বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ঋতুকালীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার অন্তরায়

আপডেট : ১০ এপ্রিল ২০২১, ০২:১৭

বিশ্ব জুড়ে ঋতুকালীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা (Menstrual Hygiene and Health Management-MHM) নারী ও কিশোরীদের প্রজননকালের একটি প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। বয়ঃসন্ধিকালে মেয়েদের পিরিয়ড হওয়াটা স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় একটি প্রক্রিয়া। কিন্তু বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হয়েও ঋতুকালীন অনুশীলনগুলো এখনো অনেক সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় কুসংস্কার ও সীমাবদ্ধতার মুখোমুখি, যা মেয়েদের যথাযথ স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার পথে একটি বড় অন্তরায়।

বাংলাদেশে বিপুলসংখ্যক মেয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগামী। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত বাংলাদেশ ন্যাশনাল হাইজেন সার্ভে-২০১৮ অনুসারে, প্রায় ৫০ শতাংশ কিশোরী মেয়ে স্যানিটারি ন্যাপকিনের পরিবর্তে অস্বাস্থ্যকর পুরোনো কাপড় ব্যবহার করে। পিরিয়ডের সময় দেশের অনেক কিশোরীই স্কুলে যায় না এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে পরীক্ষায়ও অংশ নেয় না। কারণ, দেশের বেশির ভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঋতুকালীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাবান্ধব টয়লেট নেই। টয়লেটগুলোতে জরুরি স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারের সুযোগ থাকে না এবং ব্যবহূত ন্যাপকিন ফেলার জন্যও থাকে না কোনো স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবস্থা। অথচ গড়ে একজন শিক্ষার্থী পিরিয়ডের সময় সাত-আট ঘণ্টা স্কুলে থাকে সেজন্য স্কুলগুলোতে জরুরি স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারের সুযোগ থাকা দরকার। স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতি ছয় ঘণ্টা অন্তর ন্যাপকিন পালটানো দরকার, তা না হলে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে এবং নানা রোগ দেখা দিতে পারে।

বাংলাদেশ ন্যাশনাল হাইজেন সার্ভে ২০১৮-এর তথ্য মতে, স্কুল পড়ুয়া মেয়েদের স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারের হার ৬২ শতাংশ এবং বাকি ৩৮ শতাংশ এখনো স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করে না। অর্থাত্ এই তিন ভাগের এক ভাগ মেয়েদের হয়তো স্যানিটারি ন্যাপকিন কেনার সামর্থ্য নেই অথবা তাদের কাছে এগুলো সহজলভ্য নয়। জরিপে আরো উঠে এসেছে যে, ‘দেশের বেশির ভাগ স্কুলে মেয়েদের জন্য পৃথক এবং ব্যবহারের উপযোগী টয়লেট না থাকায় ঋতুকালে প্রতি ৩০ শতাংশ ছাত্রীকে প্রতি মাসে স্কুলে অনুপস্থিত থাকতে হয়।’ ফলে তারা এক দিকে ক্লাসে পিছিয়ে পড়ে, অন্য দিকে পরীক্ষার ফলাফলও খারাপ হয়।

এরকম পরিস্থিতিতে কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান জেলা সদর ভোলা ও চর উপজেলা রামগতিতে গত দুই-তিন বছরে প্রায় ৩০টি উচ্চবিদ্যালয় ও মাদ্রাসার এই বিষয়ে ব্যবহারিক কিছু কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে দেখার চেষ্টা করে, সমস্যাটা কোথায়? পর্যাপ্ত বিনিয়োগের অভাবে আলাদা টয়লেট স্থাপন হচ্ছে না। এটি দায়িত্বে নিয়োজিত সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের উদাসীনতা এবং সমস্যা সমাধানে এক ধরণের গাফিলতি বলেই অনেকে মনে করেন। দুটি বিষয় এখন পর্যন্ত প্রতীয়মান, একটি ঋতুকালে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে খোলামেলা আলোচনার অভাব এবং ন্যাপকিনের প্রাপ্যতা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। দ্বিতীয়ত, বিদ্যালয় ও বিদ্যালয়ের পানি-স্যানিটেশন বিষয়ক সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মনোযোগ, বাজেট বরাদ্দ এবং মনিটরিংয়ের অভাব। স্কুলসহ এই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বাজেট বরাদ্দের অপ্রতুলতা এবং সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা না থাকায় মূল টয়লেট বা পর্যাপ্ত HM friendly টয়লেট স্থাপন হচ্ছে না। এই পরিপ্রেক্ষিতে ভোলা ও রামগতির নির্ধারিত স্কুলগুলোতে AWIS (অ্যানোটেটেড ওয়াটার ইন্টিগ্রিটি স্ক্যানিং) টুলস নামের শুদ্ধাচারবিষয়ক কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর গবেষণার মাধ্যমে অংশগ্রহণকারীরা স্কুলের পানি, স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যবিধি সংক্রান্ত পাঁচটি প্রধান ক্ষেত্র চিহ্নিত করে। তারা স্যানিটেশন সুবিধার মান, জেন্ডার, ঋতুকালীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা (এমএইচএম), অন্তর্ভুক্তি ও বাজেট ব্যয় মূল্যায়ন এই পাঁচটি বিষয় স্থানীয়ভাবে তুলে আনে। এই গবেষণায় প্রতীয়মান হয় যে, পরিষেবা সরবরাহকারী/স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে শুদ্ধাচার অনুশীলন ব্যতীত স্কুলগুলোতে পানি, স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যবিধি সংক্রান্ত সংবেদনশীল পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। অপরাপর দেশসমূহের মতো বাংলাদেশও ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনে অঙ্গীকারাবদ্ধ। কিন্তু টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ১৭টির মধ্যে ঋতুকালীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়টি সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়নি। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট-৪ (সকলের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক গুণগত শিক্ষা নিশ্চিতকরণ এবং জীবনব্যাপী শিক্ষা লাভের সুযোগ সৃষ্টি) এ বিদ্যালয়ে আলাদা টয়লেটের কথা বলা হলেও এই বিষয়কে সুনির্দিষ্ট করা হয়নি।

এছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিষেবা সরবরাহকারী এবং গ্রহণকারীদের মধ্যে শুদ্ধাচারের (স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং অংশগ্রহণ) অভাব রয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক ২০১৫ সালে জারিকৃত বিদ্যালয়ের ওয়াশ বিজ্ঞপ্তি-২০১৫-তে বর্ণিত ১১ নির্দেশনায় ছাত্র ও টয়লেটের অনুপাত ১৮৭ ঃ ১-এর মতো রূঢ় বাস্তব চিত্র উঠে এসেছে। যদিও সেক্টর উন্নয়ন পরিকল্পনা (এসডিপি) ২০১১-২০২৫-এ ছাত্র ও টয়লেটের কাঙ্ক্ষিত অনুপত ৫০ ঃ ১ নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে এটি বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে; যেখানে ভোলা এবং রামগতিতে প্রায় ১২৬ জন শিক্ষার্থী একটি টয়লেট ব্যবহার করছে।

কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে মান নির্ধারণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটি অংশীদারদের জবাবদিহিতা এবং স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করে। ওয়াশ সেক্টর স্থানীয় সরকার বিভাগের অধীনে, কিন্তু বিদ্যালয়ের ওয়াশ সেক্টর দেখভাল করার জন্য নির্দিষ্ট কোনো কর্তৃপক্ষ নেই। বাংলাদেশ স্বাস্থ্য সুবিধা সমীক্ষা ২০১৪, বাংলাদেশ জনতাত্ত্বিক ও স্বাস্থ্য সমীক্ষা ২০১৭, বাংলাদেশ ডব্লিউএসএস সেক্টর ২০১২-এর জন্য জাতীয় স্বাস্থ্যবিধি প্রচারের কৌশল, এসডিজি ফিনান্সিং কৌশল ২০১৭-এ ওয়াশের ক্ষেত্রে বিনিয়োগে ঋতুকালীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার জন্য কোনো নির্দেশনা নেই। এটা দ্বারা স্পষ্ট হয় যে ঋতুকালীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে অধিকতর স্বচ্ছতার প্রয়োজন আছে।

সরকারের অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় প্রথম স্তরের স্বাস্থ্য কর্মী এবং উপযুক্ত এনজিও কর্মীদের মাধ্যমে স্কুল-ভিত্তিক সচেতনতা বৃদ্ধি কর্মসূচিসহ মেয়েদের জন্য স্যানিটারি ন্যাপকিনের পর্যাপ্ত সুবিধা রেখে ঋতুকালীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা কর্নার ও পরিষ্কারের উপকরণসহ অন্তর্ভুক্তিমূলক পৃথক টয়লেট সুবিধা নিশ্চিতকরণের ওপর গুরুত্বের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। কিশোর-কিশোরীদের বয়ঃসন্ধিকালীন প্রজননস্বাস্থ্য সংক্রান্ত ইস্যুতে তাদের সুরক্ষাকারীদের (পিতা-মাতা, অভিভাবক, শিক্ষক, ধর্মীয় নেতা, সহকর্মী, ইত্যাদি) আচার-আচরণে ইতিবাচক পরিবর্তন সৃষ্টি করার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

সরকারের উদ্যোগ, বিভিন্ন বিভাগগুলোর নীতি-সহায়তায় মনোযোগ ও সমর্থন ছাড়া পরিস্থিতি বদলানো কঠিন।

লেখক: গবেষণা পরিচালক, ডর্প

ইত্তেফাক/কেকে

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন