শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

সিটি নির্বাচনে বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী

জয়ী হলে খুশি আওয়ামী লীগ সমঝোতার চেষ্টায় বিএনপি

আপডেট : ২৫ জানুয়ারি ২০২০, ০১:৪৩

আগামী ১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলের বিদ্রোহী প্রার্থীরা অনড় অবস্থানে রয়েছেন। প্রথমে মৌখিকভাবে বোঝান, পরে দুই দফা আলটিমেটাম, বহিষ্কারের হুমকি দিয়ে চিঠি, ঠাঁই হবে না কোনো কমিটিতে—এমন কঠোর বার্তা সত্ত্বেও অধিকাংশ বিদ্রোহী প্রার্থীই পিছু হটছেন না। এতে দুই দলের একক প্রার্থীদের অনেকের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে দিয়েছেন নিজ দলেরই বিদ্রোহী প্রার্থীরা। বুঝিয়ে বিদ্রোহীদের বসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা এখনো অব্যাহত রেখেছে আওয়ামী লীগ। দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একজন নেতা জানিয়েছেন, ‘দলসমর্থিত প্রার্থীর বিজয় সুনিশ্চিত করার জন্য বিদ্রোহীদের মাঠ থেকে সরাতে সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে। তবে বিদ্রোহীরা জয়ী হলে খুশি হবে আওয়ামী লীগ। কারণ তারা তো দলেরই নেতা।’

অন্যদিকে বিদ্রোহী প্রার্থীদের নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে এতদিন মৌখিক অনুরোধ করলেও এবার চিঠি দিয়ে সতর্ক করল বিএনপি। দুই সিটিতে প্রায় ৩৭ বিদ্রোহী প্রার্থীকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে বিদ্রোহী প্রার্থীদের মাঠ থেকে সরাতে বিএনপি সমঝোতার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় নেতাদের সমন্বয়ে গঠিত দুটি টিম ইতিমধ্যে বুঝিয়ে ১৫ বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থীকে মাঠ থেকে সরিয়ে দিলেও প্রার্থীরা নিজেরা সরে যাওয়ার ঘোষণা দেননি।

গত ২৮ ও ২৯ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সভায় ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে আতিকুল ইসলাম ও শেখ ফজলে নূর তাপসের নাম চূড়ান্ত করা হয়। তাছাড়া ১২৯ জন সাধারণ কাউন্সিলর ও ৪৩ জন সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলরকে সমর্থন দেওয়া হয়। দল সমর্থিত প্রার্থীকে জয়ী করার নির্দেশনা ছাড়াও এর বাইরে কোনো নেতা যাতে কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করেন, এ বিষয়ে কঠোর নির্দেশনা দেয় কেন্দ্রীয় কমিটি। এরপরও আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের তিন শতাধিক নেতা কাউন্সিলর পদে মনোনয়নপত্র জমা দেন। কেন্দ্রের সব হুঁশিয়ারি উপক্ষো করে এখনো ঢাকার ১২৯ ওয়ার্ডের মধ্যে ৭৭টি ওয়ার্ডে দলের শতাধিক বিদ্রোহী প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের যেসব নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে কাউন্সিলর পদে লড়ছেন, তাদের কারণে ভোট ভাগাভাগি হয়ে যাবে বলে এই প্রার্থীদের কেউ কেউ হারার শঙ্কায় রয়েছেন। তবে মনোনয়নপত্র দাখিল করেও দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে যেসব ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহীরা প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছেন, সেসব ওয়ার্ডে ক্ষমতাসীন দল সমর্থিত প্রার্থীরা অনেকটা নির্ভার রয়েছেন। তবে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের মদত দিচ্ছেন কেন্দ্রের কয়েকজন নেতা বলে অভিযোগ রয়েছে।

এমন অবস্থার মধ্যে সম্প্রতি আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের মতো দেশে এসব শৃঙ্খলাবিরোধী বিষয়টা দলের মধ্যে থাকে। আমরা তো অনেক বছর ক্ষমতায় আছি। ২০০৯ সাল থেকে ১১ বছর। এতে বিদ্রোহ বা স্বতন্ত্র প্রার্থী এই বিষয়গুলো থাকবেই। এত বড়ো দলের মধ্যে এসব সমস্যা থাকবেই। কিন্তু সেটা তো আমাদের বিজয়ের পথে অন্তরায় হয় না।’ প্রসঙ্গত, বিদ্রোহীদের ডেকে কথা বলে ভবিষ্যতে মহানগর আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের কমিটিতে পদায়নসহ সব ধরনের মূল্যায়নের আশ্বাস দিলেও কর্ণপাত করেননি প্রার্থীরা।

অতীতে বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে বিদ্রোহী প্রার্থীদের ক্ষমা করে দেওয়া ও পুরস্কৃত করাসহ অন্তত ছয় কারণে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের আসন্ন নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে দলের জন্য কাজ করলেও মনোনয়ন পাননি অনেকেই। এ ক্ষোভ থেকে প্রার্থী হয়েছেন। তাদের দাবি, কেন্দ্রীয় নেতাদের ভুল বুঝিয়ে মনোনয়ন চূড়ান্ত করা হয়েছে। এর পেছনে স্বজনপ্রীতি, অবৈধ অর্থের লেনদেন ও নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা প্রদানের ঘটনা রয়েছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার পেছনে অতীতের উদাহরণই বেশি দায়ী। কেননা এর আগের নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী থাকলেও এ নির্বাচনে দলীয় সমর্থন পেয়েছে, এমন প্রার্থীর অভাব নেই। তাদের শাস্তি না দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়েছে। এদিকে বেশির ভাগ বিদ্রোহী প্রার্থীই দল ও দলের বাইরে প্রভাবশালী। অনেকেরই রয়েছে পেশিশক্তির জোর। তাদের ধারণা, মাঠে থেকে দলীয় প্রার্থীকে কোণঠাসা করে নিজেদের জয় নিশ্চিত করবেন। তা ছাড়া ভুল প্রার্থী বাছাই, মাঠ পর্যায়ে এমপি, কেন্দ্রীয় ও মহানগর নেতা এবং মেয়রপ্রার্থীর নিজস্ব বলয়, এলাকাভিত্তিক আধিপত্য বিস্তার ও অভ্যন্তরীণ কোন্দলকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিদ্রোহী প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের দাবি, ওয়ার্ডভিত্তিক কাউন্সিলর প্রার্থী বাছাইয়ে তৃণমূলের মতামত নেওয়া হয়নি। মহানগর নেতাদের দেওয়া তালিকা যাচাই-বাছাই ছাড়াই ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে ভুল প্রার্থী সমর্থন দিয়েছে আওয়ামী লীগ।

এদিকে বিএনপির বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থীদের সতর্ক করে চিঠি দিয়েছে। চিঠিতে ঐসব প্রার্থীকে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে দল সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতেও অনুরোধ করা হয়েছে। নির্দেশনা না মানলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়েছে। বিদ্রোহীরা সরে না গেলে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্তও রয়েছে দলটির। দলের বিজয় ও ঐক্য অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে দল মনোনীত মেয়র ও সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীর পক্ষে কাজে অংশ নিয়ে সহযোগিতা কামনা করা হয় চিঠিতে। জানা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৫৪টি সাধারণ ওয়ার্ডের মধ্যে ১৭টি ওয়ার্ডে বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছেন। দক্ষিণ সিটির ৭৫টি সাধারণ ওয়ার্ডের মধ্যে ১৩টিতে রয়েছেন বিদ্রোহী প্রার্থী। অপরদিকে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের সমন্বয়ে গঠিত দুটি টিম বিদ্রোহীদের বুঝিয়ে বসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন।

ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণে ২২টি ওয়ার্ডেই বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী এখনো পর্যন্ত অনড় অবস্থানে রয়েছে। এ নিয়ে বেকায়দায় বিএনপির হাইকমান্ড। বিদ্রোহী প্রার্থী থাকলে দল মনোনীত মেয়র ভোটেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন নীতিনির্ধারকরা। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা জানান, বিদ্রোহী প্রার্থীদের বসানোর সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে। সবাইকে হয়তো বসানো যাবে না। অধিকাংশই প্রার্থীকে শেষ পর্যন্ত বসানো হবে। পরবর্তীতে ঐসব প্রার্থীর বিষয়টি বিবেচনায় নেবে কেন্দ্রীয় কমিটি। তবে একাধিক বিদ্রোহী প্রার্থী ইত্তেফাককে জানান, যেহেতু দলীয় প্রতীকে ভোট হচ্ছে না তাই প্রতি ওয়ার্ডে একাধিক প্রার্থী থাকলেও সমস্যা হবে না। প্রত্যেক প্রার্থীরই জনমত যাচাই হবে এই ভোটে। এতে পরবর্তীতে কমিটিসহ সবক্ষেত্রেই বিএনপির কাজ করা সহজ হবে বলে তারা অভিমত ব্যক্ত করেন।