শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের ৫০ বছর: আমাদের স্মরণ, বিস্মরণ ও অনুসরণ

আপডেট : ০৭ মার্চ ২০২১, ১৩:৪৬

৭ মার্চের ভাষণ বাঙালি জাতির মুক্তি ও স্বাধীনতার ঘোষণাধ্বনি। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন ভাষণ নেই যার মাধ্যমে একটি রাষ্ট্র জন্ম লাভ করে। ১৯৭১ সালের পড়ন্ত বিকেলে যারা সেদিন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ প্রত্যক্ষ করেছেন, যারা শুনেছেন, যারা ভবিষ্যতে শুনবেন তারা জানেন এবং জানবেন সেদিন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দি উদ্যান) প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ভাষণ তাঁর সবটুকু প্রেরণা থেকে রচিত। যে প্রেরণায় মিশে ছিল সাড়ে সাত কোটি বাঙালির স্বাধীনতার আজন্ম লালিত স্বপ্ন। সেদিন বাঙালির স্বপ্ন বুননের দিনে ফাল্গুনের অস্তাচলগামী সূর্যের সাথে মিলিয়ে যেতে থাকে পাকিস্তানের চাঁদ তারকা খচিত ঝাণ্ডা।  

১৯৬৬ সালের ২৩শে মার্চ দৈনিক ইত্তেফাকের প্রচ্ছদে ছাপা হয় ‘আমাদের বাঁচার দাবী : ৬-দফা’। বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা বাঙালি জাতির স্বাধিকার আন্দোলনের ম্যাগনা কার্টা আর ৭ মার্চের ভাষণ স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্র। ৮ মার্চ ১৯৭১ দৈনিক ইত্তেফাক প্রধান সংবাদ করে ‘পরিষদে যাওয়ার প্রশ্ন বিবেচনা করতে পারি, যদি-’। দৈনিক আজাদীর শিরোনাম ‘রেসকোর্সে লক্ষ লক্ষ জনতার সমাবেশে শেখ মুজিব, চারি দফা শর্ত মানিয়া লইলে অধিবেশনে যোগদানের প্রশ্ন বিবেচনা করা যাইতে পারে।’ দৈনিক আজাদের প্রধান শিরোনাম ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’। দৈনিক সংবাদের শিরোনাম ‘সামরিক আইন প্রত্যাহার ও গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা দিলেই পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিব কি না ঠিক করিব, এবার স্বাধীনতার সংগ্রাম : মুজিব’। 

দৈনিক আজাদ এবং সংবাদ যথাক্রমে ‘মুক্তি’ ও ‘স্বাধীনতা’ শব্দদ্বয়কে যেভাবে উদ্ধৃত করে ইত্তেফাক বা আজাদীর শিরোনাম সে তুলনায় মৃদু। মার্চের সে উত্তাল ও অনিশ্চিত সময়ে সবকিছুই ঘটতে পারে এমন পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সারা জাতিকে প্রাণিত করেছিল। শিরোনাম আর ভাবনায় যাই থাকুক বাঙালি স্বাধীনতা অর্জনের সকল প্রস্তুতি পুরোদমে গ্রহণ করতে থাকে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ শ্রবণের পর হতেই। প্রস্তুতি আগেও চলছিল। তবে প্রাণপ্রিয় নেতার প্রকাশ্য ঘোষণা দোলা দিল সে প্রেরণায়। ৫০ বছর পূর্বে শোক ও সাহসে ঋদ্ধ যে শাণিত ভাষণ বঙ্গবন্ধু দিয়েছিলেন তা শুধু বাঙালি জাতির ইতিহাসেই নয়, মানবজাতির ইতিহাসে এক অমর মহাকাব্য। তখন এক সপ্তাহের মধ্যে দুইবার গভর্নর বদল হয়। লে. জে. সাহেবজাদা ইয়াকুব খানকে সরিয়ে বেলুচিস্তানের কসাইখ্যাত লে. জে. টিক্কা খানের নিয়োগ হয়। উর্দিধারী জেনারেল ইয়াহিয়া খান পূর্ববাংলাকে দেশ নয়, জোন ‘বি’ হিসেবে শাসন করতেন। সেই প্রতিকূল পরিবেশে, গুলি ও কামানের নলের ডগায়, লক্ষ লক্ষ জনতার মাথার উপর যুদ্ধ বিমান চক্কর দেওয়া সত্ত্বেও স্থির ও স্পর্ধ্বায় বঙ্গবন্ধুর যে ধ্বনি, মঞ্চে উচ্চারিত হয় তার প্রতিধ্বনি বাংলার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। 

সেদিন গুলি আর মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে, ‘কপালে কব্জিতে লালসালু বেঁধে’ মিছিলের পর মিছিল আছড়ে পরে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’তে আছে (পৃ. ২১-২২), ‘ রেসকোর্স মাঠের জনসভায় লোক হয়েছিল প্রায় ৩০ লাখের মতো। কত দূর-দূরান্তর থেকে যে লোক এসেছিল মিছিল করে, লাঠি আর রড ঘাড়ে করে- তার আর লেখাজোখা নেই। টঙ্গী, জয়দেবপুর, ডেমরা- এসব জায়গা থেকে তো বটেই, চব্বিশ ঘণ্টার পায়ে হাঁটা পথ পেরিয়ে ঘোড়াশাল থেকেও বিরাট মিছিল এসেছিল গামছায় চিড়ে-গুড় বেঁধে।’ অন্ধ ছেলেদের একটি দলও মিছিল নিয়ে এসেছিল সেদিন পাকিস্তান রাষ্ট্রের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিতে। তবে এই ক্ষোভ ও উত্তেজনার পারদ নিয়ে জনতার উপস্থিতি নিছক এক দিনের প্রস্তুতি নয়। এর শুরু হয় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ১ মার্চ মধ্যাহ্নে পূর্বঘোষিত ৩রা মার্চের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্ট কালের জন্য মুলতবি ঘোষণা করায়। ফলে ঢাকা স্টেডিয়ামে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম) 

চলমান খেলা মুহূর্তেই বন্ধ হয়ে যায়। সর্বত্র আন্দোলন আর মিছিল ছড়িয়ে পড়ে, ছাত্ররা ক্লাস বর্জন করে, পল্টন ময়দানে জনসভা হয়, হাজার পঞ্চাশেক জনতার উপস্থিতিতে হোটেল পূর্বাণীতে বঙ্গবন্ধুর সংবাদ সম্মেলন, ২ মার্চ ঢাকা এবং ৩ মার্চ সারা দেশে হরতাল ঘোষণা, ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে জনসভা আহ্বান- এক বিকেলেই যেন ২৩ বছর শোষণ আর বঞ্চনার ইতিহাস পরিসমাপ্তির উদ্যোগ হাতে নেয় বাঙালি জনতা। ইয়াহিয়ার এক ঘোষণায় বাঙালির মধ্যে যে ক্রোধ, ঘৃণা আর রোষের আগুন ছড়িয়ে পড়ে তাতে যত্রতত্র পুড়তে থাকে পাকিস্তানি পতাকা আর জিন্নাহর ছবি, দগ্ধ হতে থাকে পাকিস্তানি শাসকের তখৎ। তখন সমগ্র বাংলা যেন এক তপ্ত কড়াই। সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শোনার জন্য। কবি নির্মলেন্দু গুণের ভাষায়, ''অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে ভোর থেকে জন সমুদ্রের উদ্যান সৈকতে: ‘কখন আসবে কবি’? ...অত:পর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন। ...গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর-কবিতা খানি:" অগ্নি আর বারুদে মেশানো বঙ্গবন্ধুর সে অমর কবিতা বাঙালি জাতিকে অনুপ্রাণিত করল। 

চার খলিফাসহ ছাত্রদের দাবি ছিল সেদিনই স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার। অনেকেই মন্তব্য করেছেন স্বাধীনতার ঘোষণা না দিয়ে বঙ্গবন্ধু ঢাকা দখলের সুযোগ হেলায় হারালেন। অথচ সেদিন স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ ইঙ্গিত আর পরোক্ষ ঘোষণা দিয়ে তিনি সমগ্র দেশ দখল করেছেন। সৃষ্টি করেছেন একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র। জয় করেছেন বিশ্ব জনতার হৃদয়। সারা বিশ্বের বঞ্চিত সকল মানুষের হৃদয়াসনে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছেন। ১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল নিউজউইক ম্যাগাজিন তাঁকে ‘রাজনীতির কবি’ আখ্যা দিয়েছে। তারেক মাসুদ নির্মিত ‘মুক্তির গান’ প্রামাণ্যচিত্রের শুরু হয় ৭ মার্চের ভাষণের মাধ্যমে। ইউনেস্কো বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে ‘মেমরি অব দ্যা ওয়ার্ল্ড রেজিস্টার’ এবং বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য ঘোষণা করে ৩০ অক্টোবর ২০১৭। ব্রিটিশ অধ্যাপক জ্যাকব ফ্রান্জ ফিল্ড ২০১৩ সালে ‘উই শ্যাল ফাইট অন দ্যা বিচেস : দ্যা স্পিচেস দ্যাট ইন্সপায়ার্ড হিস্টরি’ বইয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে ২,৫০০ বছরের ইতিহাসের সাড়াজাগানো ভাষণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এরূপ বহু প্রামাণ্য রচনা ও গ্রন্থনা এ ভাষণকে করেছে অমর এবং শাশ্বত। 

তাৎপর্যপূর্ণ এ ভাষণ আমাদের জন্য আজও প্রেরণার। এ যেন ভাষণ নয়, রক্তে লেখা গাঁথা। পাকিস্তানের ২৩ বছরের শোষণ, বঞ্চনা আর নির্যাতনে সকল শহীদের রক্তে রচিত এ এক অমর কাব্য। যে মহাকাব্য ন্যায় এবং শোষিতের পক্ষে কথা বলে। অন্যায় ও অত্যাচারের বিপক্ষে বলে। সতর্ক করে ষড়যন্ত্রীদের ব্যাপারে যারা ছদ্মবেশে আত্মকলহ ও অরাজকতা করবে। দ্ব্যর্থহীনভাবে অর্থনীতি, রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক মুক্তির কথা বলে। আইনের শাসন ও সোনার বাংলা গড়ে তোলার কথা বলে। বলে মত-দ্বিমত ও ভিন্নমতের কথা। সংখ্যাধিক্য নয়, ‘যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজন যদিও সে হয় তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব’ বলে। এ এক চিরকালীন সত্য বাণী। ৭ মার্চের ভাষণ ৫০ নয় ৫৫০ বছর এবং তৎপরবর্তীতেও শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বলে যাবে। বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণ বাঙালি জাতির গর্বিত ইতিহাস। এ ইতিহাস বিস্মৃত হওয়ার নয়; স্মরণের, অনুসরণের।   

লেখক: পাবলিসিটি অফিসার,
বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউট, চট্টগ্রাম।

ইত্তেফাক/জেডএইচডি