বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যার ঘটনায় উপাচার্যের অপসারণ এবং ১০ দফা দাবিতে অনড় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আজ বৃহস্পতিবারও আন্দোলন কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন। বেলা ১১টায় বুয়েট ক্যাম্পাসে শেরে বাংলা হলের শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ মিছিলের মধ্য দিয়ে চতুর্থ দিনের কর্মসূচি শুরু হয়।
গতকাল তৃতীয় দিনও বুয়েট ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেছেন তারা। গতকাল বুধবার থেকে উপাচার্য অধ্যাপক সাইফুল ইসলামের অপসারণের দাবি জানিয়ে আসছেন শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অ্যালামনাই এসোসিয়েশনসহ বুয়েট সংশ্লিষ্ট অনেকেই। চলমান আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ঘটনাস্থল শেরে বাংলা হলের প্রাধ্যক্ষ ড. জাফর ইকবাল খান পদত্যাগ করেছেন। বুয়েটের ছাত্রকল্যাণ পরিচালক অধ্যাপক মিজানুর রহমান এ তথ্য নিশ্চিত করে জানান, শিক্ষক সমিতির সভায় প্রাধ্যক্ষ পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন।
ছাত্রহত্যার ঘটনায় গতকাল সকাল ১০টার দিকে শিক্ষক সমিতির আয়োজনে বৈঠক করেন বুয়েট ৩শ’ শিক্ষক। উপাচার্যের অদক্ষতা ও নানা অনিয়মে নির্লিপ্ততার প্রেক্ষিতে ভিসির পদত্যাগ চেয়েছেন তারা। বৈঠক শেষ তারা নিজেদের ৮ দফা দাবি তুলে ধরেন। এদিকে বুয়েট ছাত্রলীগ নেতাদের এমন কর্মকান্ডে আনুষ্ঠানিকভাবে লজ্জা প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ।
শিক্ষার্থীদের ১০ দাবি : দিনভর বুয়েট শিক্ষার্থীরা ১০ দফা দাবি আদায়ে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছে। দুপুর ১২টার দিকে বকশিবাজার থেকে পলাশী মোড় পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে ব্যারিকেড দিয়ে সড়ক অবরোধ করেন তারা। এতে দুর্ভোগে পড়তে হয় সাধারণ যাত্রীদের। আবরার ফাহাদের বিভাগ তড়িত্ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষক ও সহপাঠীরা সকালে মৌন মিছিল করেছেন। মিছিল শেষে বিভাগের অধ্যাপক শফিকুল ইসলাম ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বলেন, ‘যে ছাত্ররাজনীতি মানুষ হত্যা করে, সেই রাজনীতি আমরা চাই না।’
শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো হলো:১. খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ২. জড়িতদের আগামী ১১ অক্টোবরের মধ্যে আজীবনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করতে হবে। ৩. বুয়েট প্রশাসনকে ১১ অক্টোবর বিকাল ৫টার মধ্যে মামলা চলাকালীন সকল খরচ এবং আবরারের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ঘোষণা দিতে হবে। ৪. মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের অধীনে স্বল্পতম সময়ে নিষ্পত্তি করতে হবে। ৫. অবিলম্বে মামলার চার্জশিটের কপি দিতে হবে। ৬. বুয়েটে দলীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। ১৫ অক্টোবরের মধ্যে সব রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন এবং এর কার্যক্রম স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে। ৭. বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি কেন ৩৮ ঘণ্টা পরে উপস্থিত হয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিরূপ আচরণ করেন এবং কোনও প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে স্থান ত্যাগ করেন, তাকে সশরীরে ক্যাম্পাসে এসে জবাবদিহি করতে হবে। ৮. আবাসিক হলগুলোতে র্যাগিংয়ের নামে এবং ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর সব প্রকার শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন বন্ধ করতে হবে এবং এ ধরনের সন্ত্রাসে জড়িত সবার ছাত্রত্ব ১১ অক্টোবর বিকাল ৫টার মধ্যে বাতিল করতে হবে। ৯. পূর্বে ঘটে যাওয়া এধরনের ঘটনা প্রকাশ এবং পরবর্তীতে ঘটে যাওয়া যেকোনও ঘটনা প্রকাশের জন্য একটা কমন প্ল্যাটফর্ম (কোনও সাইট বা ফর্ম) থাকতে হবে এবং নিয়মিত প্রকাশিত ঘটনা রিভিউ করে দ্রুততম সময়ে বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। নিরাপত্তার স্বার্থে সব হলের প্রত্যেক ফ্লোরের দুপাশে সিসিটিভি ক্যামেরার ব্যবস্থা করতে হবে। ১০. ছাত্রদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হওয়ায় শেরে বাংলা হলের প্রধ্যক্ষকে ১১ অক্টোবর বিকাল ৫টার মধ্যে প্রত্যাহার করতে হবে। উল্লেখ্য, সকালে এই দশ দফা দেওয়ার পর দুপুরে হল প্রাধ্যক্ষ পদত্যাগ করেন।
ভিসির পদত্যাগ দাবি: হত্যার ঘটনা এবং উপাচার্যের অদক্ষতাকে দোষারপ করে উপাচার্যের পদত্যাগ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছে বুয়েট অ্যালামনাই এসোসিয়েশান। বেলা সাড়ে ১২টায় বুয়েট ক্যাম্পাস প্রাঙ্গণে আবরার ফাহাদ হত্যার প্রতিবাদে এক সমাবেশ থেকে বুয়েট অ্যালামনাই এ সব দাবি জানায়। অ্যালামনাইয়ের সভাপতি অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী সাত দফার লিখিত বিবৃতি পাঠ করেন।
চলমান পরিস্থিতিতে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বৈঠকে বসেন বুয়েট শিক্ষক সমিতির তিনশ শিক্ষক। বৈঠক শেষে দুপুর আড়াইটায় শিক্ষার্থীদের সামনে এসে সমিতির সভাপতি একে এম মাসুদ বলেন, ‘আমরা শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দিতে পারিনি। আমরা অপরাধী। তবে হত্যাকান্ডে জড়িতদের বুয়েট থেকে আজীবন বহিষ্কার করতে যাচ্ছি আমরা।’ ভিসির অপসারণ দাবি করে তিনি বলেন, ‘একজন অদক্ষ ভিসির কারণে আমাদের প্রাণপ্রিয় প্রতিষ্ঠানকে নষ্ট হতে দেব না।’ তিনি আরো বলেন, তিনশ শিক্ষকের সমন্বয়ে মিটিং হয়েছে। বুয়েটের স্বার্থে কোনো শিক্ষক ও শিক্ষার্থী পরোক্ষ রাজনীতিতে জড়িত হবে না বলে বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ সময় ভিসির পদত্যাগসহ আট দফা তুলে ধরেন তিনি।
লজ্জিত ছাত্রলীগ: আবরার হত্যাকান্ডের সঙ্গে বুয়েট ছাত্রলীগের পোস্টেড নেতা-কর্মী জড়িত থাকায় লজ্জিত কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ! গতকাল দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে ‘আবরার হত্যার দ্রুত বিচারের’ দাবিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে নিজেদের এ অবস্থান জানিয়েছে সংগঠনটির শীর্ষ নেতারা। সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য বলেন, ‘এই হত্যাকান্ডের জন্য আমরা লজ্জা প্রকাশ করছি। আমরা আবরার হত্যাকারীদের দ্রুত বিচার দাবি করছি।’ ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় বলেন, ‘পলাতকদের দ্রুত সময়ের মধ্যে গ্রেফতারের আহ্বান জানাই। একইসঙ্গে এজাহারের বাইরে হত্যাকান্ডে জড়িতদের চিহ্নিত করে দ্রুত আইনের আওতায় নিয়ে আসারও আহ্বান জানাই। এক্ষেত্রে ছাত্রলীগ সব ধরনের সহযোগিতা করবে।’
ইত্তেফাক/এএম