শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

‘জ্ঞান বিতরণের প্রক্রিয়াকে আরো গতিশীল করতে সব পদক্ষেপ নেব’

আপডেট : ১৪ জুন ২০১৯, ১৫:০৩

২০১৭ সালের ১৪ জুন রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) চতুর্থ উপাচার্য হিসেবে যোগদান করেন প্রফেসর ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ, বিএনসিসিও। সেই হিসেবে আজ দুই বছর অতিবাহিত করছেন বর্তমান উপাচার্য। কেমন চলছে বিশ্ববিদ্যালয়? ভৌত অবকাঠামো, শিক্ষা, গবেষণা প্রভৃতি ক্ষেত্রে কী উন্নয়ন করেছেন এবং ভবিষ্যতে কী করতে চান এসব বিষয়ে কথা বলেছেন উপাচার্য। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন দৈনিক ইত্তেফাকের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় (বেরোবি) সংবাদদাতা মোবাশ্বের আহমেদ।

 

 

ইত্তেফাক :  আজ ১৪ জুন, আপনার বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়েরে উপাচার্য হিসেবে যোগদানের দুই বছর পূর্ণ হলো। এ সময়ে আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য উল্লেখযোগ্য কী কী কাজ করেছেন? আগামীতে আর কী কী করতে চান বলবেন কি?

 

ড. কলিমউল্লাহ :  উপাচার্য হিসেবে আমি যোগদানের পর থেকে গত দুই বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ, শিক্ষা, গবেষণা প্রভৃতি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপকল্পকে বাস্তবায়িত করতে এবং জিজিটাল তথ্য আহরণকে সহজলভ্য করতে আমি পুরো ক্যাম্পাসকে ওয়াই-ফাই ইন্টারনেট প্রযুক্তির আওতায় এনেছি। আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সকে উৎসাহিত করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ১০টি রোবোর্ট আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সকল ধরনের কেনা-কাটায় স্বচ্ছতা আনয়নে ই-টেন্ডার ও ই-প্রকিউরমেন্ট পদ্ধতি চালু করেছি। অচিরেই ই-ফাইলিং চালু করা হবে। আমি অচল ভার্চুয়াল ক্লাশরুম সচল করেছি। 

 

শিক্ষক-কর্মকর্তাদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বাংলাদেশে প্রথম ওয়াই-ফাই ও স্মার্ট টেলিভিশনসহ দুটি ৫২ সিটের বাস শিক্ষার্থীদের জন্য দেয়া হয়েছে। আরো দুটি বাস কেনা প্রক্রিয়াধীন। এছাড়া কেনা হয়েছে তিনটি মাইক্রোবাস। 

 

আমি আসার পর থেকে এ পর্যন্ত দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ১৩টি শিক্ষা ও গবেষণা বিষয়ক সমঝোতা স্বারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। ইনস্টিটিউট অব কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স সেলকে পূর্ণগঠন করে কার্যকর করা হয়েছে। ড. ওয়াজেদ রিসার্চ ও ট্রেনিং ইনন্সিটিউটে এমফিল ও পিএইচডি প্রোগ্রাম পূণরায় চালু করা হয়েছে। আর বিভিন্ন বিভাগেও এমফিল ও পিএইচডি এবং সান্ধ্যকালীন কোর্স-এর বিধান আমার সময়ই প্রথম অনুমোদিত হয়। গ্রন্থাগার ও মেডিক্যাল সেন্টারের সেবা ঘণ্টা বাড়ানো হয়েছে। ২৫ লাখ টাকার নতুন বই কেনা হয়েছে ও শিক্ষার্থীদের জন্য সান্ধ্যকালীন বাস দেয়া হয়েছে।

 

ইত্তেফাক : আপনি যোগদানের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় শতাধিক সভা-সেমিনার আয়োজনসহ ৫৪টি জার্নাল প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে যা বিভিন্ন মহলে বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছে। আপনি এসব অব্যাহত রাখতে পারবেন বলে মনে করেন কি?

 

ড. কলিমউল্লাহ : বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে প্রায় দুইশ’রও বেশি সেমিনার/সিম্পোজিয়াম আয়োজন করা হয়েছে। ২৭টি বাংলা ও ২৭টি ইংরেজি ভাষায় মোট ৫৪টি জার্নাল প্রকাশের উদ্যোগ বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ইতিহাসে প্রথম। ইতোমধ্যে সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, জনপ্রশাসন ও দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে জার্নাল নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হতে শুরু করেছে। জ্ঞান বিতরণের এসব প্রক্রিয়া শুধু অব্যাহত রাখা নয় তা আরো গতিশীল করতে সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করবো।

 

ইত্তেফাক :  আপনি যোগদানের পরপরই ক্যাম্পাস রেডিও, ক্যাম্পাস টেলিভিশন, জাতীয় চার নেতার নামে অ্যাকাডেমিক ভবনের নামকরণসহ বেশ কিছু উন্নয়নমূলক কাজের ঘোষণা দিয়েছিলেন এবং উদ্বোধনও করেছিলেন। পরবর্তিতে এসবের কোন অগ্রগতি লক্ষ করা যায়নি। এগুলো কি উদ্বোধনেই সীমাবদ্ধ থাকবে নাকি আলোর মুখ দেখবে?

 

ড. কলিমউল্লাহ : ক্যাম্পাস-ভিত্তিক কমিউনিটি রেডিও স্থাপনে টেন্ডার আহ্বানের প্রক্রিয়া চলছে। ক্যাম্পাস টেলিভিশন চালুর বিষয়টিও প্রক্রিয়াধীন। জাতীয় চার নেতার নামে অ্যাকাডেমিক ভবনের নামকরণে ইতোমধ্যেই সিন্ডিকেটে পাস হয়েছে।

 

ইত্তেফাক : শিক্ষার্থীদের বহুল কাঙ্খিত ক্যাফেটেরিয়া আপনি যোগদানের পর উদ্ভোধন করলেও এটি পূর্ণাঙ্গরূপে এখনও চালু হয়নি। এ বিষয়ে কোন পরিকল্পনা আছে কিনা?

 

ড. কলিমউল্লাহ : শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে আমি প্রথম ক্যাফেটোরিয়া চালু করি। শুধু চা-বিস্কুট নয় ঈদের পরে ক্যাম্পাস খুললে সবকিছু পাওয়া যাবে অর্থাৎ পূর্ণাঙ্গভাবে ক্যাফেটোরিয়া চালু হবে। এজন্য ক্যাফেটোরিয়া দশ বছরের জন্য ইজারা দেওয়া হয়েছে।

 

 

ইত্তেফাক : শোনা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারি নিয়োগের ক্ষেত্রে আপনি কোন এমপি, মন্ত্রীদের সুপারিশ গ্রহণ করেন না, কতটুকু সত্য? আপনি কি মনে করেন সুপারিশ গ্রহণ না করাটাই নিয়োগে স্বচ্ছতা?

 

ড. কলিমউল্লাহ : আমি দুই বছরে ৩৮জন শিক্ষক, সাতজন কর্মকর্তা এবং ২১ জন কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছি। তাদের আপগ্রেডেশন নীতি করা হয়েছে। শিক্ষকদের বকেয়া বেতন-ভাতা প্রদান করা হয়েছে। হ্যাঁ, নিয়োগে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে আমি কারো সুপারিশ গ্রহণ করি না। এজন্য চাকরির বিজ্ঞাপনে আমি প্রথম উল্লেখ করা বাধ্যতামূলক করি যে ‘লিখিত বা মৌখিক যেকোন ধরনের তদবির প্রার্থীর অযোগ্যতা বলে বিবেচিত হবে। নিয়োগ পাওয়ার পর কোন অনৈতিক প্রন্থা অবলম্বনের অভিযোগ প্রমাণিত হলে চাকরির যেকোন পর্যায়ে আইনানুগ ব্যবস্থা (চাকরিচ্যূতিসহ) গ্রহণ করা হবে।’ এ নিয়ম আমি শতভাগ অনুসরণ করি।

 

 

ইত্তেফাক : আপনি আদালতের রায়কে শ্রদ্ধা জানিয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে মাহামুদুল হক-কে ৭ বছর পর শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপনে অংশীদার হয়েছেন। আদালত বলেছেন তাকে বাছাইবোর্ড অনুযায়ী নিয়োগ দিতে। এ ব্যাপারে আপনার পরবর্তী পদক্ষেপ কী? আর ওই সময় ওই বিভাগে অবৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্তদের ব্যাপারে আপনার অবস্থান কী হবে? 

 

ড. কলিমউল্লাহ : মাহামুদুল হক-এর আবেদনের প্রেক্ষিতে ৬১তম সিন্ডিকেটে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। আমি আদালতের রায়ের প্রতি শতভাগ শ্রদ্ধাশীল। ইতিহাস বিভাগেও এমন একটি নিয়োগ সংক্রান্ত মামলা হাইকোর্টে আছে বলে শুনেছি। রায় প্রার্থীর পক্ষে হলে তাকেও নিয়োগ দেওয়া হবে।

 

ইত্তেফাক : আপনার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় একটি অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায় তা হলো আপনি ক্যাম্পাসে থাকেন না। এ ব্যাপারে গণমাধ্যমে রিপোর্টও বেরিয়েছে। একজন উপাচার্য হিসেবে ক্যাম্পাসে সার্বক্ষণিক অবস্থান করা কতটুকু প্রয়োজন বলে মনে করেন? আপনার অনুপস্থিতিতে ক্যাম্পাসের প্রশাসনিক কাজে কোনো ধরনের অসুবিধা হয় বলে মনে করেন কি না?

 

ড. কলিমউল্লাহ : ক্যাম্পাসে সার্বক্ষণিক অবস্থানের বিষয়টি ব্রিটিশ আমলের বিধি। অনলাইন ও দ্রুত যোগাযোগের এ যুগে বিষয়টি কতটা প্রসঙ্গিক তা আলোচনার দাবি রাখে। প্রধানমন্ত্রী এখন ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে উন্নয়ন কাজ উদ্বোধন করছেন। প্রযুক্তির কারণেই তা সম্ভব হচ্ছে। আমি প্রতিদিন গড়ে বিশ ঘণ্টা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ করি। অর্থাৎ কয়েক ঘণ্টা বিশ্রাম ছাড়া সার্বক্ষণিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ করি। সংবাদপত্রের যেসব রিপোর্টে অনুপস্থিত হিসেব করা হয় সেইদিনই  কোন না কোন দাপ্তরিক কাগজপত্র স্বাক্ষরিত হয়েছে আমার মাধ্যমে অথবা ক্যাম্পোসে কোন অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেছি। এসব রিপোর্ট সম্পূর্ণভাবে ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এছাড়া, ঢাকায় অনুমোদিত বিশ্ববিদ্যালয়ের লিয়াঁজো অফিসে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমও পরিচালনা করি।

ইত্তেফাক : বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় কোন প্রতিবন্ধকতা আপনি অনুভব করেন কি? করলে তা কী?

 

ড. কলিমউল্লাহ : বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে কোন প্রতিবন্ধকতা আছে বলে আমার মনে হয় না। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় স্বাভাবিক গতিতে চলছে। আমি আসার পর একদিনের জন্য অপ্রীতিকর কোন ঘটনার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করতে হয় নি।

 

ইত্তেফাক : আপনার দুই বছর মেয়াদ পূর্তি উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকলের উদ্দেশ্যে যদি কিছু বলেন?

 

ড. কলিমউল্লাহ : পরিবেশ-বান্ধব, নারী-বন্ধব এবং অনিয়ম-অনাচারমুক্ত নিরাপদ সবুজ ক্যাম্পাস গড়ে তোলার লক্ষ্যে আমি কাজ করে যাচ্ছি। বিশ্বমানের পরিকাঠামোসমৃদ্ধ রোল মডেল হিসেবে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়কে গড়ে তুলতে সকলের সহযোগিতা কামনা করছি। 

 

ইত্তেফাক : ইত্তেফাককে দীর্ঘ এ সাক্ষাৎকার দেওয়ার জন্য  আপনাকে ধন্যবাদ।

 

ড. কলিমউল্লাহ : আপনাকে এবং আপনার ঐতিহ্যবাহী পত্রিকা ইত্তেফাককেও ধন্যবাদ।

 

ইত্তেফাক/ইউবি