শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

বিপর্যস্ত পৃথিবীর সম্মুখ বাস্তবতার আখ্যান ‘জলবাসর’

আপডেট : ২৯ জানুয়ারি ২০২০, ১১:১৭

প্রথমবারের মতো মঞ্চে উঠলো মাসুম রেজার রচনা ও নির্দেশনায় দেশ নাটক-এর ২৩তম প্রযোজনা ‘জলবাসর’। ২৪ ও ২৫ জানুয়ারি সন্ধ্যায় তিন বানিয়াকন্যার গল্প শোনালেন প্রখ্যাত এই নাট্যকার। গল্প মঞ্চে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই রচিত হলো আরেক গল্প। থিয়েটারের যে কত শক্তি, কি প্রবল টান; তার সবটা প্রয়োগ করে দেখালেন দেশ নাটকের স্বজন হারানো শোকাহত কর্মীরা। চোখে ছলছল জল, বুক ভরা হাহাকার নিয়ে সেদিন সবটা নিংড়ে দিলেন অভিজ্ঞ অভিনেত্রী নাজনীন হাসান চুমকি, বন্যা মির্জা ও সুষমা সরকাররা। যা অনেকদিন মনে রাখবেন দর্শকেরা।

 

গল্প-পাঠ থেকে শুরু করে নাটকটি মঞ্চায়নের বিশাল কর্মযজ্ঞ নিজ হাতে শেষ করে উদ্বোধনী মঞ্চায়নের মাত্র পাঁচদিন আগে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন দলটির প্রধান ইশরাত নিশাত। শোকাহত কর্মীরা ‘প্রিয় নিশাত আপা’র চাওয়া পূরণ করতে কাল-বিলম্ব না করে সিদ্ধান্ত নেন পূর্বনির্ধারিত দিনেই হবে উদ্বোধনী মঞ্চায়ন। নাটকের জন্য নিবেদিত প্রাণ ইশরাত নিশাত বলেছিলেন, ‘আমার মৃত্যু হলেও দেশ নাটকের স্বপ্ন থামবে না।’ সেই ব্রতকে সামনে রেখে সাহস দেখায় দেশ নাটক।

নির্ধারিত সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমির অঙ্গনে দুটি আবহ স্পষ্ট ছিলো। ইশরাত নিশাতকে হারানোর শোকে আচ্ছন্ন শিল্পকলার প্রতিটি প্রাঙ্গণ। অন্যদিকে দর্শকদের মাঝে উচ্ছ্বাস-আনন্দ নতুন নাটক ঘিরে। দেশ নাটকের কর্মীদের শোকাহত ভারি কণ্ঠে, আওড়াতে হবে রোমান্টিক সুর অথবা প্রবল হাসির কোনো সংলাপ! যা এক বিস্ময়কর চ্যালেঞ্জ ছিলো কর্মীদের জন্য। বলতেই হবে, সেই চ্যালেঞ্জে দারুণভাবে উৎরে গেছেন সবাই। কী এক প্রবল শক্তি নিয়ে সেদিন মঞ্চে এসেছিলেন সবাই, তা নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করাও কঠিন!

 

নাটকটি বলে, চান্নিপসর ও ডুবুদহ গ্রামের তিন বানিয়াকন্যা ও ছয় নদীর গল্প। যে গল্প শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠে পুরো পৃথিবীর গল্প। আর সেই পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষার নীরব দায় পালন করে তিন বানিয়াকন্যা হয়ে ওঠে প্রকৃতিরই অংশ। মানুষ তার চারপাশের জল, জঙ্গল, মাটি, গিরিশৃঙ্গ ধ্বংস করতে করতে কোন বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সেই আখ্যানই বিম্বিত হয়েছে জলবাসরের পরতে পরতে।

জাদু-বাস্তবতার আশ্রয়ে অতীত-বর্তমানের মধ্য দিয়ে ভবিষতের মগজ বাস্তবতাকে টেনে এনেছেন নাট্যকার মাসুম রেজা। এজন্য ‘জলবাসর’কে নাট্যকার বলছেন, সম্মুখ বাস্তবতার গল্প।

 

মাসুম রেজা বলেন, ‘‘জলবাসরে বর্ণিত চলমান বিপর্যাস, বর্তমান সময়কে অতিক্রম করে আরেক বর্তমানে পৌঁছায়। আমার শিল্প ভাবনার গুরু সেলিম আলদীন তার নিমজ্জন নাটকের মাধ্যমে একটা রীতির কথা বলেছিলেন। ‘সম্মুখ বাস্তবতা’ বা ‘ফোররিয়েলিজম’। এই রীতির সাথে আমার জলবাসরের সবটুকুই মিলে যায়। তাই আমি জলবাসরকে ‘সম্মুখ বাস্তবতার’র নাটকই বলছি।’’

 

গল্পের বিস্ময়কর দুটি দিক; ছয় নদী পুরোপুরি মৎসহীন হয়ে পড়া ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফল বজ্রপাতে মানুষের শরীর থেকে ছায়া বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া। স্বাভাবিকভাবে ঘটনা দুটি কল্পনা করতে কষ্ট হলেও নাট্যকারের বর্ণনায় তা ফুঁটে উঠেছে অমোঘ সম্মুখ বাস্তবতা হিসেবে। সেই সাথে চরাচরের ভারসাম্য রক্ষায় প্রকৃতির অবদান স্পষ্ট হয়েছে তিন বানিয়াকন্যার মধ্য দিয়ে।

দেশের চিরায়ত অভিনয়ের ঢঙের বাইরে গিয়ে ইশরাত নিশাতের নেতৃত্বে যে অভিনয় শৈল্য দেশ নাটক দেখাতে চেয়েছিলো, তাতে তারা ভালোভাবেই পাস মার্ক পেয়ে গেছেন। পৃথিবী আকৃতি ছয়তলা মঞ্চের খুঁটিগুলো কিছুটা জড়তা সৃষ্টি করলেও অভিনয় শিল্পীদের নৈপুণ্যে সেখানেও সফল দেশ নাটকের জলবাসর। কস্টিউম ও আলোক পরিকল্পনাতেও ছিলো নান্দনিকতার ছাপ। রেকর্ডিং আবহ সঙ্গীত গল্পের গাঁথুনির মধ্যে কিছুটা খাপছাড়া মনে হতে পারে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হয়তবা সেখানেও গুঁছিয়ে উঠতে সক্ষম হবে দেশ নাটক।

 

নাটকটির বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন কামাল আহমেদ, ফিরোজ আলম, সেলিনা শেলী, খায়রুল আনাম জোয়ার্দার, ফাহিম মালেক ইভান, মাইনুল হাসান মাঈন, কুদ্দুস মাখন, অসীম কুমার নট্ট, রোশেন শরিফ, কাজী লায়লা বিলকিস, হোসেইন নিরব, লরেন্স উজ্জ্বল গমেজ, সুষ্মিতা সাহা, তামিমা তিথি, সুজন রায়, ইব্রাহীম হোসাইন, আবিদুর রহমান আদর, গোলাম মাহমুদ, সালমান লিমন, সাগর দাস, লেতুনজেরা নীলা, আল আমিন, পলাশ মণ্ডল, শাহেদ নাজির ও ব্রততী বিথু।

 

ইত্তেফাক/এএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন