শাখায় শাখায় ভালোবাসার অপার প্রেমের রং, পল্লবময় আঙিনা ঘিরে সবুজের খেলা। সে রং লেগেছিল কবে কার মনে জানি না তবে অবুঝ বয়সে ছন্দ তুলে ঝাঁকড়া চুলের ঝুঁটি দুলিয়ে আধো বোলে খুব গেয়েছি
রাঙা হাসি রাশি রাশি অশোকে পলাশে
রাঙা নেশা মেঘে মেশা প্রভাতে আকাশে...
অশোক কী পলাশ কিংবা আকাশের রং চেনার বয়স সেটা নয়, শুধু দেখলাম গানের দিদিমনি কোমরে আঁচল জড়িয়ে লম্বা দাড়িওয়ালা ঋষি ঋষি চেহারার মানুষটার একটা বাঁধানো ছবি জুতসই জায়গায় রাখার জন্য ছুটোছুটি করছেন ‘অকারণের সুখে’। সেদিন জানলাম উনি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। চলছে তাঁর জন্মদিনের আয়োজন। মাগো কী ক্ষমতা—ছবির মধ্যে বসেই খুব খানিকটা ঘুরিয়ে নিলেন দিদিমনিকে, সেইসঙ্গে আমাদেরও।
তার অনেক পরে প্রাণে ধারণ করেছি কবিগুরুকে। চিনেছি দুঃখহারী অশোককে। ভালোবেসেছি বসন্তকে।
আহা বসন্তের হাওয়া গায়ে লাগতেই কোথা থেকে আসে শিরশিরানি শিহরণ, মনের দুয়ার খোলা আহ্বান। কণ্ঠে এসে ভর করে মন তাতানো গানের সুর, উতল করে তোলে ভেতরটা। কী যেন হারাই—কী যেন পাই—কী যেন খুঁজি নিজেও জানি না। তবু গাই—
তোমার অশোকে কিংশুকে
অলক্ষ্য রং লাগল আমার অকারণের সুখে...
সে রং যে মনে ছাপ ফেলে যায়! ফেলবেই তো প্রেমের প্রতীক যে অশোক ফুল।
রাজপুত্রের জন্ম তো রাজপ্রাসাদেই হওয়ার কথা, তবে লুম্বিনীর অশোক তরুতলে কেন মহামতি গৌতম বুদ্ধের জন্ম হলো? সে প্রশ্নে না গিয়ে ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু’ তত্ত্বে মনকে থামিয়েছি। এই মিথ অবশ্যি অশোকগাছকে বাড়তি খ্যাতি এনে দিয়েছে সন্দেহ নেই। পৌরাণিক কাহিনির দেবী গৌরী অশোক তলে সিদ্ধি লাভ করেছিলেন তপস্যা করে, পেয়েছিলেন শোক-তাপ থেকে মুক্তি। আর রাবন যে সীতাকে হরণ করে অশোক বনে লুকিয়ে রেখেছিল সে-ও তো অজানা কথা নয়।
ছায়া সুনিবিড় মায়াময় চিরহরিত্ বৃক্ষ সবার পছন্দ হওয়ারই কথা। সেই সবুজের ভিতর লাল কমলা মেলানো রঙের ফুলগুলো যেন নিজেরাই আবির খেলায় মেতে ওঠে, কাছে টানে তার মৃদুমন্দ সুগন্ধ, সত্যিই তখন অন্য সব ভুলে তার দিকে তাকিয়ে আনমনা না হয়ে উপায় কী? শুনেছি তার আরো কিছু নাম—অঞ্জনপ্রিয়া, হেমপুষ্প, প্রপল্লব, কর্ণপূরক, দোষহারী। তবে অশোক নামটিই বহুলশ্রুত।
অশোক বসন্তে ফুল ফোটা শুরু করে হেমন্ত অবধি দৃষ্টি কাড়ে সেই অকারণের সুখে। মাঝারি উচ্চতার গাছ। ফুলের মঞ্জরী জুড়ে মৌমাছিদের উত্সব। fabales পরিবারের অশোকের বৈজ্ঞানিক নাম (সাকরা আশোকা)। ওসব খটমট নামের হিসেবে না গিয়ে শুধু এইটুকু মনে রেখেছি আমাদের এই ভারতবর্ষীয় অঞ্চলের স্থানীয় বৃক্ষ অশোক।
আর ঔষধিগুণে ভরা সে আসলে মন মাতানো ফুলের জন্যই বিখ্যাত। সাধারণত রাজ অশোক, স্বর্ণ অশোক ও অশোক—এই তিন রকমের ফুলের দেখা পাওয়া যায়। কুমুদিনীর বাগান আলো করে ফুটেছে অগুনতি অশোক। সে বাগানে সকাল-সন্ধ্যা হাঁটতে গিয়ে গুনগুনিয়ে গান আসে আপন প্রাণে—
বসন্তে ফুল গাঁথল আমার জয়ের মালা
রইল প্রাণে দাখিন হাওয়া আগুন-জ্বালা...
ইত্তেফাক/এএইচপি