শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

চবির উপাচার্য পদের জন্য ‘দৌড়ঝাপ’

আপডেট : ২২ মে ২০১৯, ২০:৫৪

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন উপাচার্যের পদে যেতে ‘দৌড়ঝাপ’  শুরু করেছে প্রার্থীরা। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের নজরে আসতে তারা এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন। অন্তত চার জন প্রার্থী এ পদে যেতে শুরু করেছেন বিভিন্ন তদবীর। আগামী ১৫ জুন বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যে মেয়াদ শেষ হতে যাচ্ছে।

জানা গেছে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে যেতে চান বর্তমান উপ উপাচার্য প্রফেসর ড. শিরীণ আখতার, ব্যাংকিং বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. সুলতান আহমদ, কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. সেকান্দর চৌধুরী। এছাড়া বর্তমান উপাচার্য ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরীর দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্বপালনের আগ্রহ রয়েছে। এ শিক্ষকদের কারো বিরুদ্ধে রয়েছে নিয়োগ নিয়ে প্রভাবখাটানোর অভিযোগ। কারও কারও একাডেমিক রেজাল্ট নিয়ে রয়েছে সমালোচনা। শিক্ষাজীবনের চারটি গুরুত্বপূর্ণ স্তরে কারও রয়েছে চারটিই দ্বিতীয় শ্রেণী। আবার কারও রয়েছে তিনটি দ্বিতীয় শ্রেণী।

উপ উপাচার্য প্রফেসর ড. শিরীণ

চবির বর্তমান উপ উপাচার্য প্রফেসর ড. শিরীণ আখতারের বাড়ি কক্সবাজার জেলায়। কক্সবাজার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করা শিরীণ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। তিনি এইচএসসি পাশ চট্টগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজ থেকে। চট্টগ্রাম সরকারী কলেজ থেকে স্নাতক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শেষ করেছেন স্নাতকত্তর। শিক্ষাজীবনের এ চারটি স্তরে তার রয়েছে দ্বিতীয় শ্রেণী। তবে ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি পিএইচডি ডিগ্রী করেছেন। বর্তমানে উপাচার্য হওয়ার জন্য আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের কাছে ছুটছেন তিনি।

তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে , বিশ্ববিদ্যালয়ে গত তিন বছর উপ উপাচার্য পদে দায়িত্বপালনের আগে বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট বড় কোনো দায়িত্ব তাকে পালন করতে হয়নি। ফলে প্রশাসনিক নানা বিষয়ে তার অভিজ্ঞতার ঘাটতি রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গবন্ধু চেয়ারের নীতিমালাসহ এ পদে বর্তমান উপাচার্যকে বঙ্গবন্ধু গবেষণা কেন্দ্র নির্বাহী কমিটি কর্তৃক নিয়োগ প্রদানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে আওয়ামী লীগের উচ্চ পর্যায়ে সমালোচনার মুখে পড়েন উপ উপাচার্য। যদিও পরবর্তীতে সর্বশেষ সিন্ডিকেটে বঙ্গবন্ধু চেয়ার অনুমোদনের সময় তিনি এ বিষয়ে আর কোনো আপত্তি তুলেননি। এছাড়াও শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগেও তিনি প্রভাব খাটিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। 

এছাড়াও তিনি তার পিএইডি ছাত্র কাইছার উদ্দিন নামে এক শিবির নেতাকে বাংলা বিভাগে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে সুপারিশ করেছেন। তার আত্মীয় দিলশাত জাহান, তার পিএস মোহাম্মদ ইউনুচের স্ত্রী এবং বাংলা বিভাগের পিয়ন আলীর মেয়েকে নিয়োগ দিয়েছেন তিনি। এসব অভিযোগ বিষয়ে প্রফেসর ড. শিরীণ বলেন, 'কায়সার শিবির নেতা নয়। এগুলো সব মিথ্যা কথা। আমার কথায় মাস্টাররোলে আলীর মেয়েকে চাকরি দিয়েছেন ভিসি স্যার। দিলশাত আমার গ্রামের। প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেয়ে। তিন বছরে আমার রেফারেন্সে শুধুমাত্র দুই জনের চাকরি হয়েছে। ওরাতো পয়সা দিতে পারবেনা। গরীব মানুষ বলে আমি চাকরি দিয়েছি।' 

এ বিষয়ে কক্সবাজার জেলা পেকুয়া উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও বর্তমান জেলা ছাত্রলীগের সদস্য সালাউদ্দিন মাহমুদ বলেন, 'কায়সার একজন চিহ্নিত শিবির নেতা। তার পরিবারের সকলেই বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতিতে সক্রিয়।'

আরও পড়ুন:  এবার সৌদি বিমানঘাঁটিতে হুতিদের ড্রোন হামলা

প্রফেসর ড. সুলতান আহমেদে

প্রফেসর ড. সুলতান আহমেদের বাড়ি চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলায়। রাউজান আর আর এ সি আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে তিনি প্রথম বিভাগে এসএসসি পাশ করেন। দ্বিতীয় বিভাগ নিয়ে এইচএসসি পাশ করেন ফটিকছড়ি মহাবিদ্যালয় থেকে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণী নিয়ে বিকম ও এমকম পাশ করেন তিনি। পিএইচডি করেছেন ভারতের কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।

প্রফেসর ড. সুলতান আহমেদ দীর্ঘ ১২ বছর দায়িত্ব পালন করেছেন শাহ জালাল হলের প্রভোস্ট হিসেবে। সাবেক উপাচার্য প্রফেসর আনোয়ারুল আজিম আরিফের ঘনিষ্ঠ প্রফেসর সুলতান প্রভোস্ট ক্যাটাগরিতে ছিলেন সিন্ডিকেট সদস্যও। তিনি বর্তমানে ব্যাংকিং বিভাগের চেয়ারম্যান। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল উপাচার্যের সময়েই প্রভাব বিস্তারকারী হিসেবে পরিচিত। তার কথায় শিক্ষক, কর্মচারী নিয়োগ দিতে হয় উপাচার্যদের। বিগত তিন উপাচার্যের সময়ে তার আপন ভাইসহ অনন্ত ১২ জন নিকটাত্মীয় ও তার গ্রামের লোকের চাকরি দিয়েছেন তিনি। তার সুপারিশ ছাড়া বিবিএ অনুষদের শিক্ষক নিয়োগ হয় না বলেও প্রচার রয়েছে।

তার হাতে নিয়োগ হওয়াদের মধ্যে রয়েছে, তার আপন ভাই কামরুল, তার শ্বশুড় বাড়ির আত্মীয় সেলিম, চার চাচাতো ভাই নাছির, জসিম, মাহবুব, এয়ার মোহাম্মদ, তার গ্রামের আত্মীয় মোহাম্মদ রাশেদ, ওসমান গণি, নাঈমুদ্দিন। সম্প্রতি নিয়োগ দিয়েছেন ব্যাংকিং বিভাগের উচ্চমান সহকারী আরাফাতুল করিমকে। তিনি তার ভাতিজা হিসেবেই পরিচিত। এদের সকলের বাড়িই ড. সুলতানের গ্রাম রাউজানের হিংগলায়। সম্প্রতি ছাত্রলীগ নিয়োগ বাণিজ্য ও প্রভোস্টের দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ তুলে। তাকে এ পদ থেকে অপসারণের দাবি তুলে। ছাত্রলীগের চাপের মুখে বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য তাকে প্রভোস্টের পদ থেকে বরখাস্ত করেন।

ভিসি প্রার্থী কি-না জানতে চাইলে ড. সুলতান বলেন, 'আমি এ পদের যোগ্য কিনা তা সরকারই ভাল জানবে। যদি সরকার দায়িত্ব দেয়, তাহলে আমি কেন পারব না? অবশ্যই পারবো। আমার বাড়ির কাছের বিশ্ববিদ্যালয় এটি। ১২ বছর প্রভোস্টে দায়িত্বে থেকে পাঁচ জনের চাকরি দিলে তা কি পার্শিয়ালিটি হবে? আমি যখন একাউন্টিং বিভাগের চেয়ারম্যান তখন একটা নিয়োগ দিলাম চাঁদপুরের, অন্যজন দিলাম মুন্সিগঞ্জের। শুধু যে রাউজানের লোক নিয়োগ দিয়েছি তা সত্য নয়। আমার ভাই মাস্টার্স ডিগ্রী পাশ করা। তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেনির একটি চাকরি দেওয়া হয়েছে। তাকে বড় আরো বড় পদ দেওয়া যেতো।'

প্রফেসর ড. সেকান্দর চৌধুরী

প্রফেসর ড. সেকান্দর চৌধুরীও সাবেক উপাচার্য আনোয়ারুল আজিম আরিফের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার সন্তান সেকান্দর চৌধুরী এসএসসি পাশ করেছেন বেতাগী ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। কানুনগোপাড়া স্যার আশুতোষ মহাবিদ্যালয় থেকে করেছেন এইচএসসি পাশ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ থেকে করেছেন বি এ (সম্মান)। তবে তার এ তিনটি পর্যায়ে ফলাফল দ্বিতীয় শ্রেণী। একই বিভাগের ১৯৮১-১৯৮২ শিক্ষাবর্ষে প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়ে মাস্টার্স শেষ করেছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিয়েছেন পিএইচডি ডিগ্রী। বি

শ্ববিদ্যালয়ের তিনি ইসলামের ইতিহাস বিভাগের এ অধ্যাপক বর্তমানে কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ডিন। তিনিও আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে বিভিন্ন উপাচার্যের সময়ে নিয়োগ নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বর্তমানে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য অথবা উপ উপাচার্য যে কোনো একটি পদে নিয়োগ পেতে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের নজরে আসার চেষ্টা করছেন। 

আরও পড়ুন:  ‘অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা ক‌রে নতুন শিল্পনী‌তি প্রণয়ন করা হবে’

নির্বিচারে ছাত্রলীগ নিয়োগের অভিযোগ বর্তমান উপাচার্য ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরীর বিরুদ্ধে

চট্টগ্রাম নগরীর উত্তর কাট্টলী এলাকায় বেড়ে ওঠা প্রফেসর ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরীর। ১৯৭০ সালে কুমিল্লা বোর্ডের অধীনে প্রথম বিভাগে এসএসসি পাশ করেছেন তিনি। প্রথম বিভাগ নিয়ে এইচএসসিও পাশ করেছেন একই বোর্ড থেকে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিয়েছে দ্বিতীয় বিভাগে বি এ ডিগ্রী। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় বিভাগ নিয়ে অর্জন করেছেন এলএলবি ডিগ্রীও। ১৯৮২ সালে চবি সমাজতত্ত্ব বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়েছে মাস্টার্স কোর্সে। ১৯৮৩ সালে জাপানের ওসাকা ইউনিভার্সিটি থেকে নিয়েছেন উচ্চতর ডিগ্রী। এরপরই পিএইচডি করেছেন তিনি জাপানের সুকুবা ইউনিভার্সিটি থেকে। আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি (বার্কেল) থেকে করেছে দ্বিতীয় পিএইচডি (পোস্ট ডক্টরেট)।

তার বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ, তিনি নির্বিচারে ছাত্রলীগ নিয়োগ দিয়েছেন। গত চার বছরে প্রায় ৭০ জন ছাত্রলীগের বিভিন্ন পদধারী নেতাকর্মীদের তিনি শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে বিভিন্ন অপরাধের ঘটনায় মামলা। ছাত্রজীবনে সংঘর্ষ, হামলার ঘটনায় অনেকে হয়েছেন বহিস্কার, গ্রেফতার। নির্ধারিত যোগ্যতার নূন্যতম পূরণ করে আবেদন করেই তার আমলে শিক্ষক হয়ে গেছেন ছাত্রলীগের অন্তত ২০ জন নেতাকর্মী। চবি ছাত্রলীগের অর্ধশতাধিক নেতাকর্মীকে বিভিন্নভাবে তিনি চাকরি দিয়েছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চবি উপাচার্য প্রফেসর ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, 'ছাত্রলীগের কেউ যদি যোগ্য হয়, নিয়োগ বোর্ডের পরীক্ষায় যদি উত্তীর্ণ হয় তাহলে তাকে নিয়োগ দেওয়া কি অপরাধ? বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগবিধি মেনেই সকল শিক্ষক, কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। উপাচার্যের মেয়াদ শেষ হওয়ায় আমার বিরুদ্ধে এ ধরণের অবান্তর অভিযোগ তোলা হচ্ছে।'

ইত্তেফাক/জেডএইচডি