে। সম্পর্কের জেরেই বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত। আর জবিতে কর্মচারিদের নিয়োগে বেশির ভাগ কুমিল্লা, চাঁদপুর এলাকা থেকে। কারণ দীর্ঘ ১০ বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কুমিল্লা থেকে নিয়োগ পাওয়ায় কর্মচারী নিয়োগে এলাকাপ্রীতি হয়েছে বলে বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র থেকে জানা যায়।

এবিষয়ে কর্মকর্তা সমিতির সভাপতি কামাল হোসেন সরকার বলেন, ‘অনেকে অনেক ভাবে চাকরি পায়। অনেকে দীর্ঘদিন চাকরি করে চলে যাওয়ার সময় তার আত্মীয় বা সন্তানদের দিয়ে যান। তবে আমি অনেস্টলি বলছি। আমার ছোট ভাই ৪ বছর ধরে গণিত বিভাগের কর্মচারী হিসেবে আছে। নিয়োগের সময় তার জন্য আমি সাবেক ভিসি মীজান স্যারকে রিকুয়েস্ট করেছিলাম। উনি চাকরি দিয়েছিলেন। আমি চাইলে আরও নিয়োগ দিতে পারতাম কিন্তু করিনি।’

এবিষয়ে সহায়ক কর্মচারী সমিতির সভাপতি আবু সাঈদ বলেন, ‘আত্মীয়তার সম্পর্কে নিয়োগ এটা শুধু আমার না। প্রায় সকল কর্মচারিই এভাবে নিয়োগ পায়।’ সব বিশ্ববিদ্যালয়েই কর্মচারি নিয়োগ এমন হয় বলে তিনি দাবি করেন। 

এবিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার প্রকৌশলী মো. ওহিদুজ্জামান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে কে কার স্বজন এটা তো আমার জানা নেই। নিয়োগ দেন উপাচার্য। নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বজনদের কোন লবিং আছে কিনা আমার জানা নেই।’

ইত্তেফাক/এএএম