শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে সেন্টমার্টিন দ্বীপ

আপডেট : ২৬ এপ্রিল ২০২১, ০৩:১৮

সেন্টমার্টিন দ্বীপ, যাকে ঘিরে রয়েছে অপার পর্যটন সম্ভাবনা। প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ অবসর যাপনের জন্য ভিড় করে দেশের সর্বশেষ প্রান্তে অবস্থিত এই নীল জলের দ্বীপে। সারি সারি নারিকেলগাছ আর কেয়া বনের সৌন্দর্য সেন্টমার্টিনের গ্রহণযোগ্যতা আরো অনেক গুণ বাড়িয়ে দেয় ভ্রমণপিপাসুদের কাছে। কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলায় অবস্থিত এই দ্বীপ বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের বুকে জেগে ওঠা একমাত্র প্রবালদ্বীপ।

এত সুন্দর ভৌগোলিক পরিবেশে অবস্থিত এই দ্বীপের বর্তমানে বড়ই বেহাল দশা। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে সেন্টমার্টিনের পরিবেশের ওপর পড়ছে বিরূপ প্রভাব। প্রতিনিয়ত কমে যাচ্ছে প্রবালের পরিমাণ। কমছে গাছপালা আচ্ছাদিত অঞ্চলের পরিমাণ, নষ্ট করা হচ্ছে প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা কেয়া বন। যেখানে ১৯৯৬-৯৭ সালে সেন্টমার্টিনে বার্ষিক পর্যটকের সংখ্যা ছিল মাত্র ১৫০-২০০ জন, সেখানে এখন প্রতি বছর লক্ষাধিক পর্যটক ভিড় করছে এই দ্বীপে। এতে একদিকে পর্যটন সম্ভাবনা বিকশিত হলেও, অন্যদিকে হচ্ছে পরিবেশের বিপর্যয়।

যে প্রবালকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে স্বচ্ছ জলধারার, এই দ্বীপ এখন সেই প্রবালশূন্য হওয়ার পথে। গত চার দশকে এই দ্বীপে প্রবালের পরিমাণ কমেছে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ। প্রবাল কমে যাওয়ায় এই দ্বীপের আয়তনও কমা শুরু হয়েছে। পরিবেশবিজ্ঞানীদের ধারণা, এভাবে চলতে থাকলে ২০৪৫-৫০ সালের মধ্যে সেন্টমার্টিন দ্বীপ প্রবালশূন্য হয়ে বঙ্গোপসাগরে তলিয়ে যাবে। সম্প্রতি বেশ কিছু প্রতিবেদনে লক্ষ করা যায়, সেন্টমার্টিনে হোটেল-মোটেল ও আবাসিক স্থাপনা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিনিয়ত অতিরিক্ত পর্যটকের চাপ সামলাতে এই স্থাপনাগুলো গড়ে উঠছে। ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশ বিপন্ন হচ্ছে এবং নষ্ট হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। প্রবাল পাথরগুলোকে ভেঙে হোটেল নির্মাতাদের কাছে বিক্রি করছে স্থানীয় মানুষজন, যা সেন্টমার্টিনের অস্তিত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ।

ব্যক্তি বা বেসরকারি পর্যায়ের বিভিন্ন গবেষণালব্ধ ফলাফল আমাদের এই দ্বীপ সম্পর্কে অশনিসংকেত দিচ্ছে। স্থানীয় কিছু সংগঠন ও পরিবেশবাদী লোকজন এই বিষয়ে অল্পবিস্তর আলোচনা বা প্রতিবাদ করলেও হচ্ছে না কোনো প্রতিকার। তাদের ধারণা, কিছু প্রভাবশালী মহল সেন্টমার্টিনে নিজেদের ব্যবসায় প্রসারিত করতে গিয়ে চালাচ্ছে এক ধ্বংসলীলা। যেখানে ২০১২ সালে সেন্টমার্টিনে মাত্র ১৭-১৮টি হোটেল-রিসোর্ট ছিল, এখন সেখানে হোটেল-রিসোর্টের সংখ্যা ১৫০ ছাড়িয়েছে। সেন্টমার্টিনে একসময় দেখা যেত বিরল প্রজাতির সব কাছিমসহ অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণীর। অথচ এসব প্রাণী এখন চোখেই পড়ে না। কয়েক প্রজাতির কাছিমের অভয়ারণ্য ও প্রজননস্থান হিসেবে সেন্টমার্টিনের পশ্চিম বিচকে আলাদা করা হলেও এই বিচেও কমেছে কাছিমের আনাগোনা। স্বাভাবিক সময়ে এখন আর এখানে কাছিম দেখতে পাওয়া যায় না।

সম্প্রতি সেন্টমার্টিন দ্বীপের ভারসাম্য রক্ষায় ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন’ এলাকা ঘোষণা করে ভ্রমণে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। এতে বলা হয়েছে, অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন এবং পর্যটকদের অসচেতনতা, দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, পরিবেশ এবং প্রতিবেশবিরোধী আচরণের কারণে সেন্টমার্টিনের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত। পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যসহ দ্বীপটিকে টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০)-এর ৪ ধারার ক্ষমতাবলে সেন্টমার্টিনে ভ্রমণের ক্ষেত্রে এই বিধিনিষেধসমূহ আরোপিত হয়েছে। নিষেধগুলোর মধ্যে রয়েছে-দ্বীপের সৈকতে বাইসাইকেল, মোটরসাইকেলসহ কোনো ধরনের যান্ত্রিক ও অযান্ত্রিক বাহন না চালানো, সৈকত বা সমুদ্রে প্লাস্টিক বা অন্য কোনো ধরনের বর্জ্য না ফেলা, দ্বীপের চারপাশে নৌভ্রমণ না করা, জোয়ার-ভাটা এলাকায় পাথরের ওপর দিয়ে হাঁটাচলা না করা, সামুদ্রিক কাছিমের ডিম পাড়ার স্থানে চলাফেরা না করা, সৈকতে মাইক না বাজানো, হইচই এবং উচ্চ স্বরে গানবাজনা না করা, স্পিডবোট, ট্রলার কিংবা অন্যান্য উপায়ে ছেঁড়া দ্বীপে না যাওয়া, প্রবাল, শামুক, ঝিনুক, কাছিম, রাজকাঁকড়া, সামুদ্রিক শৈবাল এবং কেয়া ফল সংগ্রহ ও ক্রয়-বিক্রয় না করা।

এছাড়া সেন্টমার্টিনকে পর্যটনবান্ধব করতে এবং এর পরিবেশ বিপর্যয় রোধ করতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের বিভিন্ন পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে। যত্রতত্র হোটেল তৈরি না করে নিয়ন্ত্রিত ও মানসম্পন্ন স্বল্পসংখ্যক হোটেল তৈরি করা যেতে পারে। আধুনিক পয়োনিষ্কাশন-ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। সর্বোপরি দ্বীপটিকে পর্যটকদের কাছে নিরাপদ ও আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে, যাতে সেই সুন্দর স্থানটিকে কেউ নষ্ট করতে উদ্যত না হয়। মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরিতে স্থানীয় প্রশাসন, কোস্ট গার্ড, নৌবাহিনীসহ পরিবেশ অধিদপ্তরকে এগিয়ে আসতে হবে। সেই সঙ্গে পর্যটক হিসেবে আমাদের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে এবং পরিবেশকে ভালোবাসতে হবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

ইত্তেফাক/এসজেড