দেশের স্বাস্থ্য খাতে আমূল পরিবর্তন এসেছে। বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোর অবকাঠামো-যন্ত্রপাতি আন্তর্জাতিক মানের। সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের আদলে আগারগাঁওয়ে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেস ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বিশ্বের কোথাও নিউরোর এত বড় স্পেশালাইজড হাসপাতাল নেই। এছাড়া দেশে নির্মিত হয়েছে শেখ হাসিনা ন্যাশনাল বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট। বিশ্বমানের এই ইনস্টিটিউটটি বিশ্বের মধ্যে সর্ববৃহৎ। মহাখালীর শেখ রাসেল জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউটটিও বিশ্বমানের বৃহতৎ একটি বিশেষায়িত হাসপাতাল। চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, ইএনটি ইনস্টিটিউটও আন্তর্জাতিক মানের।
দেশের সর্ববৃহৎ চিকিত্সাসেবা প্রতিষ্ঠান ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আরো ৫ হাজার বেডের অত্যাধুনিক ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। সিঙ্গাপুর মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্বমানের সেবা দিয়ে আসছে এই হাসপাতালটিও। বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বদিকে বাংলাদেশ বেতার ভবনে ২০ তলাবিশিষ্ট আরো দুটি অত্যাধুনিক ভবন নির্মিত হচ্ছে। তবে দেশে বিশ্বমানের চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকার পরও রোগীরা সেই মানের সেবা পাচ্ছেন না। বিশ্বমানের চিকিৎসকও আছেন, কিন্তু বিশ্বমানের সেবা মিলছে না। সেবা প্রদানে ঘাটতি অনেক। এ কারণে বিদেশমুখী হচ্ছেন রোগীরা।
বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকগণ বলেন, হাসপাতালের অবকাঠামো ও যন্ত্রপাতি আন্তর্জাতিক মানের হলেও এটা ধরে রাখতে অভিজ্ঞ জনবলের ঘাটতি আছে। এ কারণে মানুষ কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছে না। অধিকাংশ সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের রোগ নির্ণয় পরীক্ষায় ঘাটতি লক্ষণীয়। যোগ্য ও অভিজ্ঞদের দিয়ে হাসপাতাল পরিচালনা করা অতীব প্রয়োজন। কিন্তু এটা দীর্ঘদিন ধরে হচ্ছে না।
বিগত সরকারের আমল থেকে সরকারদলীয় ডাক্তাররা হাসপাতালের পরিচালক ও বিভাগীয় প্রধান হচ্ছেন। পদোন্নতিও তারাই পাচ্ছেন। এক্ষেত্রে যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয় না। আর তদবিরের মাধ্যমে হাসপাতাল পরিচালনার দায়িত্বে এসে তারা তদবিরেই ব্যস্ত থাকেন। পদ ধরে রাখার জন্য অনেক হাসপাতালের পরিচালক সারাক্ষণ তদবিরেই থাকেন, কেউ কেউ আবার শীর্ষ কর্মকর্তাদের বাসায় কাঁচাবাজার পৌঁছে দেন—এমন অভিযোগও রয়েছে। তাই এই শ্রেণির লোকদের কাছ থেকে ভালো কিছু আশা করা অবান্তর। তবে বর্তমান সরকারের আমলে এই অবস্থার অনেকটা অবসান হয়েছে। এখন যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে হাসপাতাল পরিচালক ও মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ নিয়োগ দেওয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন পদে পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোতে পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসাসেবা থাকতে হবে। যেমন, কোনো রোগী পঙ্গু হাসপাতালে যাওয়ার পর তার ডায়াবেটিস থাকলে তাকে ডায়াবেটিস হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে। অথচ পঙ্গু হাসপাতালে ডায়াবেটিসের ইউনিট থাকলে সেখানে দুই চিকিৎসাই হতে পারত। আগে দক্ষ ও অভিজ্ঞ জনবল নিয়োগ দিতে হবে, তারপর হাসপাতাল অবকাঠামো উদ্বোধন করতে হবে। নইলে দেখা যায়, হাসপাতাল উদ্বোধনের পর অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি দক্ষ জনবলের অভাবে দীর্ঘদিন ব্যবহার হয় না। এতে যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে যায়। এছাড়া চিকিৎসকদের মানসিকতার পরিবর্তন করে তাদের রোগীবান্ধব হয়ে উঠতে হবে। রোগীদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে হবে। তাহলে দেশীয় চিকিৎসায় রোগীরা আস্থা ফিরে পাবে। আর শুধু ঢাকায় নয়, জেলা-উপজেলার হাসপাতালগুলোতেও স্পেশালাইজড ইউনিট চালু করতে হবে।
স্বাস্থ্যবিষয়ক সহস্রাব্দ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশের অগ্রগতি বিস্ময়কর, যা প্রশংসিত হয়েছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। শিশু মৃত্যুর হার কমেছে, জন্মনিয়ন্ত্রণ একটা সন্তোষজনক জায়গায় এসেছে, মাতৃমৃত্যুর হার কমেছে, টিকাদান কর্মসূচি গতি পেয়েছে। তার পরও চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়া রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। প্রতিবছর দেশ থেকে রেকর্ডসংখ্যক রোগী যাচ্ছেন ভারতে। সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়াতেও অনেক রোগী যান। এতে কয়েক হাজার কোটি টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে। দেশি চিকিৎসক ও চিকিৎসা সংক্রান্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রতি রোগীদের আস্থায় ঘাটতি রয়েছে। জেলা-উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে মেশিন থাকলেও ডাক্তার থাকেন না। আবার অ্যানেসথেসিওলজিস্ট থাকলেও ডাক্তার নেই। ডাক্তার থাকলে আবার অ্যানেসথেসিওলজিস্ট নেই। হাসপাতালে নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ বিরাজ করছে।
ঢাকার বাইরের মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলোর চিত্রও এরকমই। কিছুসংখ্যক বেসরকারি হাসপাতালে উন্নতমানের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হলেও বেশির ভাগ বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাসেবার অবস্থা করুণ। তাই বিদেশে চিকিৎসা গ্রহণ করাটাকেই বিকল্প হিসেবে বেছে নেন অনেক বাংলাদেশি রোগী। শুধু বিত্তশালী নন, নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেক রোগীই নিজেদের সর্বস্ব বিক্রি করে দিয়ে হলেও বিদেশে চিকিৎসা নিয়ে নিরাপদ জীবনের নিশ্চয়তা খুঁজে পেতে চান। এই অবস্থা কাটিয়ে উঠতে হলে দক্ষ জনবল বাড়াতে হবে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা আরো বলেন, নার্সিংয়ে দক্ষ জনবল থাকার ওপর ছয় মাসের কোর্সধারী বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীন পেশেন্ট কেয়ার টেকনোলজিস্টদের নার্স হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে উন্নতমানের সেবা আসবে কীভাবে?
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ৪১টি বিভাগ দিয়ে যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগের সংখ্যা ৫৬টি। এমএস, এমডি ও ডিপ্লোমাসহ মোট ৯৭টি কোর্স চালু আছে। এরমধ্যে এমএস ও এমডি কোর্স ৫৮টি। বর্তমানে বেডের সংখ্যা ১ হাজার ৯০৬টি। বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বপাশে বাংলাদেশ বেতার ভবনে ‘এস্টাবলিশমেন্ট অব মাল্টি-ডিসিপ্লিনারি সুপার স্পেশালাইজড হসপিটাল আনডার বিএসএমএমইউ, ফেজ-২’-এর অধীনে ৯ একর জায়গায় অত্যাধুনিক দুইটি ভবন হবে ১ হাজার বেডের। দক্ষিণ কোরিয়ার ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন ফান্ড (ইডিসিএফ) এবং বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে ২০ তলাবিশিষ্ট এই দুইটি ভবন নির্মাণ করা হবে। বিএসএমএমইউ উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া বলেন, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে এই ভবনে ডাক্তার, নার্সসহ স্বাস্থ্য সেবাকর্মী পদায়ন করা হবে। কেউ তদবির করে এখানে আসতে পারবে না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, চিকিৎসাসেবায় অবকাঠামোর পাশাপাশি যোগ্য ও অভিজ্ঞ জনবলের প্রয়োজন। সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে সুপার স্পেশালাইজড জনবল থাকতে হবে। যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও জ্যেষ্ঠতার সঙ্গে কোনোভাবেই আপস করা যাবে না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, এখন থেকে আগে জনবল নিয়োগ, পরে অবকাঠামো—এই কনসেপ্ট নিয়ে স্বাস্থ্যে যে কোনো প্রকল্প গ্রহণ করা হবে।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেস ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. কাজী দীন মোহাম্মদ বলেন, দেশের ১৮ কোটি মানুষের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে তিনটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ—দক্ষতা, মানসম্মত ল্যাব ও গুণমানের ওষুধ। তিনি বলেন, দেশে চিকিৎসাসেবা খাতে যে অবকাঠামো হয়েছে তা কল্পনাতীত। এক্ষেত্রে মাইলফলক সৃষ্টি হয়েছে। এটা ধরে রাখতে হবে। দেশে কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট হয়, বাইপাস সার্জারি হয়। সব ধরনের চিকিৎসা দেশে আছে। ঝুঁকিপূর্ণ চিকিৎসার জন্য অভিজ্ঞ ডাক্তার, নার্সসহ জনবল থাকতে হবে। দেশে রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষায় ঘাটতি আছে। পাঁচটি ল্যাবে পরীক্ষা করলে পাঁচ ধরনের রিপোর্ট আসে। এতে রোগীরা বিভ্রান্ত হয়। দেশের ওষুধের গুণমান ভালো। তবে অনেক ওষুধ আছে, যা এখনো বাংলাদেশে আসেনি। অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যক্ষমতা হারিয়ে যাচ্ছে। এটার পালটা ওষুধ তৈরি হয়েছে; কিন্তু আমাদের দেশে তা আসেনি।
বিএমএ মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী দুলাল বলেন, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ৩১ শয্যা থেকে বেড়ে ৫০ শয্যায় উন্নীত হয়েছে। একইভাবে জেলা সদর হাসপাতালের বেডের সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে; কিন্তু সেইভাবে জনবল বাড়েনি। স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ বলেন, স্বাস্থ্যে অবকাঠামোর পাশাপাশি দক্ষ জনবল তৈরি করতে হবে। সাব-স্পেশালাইজড ডাক্তারদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে অর্থ ব্যবস্থাপনা ডি-সেন্ট্রালাইজেশনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
মুগদা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর বলেন, ওয়ান স্টপ সার্ভিসের মতো চিকিত্সাব্যবস্থা চালু করতে হবে। প্রত্যেকটি বিশেষায়িত হাসপাতালে সব ধরনের চিকিত্সাব্যবস্থা থাকতে হবে। চিকিত্সাব্যবস্থা বাণিজ্যিকীকরণ করা যাবে না।
ইত্তেফাক/এমআর