শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

যে স্মৃতি ভোলার নয়

আপডেট : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৩:০০

১৯৯০ সালে অজয় রায়ের সঙ্গে আমার আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী বঙ্গেশ্বর রায় এবং কমিউনিস্ট নেত্রী নিবেদিতা নাগের অতিথি হয়েই আমরা আন্দামান যাই। বঙ্গেশ্বর রায় এবং নিবেদিতা নাগ—দুজনেই অজয় রায়ের পরিচিত। তারা ভারত সরকারের বিশেষ অতিথি হয়ে আন্দামান যাচ্ছিলেন। আমাদেরও তাদের সঙ্গী হিসেবে যাওয়ার আহ্বান জানালে অজয় রায় প্রথমে যেতে রাজি হননি।

কিন্তু আমার আগ্রহের কারণে শেষ পর্যন্ত অজয় রায়ও সম্মত হন। আন্দামান, বিশেষ করে সেখানকার সেলুলার জেল দেখার আমার খুব ইচ্ছা ছিল। কমিউনিস্ট পার্টির নেতা অনিল মুখার্জির মুখে আন্দামান ও সেলুলার জেলের অনেক গল্প শুনেছি।

বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ এখন ভারতের কেন্দ্রীয় শাসিত একটি অঞ্চল। রাজধানী পোর্ট ব্লেয়ার। কলকাতা থেকে ১ হাজার ২৫৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। সেলুলার কারাগারটি এখন জাতীয় স্মৃতি স্মারক হিসেবে ব্যবহূত হয়। অনেক দর্শনার্থী-পর্যটক সেটা দেখতে যান। ভারত সরকার প্রবীণ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে সেখানে নিয়ে যান। সেখানে বিভিন্ন গ্যালারিতে স্বাধীনতা সংগ্রামী যারা আন্দামানে নির্বাসিত হয়েছিলেন, তাদের ছবি এবং স্মারকচিহ্ন সংরক্ষিত আছে।

আন্দামানকে কালাপানিও বলা হতো। কালা বলতে মৃত্যু বোঝানো হতো। আর সাগরের উপকূলে পানি বেষ্টিত বলে পুরো নাম হয়েছিল কালাপানি। একবার কাউকে কালাপানিতে পাঠানো হলে তার জীবিত ফিরে আসার সম্ভাবনা কম থাকত। অন্যদিকে আন্দামানে পানির রংও কালো। ঐ পানিতে কেউ পা ডোবায় না। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের পর থেকেই ইংরেজরা আন্দামানকে বন্দি শিবির হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। ১৯০৬ সালে সেলুলার জেলের নির্মাণ কাজ শেষ হয়। অসংখ্য ছোট ছোট সেল বা কুঠুরির সমন্বয়ে তৈরি বলেই এর নাম হয় সেলুলার জেল। ৬৯৩টি সেল ছিল। ১০ ফুট লম্বা এবং ৮ ফুট চওড়া প্রতি সেলে একজন বন্দি থাকার ব্যবস্থা। কেউ কারো মুখ দেখার সুযোগ পেতেন না। আলোবাতাসহীন বদ্ধ সেলে বছরের পর বছর কাটিয়েছেন অনেক বন্দি। অনেক বাঙালি বিপ্লবীও সেখানে ছিলেন। তাদের ছবি সেখানে এখন সংরক্ষিত আছে। মহারাজ ত্রৈলোক্য নাথ চক্রবর্তী, আমাদের শেরপুরের রবি নিয়োগী, অনিল মুখার্জিসহ অনেকের ছবি আমিও দেখেছি।

আমরা খিদিরপুর থেকে উঠেছিলাম। স্টিমারে প্রচুর খাবার-দাবার ছিল। যেহেতু যাত্রীদের বেশির ভাগ সরকারের অতিথি, সেহেতু কারো যাতে কোনো অসুবিধা না হয়, সেদিকে ছিল কড়া নজরদারি। আন্দামানে আমাদের থাকার ব্যবস্থাও ছিল ভালো। সেখানে তখন ফরেস্ট অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন অজয় রায়ের মামা দীপক দত্ত। আমরা তাকে দীপু মামা বলে ডাকতাম। তিনি ছিলেন গৌরী মাসির ভাই। দীপু মামাও একটি বড় বাড়িতে থাকতেন। তার চলাফেরার জন্য একটি জিপ গাড়িও ছিল। তিনি আমাদের তার বাসায় থাকতে বললেও আমরা অন্য সহযাত্রীদের সঙ্গেই থেকেছি। তবে দীপু মামার সঙ্গে তার জিপে চেপে ঘোরাঘুরি করেছি। পোর্ট ব্লেয়ার রাজধানী হলেও তখন পর্যন্ত যানবাহনের সংকট ছিল। রাস্তাঘাট তেমন ভালো ছিল না। সেখানে আমার অবশ্য দেখার আগ্রহের তালিকার শীর্ষে ছিল সেলুলার জেল। আমি সারা দিন খুটিয়ে খুটিয়ে সব দেখেছি।

আন্দামানে দক্ষিণ ভারতীয় মানুষের বাস বেশি। কয়েক শ বাঙালি পরিবারও আছে। তবে আন্দামানের আদিবাসী মানুষদের আর চোখে দেখা যায় না। তারা নাকি এখনো গভীর জঙ্গলে বসবাস করে আর সমুদ্র থেকে মাছ ধরে এবং জঙ্গলের পশু-পাখি বধ করে ক্ষুধা নিবারণ করে। সভ্যতার আলো থেকে ওরা নিজেদের দূরে সরিয়ে রেখেছে।

আন্দামানে আমরা চার দিন ছিলাম। ফেরার পথে আমি একটু সী সিকনেসে ভুগেছি। মাথা ঘোরাসহ কিছু অস্বস্তি হয়েছে। তবে সব মিলিয়ে ভ্রমণ এবং নতুন জায়গা দেখে ভালোই লেগেছিল।

নিবেদিতা নাগের অতিথি হয়ে যেহেতু গিয়েছি, সেহেতু তার সম্পর্কে দু-একটি কথা বলার লোভ সামলাতে পারছি না। নিবেদিতা নাগ ছিলেন একজন প্রকৃত বিপ্লবী নারী। কমিউনিস্ট পার্টি করতে গিয়ে তিনি অনেক শারীরিক-মানসিক কষ্ট সহ্য করেছেন। তিনি বিয়েও করেছিলেন আরেক কমিউনিস্ট বিপ্লবী ও শ্রমিক আন্দোলনের প্রথম সারির নেতা নেপাল নাগকে। তার বাবা অধ্যাপক সঞ্জীব কুমার চৌধুরী ছিলেন চট্টগ্রাম বিপ্লবী সূর্য সেনের বন্ধু এবং স্বাধীনচেতা মানুষ। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং নেপালের ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। নিবেদিতা (চৌধুরী) নাগের মা অমিয়াবালা চৌধুীরও স্কুল শিক্ষিকা ছিলেন।

নানামুখী সমস্যার চাপে তারা দেশত্যাগে বাধ্য হন। কলকাতায় গিয়েও রাজনীতি থেকে নিষ্ক্রিয় না হয়ে আরো বেশি তত্পর হয়েছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেপাল নাগ-নিবেদিতা নাগ দম্পতি বিশেষ সহায়ক ভূমিকা পালন করেছেন।

অজয় রায়ের রাজনৈতিক অবস্থানের কারণেই এই পরিবারের সঙ্গে আমিও ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ পেয়েছি। নিবেদিতাদির ছেলে সুজয় নাগ একসময় ঢাকায় নিলোট গ্রুপের বড় কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেছে। সেসময় নিবেদিতাদি ছেলের বাসায় বেড়াতে এসেছেন একাধিকবার। আমাদের নিমন্ত্রণ করে খাইয়েছেন আবার আমাদের বাসায়ও এসেছেন। গুলশানে ছেলের বাসায় একদিন সন্ধ্যায় আমাদের নিমন্ত্রণ করেন। অজয় রায়ের কী একটি জরুরি কাজ ছিল। কাজ শেষ করে তিনি যাবেন, আমাকে আলাদা যেতে বললেন। আমি তাড়াহুড়া না করে আস্তে-ধীরে গিয়ে দেখি আমার আগেই অজয় রায়, অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ, পংকজ ভট্টাচার্যসহ অন্যরা পৌঁছে গেছেন। নিবেদিতাদি খুব মজার মানুষ ছিলেন। সব বিষয়ে খুব রসিকতা করতেন।

একটি মজার গল্প শুনেছি দিদির মুখে। তিনি কিছুদিন পুরান ঢাকার একটি স্কুলেও শিক্ষকতা করেছেন। ২৫ বৈশাখ রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করেন স্কুলে। পাকিস্তানি শাসকরা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে মাতামাতি পছন্দ করত না। তবু নিবেদিতাদি রবীন্দ্রজয়ন্তীর আয়োজন করেন এবং প্রধান অতিথি করেন স্কুলের ধর্ম শিক্ষক, মৌলভী সাহেবকে। মৌলভী সাহেব তার বক্তব্যে বলেন, রবীন্দ্রনাথের নামের শেষে ঠাকুর পদবি থাকলে কী হবে, তিনি একজন বড় মওলানা ছিলেন। তার দাড়ি এবং আলখাল্লা আমার চেয়ে বড় ছিল!

এমনই ছিলেন নিবেদিতাদি, যিনি তার জীবনের একটা বড় সময় কাটিয়ছেন চরম দুঃখকষ্টের মধ্যে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখে। তিনি আমৃত্যু অতি সাধারণ জীবনযাপন করেছেন। ছেলে অনেক মোটা মাইনের বড় চাকরি করলেও নিবেদিতাদি শেষ জীবনেও কোনো বিলাসিতা করেননি। ছেলের বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে না ওঠে নিজের ছোট অথচ ছিমছাম এবং নানা ধরনের বইয়ে ঠাঁসা বাড়িতেই থেকেছেন। বই পড়ার নেশা ছিল তার। ২০১৩ সালের ৫ মে নিবেদিতা নাগ কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। তার জন্ম হয়েছিল ১৯১৮ সালের ৪ আগস্ট নারায়ণগঞ্জে মাতুলালয়ে।

বঙ্গেশ্বর রায়েরও প্রথম জীবন কেটেছে ঢাকায়, গেন্ডারিয়া এলাকায়। তিনি লেখক সোমেন চন্দের বন্ধু ছিলেন। সোমেন চন্দ মার্কসবাদী সাহিত্যিক ছিলেন। প্রতিভাধর এই লেখক ফ্যাসিবাদবিরোধী সম্মেলনের আয়োজন করতে গিয়ে ১৯৪২ সালের ৮ মার্চ ঢাকায় আততায়ীর হামলায় নিহত হয়েছিলেন। বঙ্গেশ্বর রায় ঢাকাইয়া ভাষায় সুন্দর কথা বলতে পারতেন। ঢাকায় প্রচলিত কিছু মজার কৌতুক আমি তার কাছে শুনেছি।

এসব মানুষের সান্নিধ্য পাওয়ার স্মৃতি আমি কখনো ভুলব না।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও সমাজকর্মী

ইত্তেফাক/এসসিএস