সুন্দরবনে বাঘের প্রজনন ও বংশ বৃদ্ধিসহ অবাধে চলাচলের জন্য গোটা সুন্দরবনের অর্ধেকেরও বেশি এলাকাকে সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষণা, টহল ফাঁড়ি বৃদ্ধি, চোরা শিকারিদের তৎপরতা বন্ধে আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর স্মার্ট পেট্রোলিং চালু, প্রজনন মৌসুমে সকল পাশপারমিট বন্ধসহ বাঘ সুরক্ষায় নানা পদক্ষেপ নিয়েছে বন বিভাগ।
এদিকে, সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে গত চার বছরে বাঘের সংখ্যা ১০৬ থেকে বেড়ে বর্তমানে ১১৪টি। অর্থাৎ গত চার বছরে সুন্দরবনের বাঘ বেড়েছে মাত্র ৮টি। সর্বশেষ বাঘ জরিপে সুন্দরবনে ১১৪ বাঘ রয়েছে বলে ক্যামেরা ট্রাকিং জরিপে উঠে এসেছে। এ অবস্থায় আজ (২৯ জুলাই) বিশ্ব বাঘ দিবস নিরবেই পালিত হচ্ছে।
বন বিভাগের সূত্র জানায়, ১৯৭৫ সালের জরিপে সুন্দরবনে বাঘ ছিলো ৩৫০টি। এরপর ১৯৮২ সালে জরিপে ৪২৫টি এবং ১৯৮৪ সালে সুন্দরবন দক্ষিণ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের ১১০ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় জরিপ চালিয়ে ৪৩০ থেকে ৪৫০টি বাঘ থাকার কথা জানানো হয়।
একইভাবে ১৯৯২ সালে ৩৫৯টি বাঘ থাকার তথ্য জানায় বন বভিাগ। ১৯৯৩ সালে সুন্দরবনরে ৩৫০ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় জরিপ চালিয়ে ধন বাহাদুর তামাং ৩৬২টি বাঘ রয়েছে বলে জানান। ২০০৪ সালে জরিপে বাঘের সংখ্যা ছিলো ৪৪০টি। ১৯৯৬-৯৭ সালের জরিপে বাঘের সংখ্যা উল্লেখ করা হয় ৩৫০টি থেকে ৪০০টি। ওই সময়ে বাঘের পায়ের ছাপ পদ্ধতিতে গণনা করা হয়। ২০১৫ সালের জরিপে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে বাঘের সংখ্যা আশংকাজনক হারে কমে দাঁড়ায় ১০৬টিতে। সর্বশেষ বাঘ জরিপে সুন্দরবনে ১০৬ থেকে বেড়ে বর্তমানে বাঘের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১১৪ টিতে।
প্রাণি বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবাদীরা সুন্দরবনের বাঘের মৃত্যুর জন্য ৯টি কারণ চিহ্নিত করেছেন। এগুলো হচ্ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ (ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হওয়া, মিঠাপানির অভাব, খাদ্য সংকট, বন ধ্বংস, বাঘের আবাসস্থল অভাব, চোরাশিকারি, অপরিকল্পিত পর্যটন ও বনের মধ্যে অনিয়ন্ত্রিত যান চলাচল। এর সাথে বাঘ রক্ষায় আবাসস্থল সংরক্ষণ, বনের মধ্যে নিয়ন্ত্রিত পর্যটনের বিকাশ, বিষ দিয়ে মাছ ধরা বন্ধসহ নানা সুপারিশ করেছেন তারা।
সুন্দরবন সহ ব্যবস্থাপনা নির্বাহী কমিটির সদস্য মো. সাইফুল ইসলাম গাজী বলেন, লোকালয়ে আসা বাঘ নিরাপদে ফিরাতে ইতিমধ্যে ব্যাপক জন সচেতনতা সৃষ্টি করা হয়েছে। যার ফলে এখন আর মানুষ বাঘ পিটিয়ে মারে না।
কয়রার সুন্দরবন মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি ইউপি সদস্য সরদার লুৎফর রহমান বলেন, সুন্দরবনে বাঘ বেড়েছে এটা নি:সন্দেহে খুশির বিষয়। বাঘের আবাসস্থল সুন্দরবনকে নিরাপদ করতে পারলে অবশ্যই বাঘের সংখ্যাবৃদ্ধি পাবে।
সুন্দরবনের বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র নিয়ে কাজ করা ‘সেভ দ্যা সুন্দরবন ফাউন্ডেশন’র চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, আশঙ্কাজনক হারে সুন্দরবনে বাঘ কমেছে। এটা বাঘের জন্য একধরনের হুমকি। তবে সুন্দরবনের ৫২ শতাংশ সংরক্ষিত বনাঞ্চলের শর্ত সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলে সুন্দরবনের অন্যান্য প্রাণীর সঙ্গে সঙ্গে বাঘও সাবলিল বিচরণ করতে পারবে। আর সাবলিল বিচরণের ফলে বাঘের প্রজনন বৃদ্ধি পাবে।খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজি এবং জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. এস কে আমির হোসেন বলেন, বাঘ প্রচন্ড ক্ষুধা না লাগলে লোকালয়ে আসে না। আর লোকালয়ে আসার ফলে অনেক বাঘের মৃত্যুর ঘটনা রয়েছে। এ কারণে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে গহীন বনে বাঘের খাদ্য নিশ্চিত করতে হবে।সেখানে বাঘের প্রজনন ঘটানোর চেষ্টা করতে হবে। সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) ড. আবু নাসের মোহসীন হোসেন বলেন, সুন্দরবনে বনদস্যুদের আত্মসমর্পন করে স্বাভাবিক জীবনে ফেরা ও চোরা শিকারিদের দৌরাত্ব্য কম হওয়ায় রয়েল বেঙ্গল টাইগার বা বাঘের সংখ্যা সর্বশেষ জরিপে বেড়েছে। ইতিমধ্যে বাঘের প্রজনন, বংশ বৃদ্ধিসহ অবাধ চলাচলের জন্য গোটা সুন্দরবনের অর্ধেকেরও বেশি এলাকাকে সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। সুন্দরবনকে বন্যপ্রাণীর জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ করতে কাজ করছে বন বিভাগ বলে তিনি জানান।
ইত্তেফাক/কেএইচ/এসজেড