বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

গল্প

আলোর মই

আপডেট : ০৭ জুলাই ২০২০, ১৩:৩৪

আকাশ দেখব।

আকাশ দেখব।

গলার স্বর বাড়তে থাকে। তারপর ঘুম ভেঙে যায়।

এতক্ষণ তাহলে স্বপ্ন দেখছিল উফা? উফা চোখ পিটপিট করে তাকায়। ঘরে ডিমলাইট জ্বলছে। নিশ্চয়ই স্বপ্ন। এখন রাত। এত রাতে আকাশ দেখবে কেন? নিজেকেই প্রশ্ন করে উফা। আসলে হয়েছে কি, উফার মন ভালো ছিল না। ইংলিশ টিচার তিতলি মেম বকা দিয়েছেন। ক্লাস টেস্টে নাম্বার কম পেয়েছে উফা। কতই বা কম? ইংলিশে ৯০% মার্ক পাওয়া কম কথা নয়। তবুও টিচার বকলেন। বাসায় এসে আম্মুকে সব খুলে বলল। আম্মুও বকা দিলেন।

মন খারাপ করে শুয়ে ছিল উফা। রাতের খাবারও খাবে না। আব্বু গিয়ে ডাকলেন। তখন আর ‘না’ বলতে পারল না। কারণ আব্বু হলো জগতের সেরা আব্বু। আদর করে ওর নাম রেখেছেন উফা। ইংরেজিতে UPHA বানান। UFA রাখলেও হতো। কী ব্যতিক্রম বানান। তবে মেডিকেল ভাষায় বেশি ব্যবহৃত। যেমন—Pharmecy, Photo, Phone ইত্যাদি। যেসব বানান PH না হয়ে F হলেও চলত। উফার কাছে তেমনটাই মনে হয়। ওর ছোট বোনের নাম নুফা। ইংরেজিতে NUFA বানান। আব্বুকে জিজ্ঞেস করলে তিনি যুক্তি দিয়েছেন। বাংলায় দু বোনের নাম দু অক্ষরে। ইংরেজিতে দু বোনের নাম চার অক্ষরে। এ জন্যেই নুফার নামে PHA ব্যবহার করা হয়নি। আব্বু কথা বলেন খুব মজা করে। তার শিল্পী-মন। তিনি একজন চিত্রশিল্পী। দৈনিক পত্রিকায় চাকরি করেন। শিল্পী কুদ্দুস মাহমুদ। সুন্দর সুন্দর ছবি আঁকেন। ছোটদের বইয়ের প্রচ্ছদ করেন। ছোটদের ভালোবাসেন। কত মজার মানুষ আব্বু। আব্বুর কথা না শুনে পারেই না উফা।

আব্বু বললেন, উফা মামণি, উঠে এসো। খেতে খেতে মজার গল্প করব।

 

উফা আনন্দ নিয়ে উঠে এল। গল্প শোনার আনন্দ। তাড়াতাড়ি খেয়ে আবার শুয়ে পড়তে হবে। সকালে ক্লাস আছে। যেতে দেরি হলে ঝামেলা। শহীদ আনোয়ার গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়ে। নিয়ম বেশ কড়া। উফা ক্লাস থ্রি-তে পড়ে। সামনেই ফাইনাল পরীক্ষা। ক্লাস ফোর অপেক্ষা করছে ওর জন্য। ডাইনিং টেবিলে বসে হেসে বলল, আব্বু গল্প করো।

নুফাও ওর সাথে সুর মিলিয়ে বলল, আব্বু গল্প কলো।

পিচ্চি নুফার কথায় সবাই হাসে। আম্মুও মুখ টিপে হাসেন। কুদ্দুস সাহেব বললেন, গল্পটা আমি মুখে করব না। সবাই অবাক হয়ে আব্বুর দিকে তাকায়। আব্বু বলেন, গল্পটা আমি এঁকে এঁকে বলব।

এঁকে এঁকে গল্প বলা? আশ্চর্য হয় উফা। ও নিজেই দৌড়ে গিয়ে কাগজ আর রং পেনসিল নিয়ে আসে। কুদ্দুস সাহেব আঁকলেন একটি আকাশ। সেই আকাশে একটি ছোট্ট বাঁকা চাঁদ। আঁকতে আঁকতে তিনি বলেন, এই চাঁদটি হলো আমার উফা মামণি। এই বলে তিনি একটি লাল কলম হাতে নিলেন। চাঁদের এক পাশ ঘিরে লিখলেন ‘UPHA’। উফা এটা দেখে আশ্চর্য হয়ে বলল, ওয়াও!

: এবার হবে মজার খেলা।—বললেন কুদ্দুস সাহেব।

উফা জিজ্ঞেস করল, কী খেলা আব্বু?

নুফা আগের মতো বলল, কী কেলা আব্বু?

আব্বু বললেন, খেলাটা খেলতে হবে উফাকে। আগে খেয়ে নাও তারপর বলব। সব খেলারই নিয়ম আছে। এই খেলার নিয়ম বলে দেবো।

 

এখন শুরু হলো সেই মজার খেলাটি। কোথাকার গল্প কোথায় চলে গেল। গল্প এখন খেলায় রূপ নিয়েছে। আব্বু বললেন, কাগজের আকাশ বাদ। আমরা চলো আসল আকাশে যাই।

সেখানে গিয়ে চাঁদের গায়ে মোটা মোটা লাল অক্ষরে আব্বু লিখলেন, UPHA । উফা এবার আরো অবাক। চাঁদটি বড়ো হতে থাকে, UPHA বড়ো হতে থাকে। চাঁদটি অর্ধবৃত্ত হয়, UPHA বাঁকা হয়ে অর্ধবৃত্ত হয়। বাহ্! দারুণ ব্যাপার।

আব্বু হাসছেন। আম্মু হাসছেন। নুফা হাততালি দিচ্ছে। নুফা ইংরেজি জানে না। পড়তে পারে না। আম্মু ওকে বুঝিয়ে বলেছেন উফাকে চাঁদে দেখা যাচ্ছে। মজা করে বলছে এ-লে, চাঁদেল গায়ে আফু!

উফা ওর হাত ধরে হাততালি থামাল। বলল, দেখ দেখ । চাঁদ যত বড়ো হচ্ছে তত মজা লাগছে।

আব্বু বললেন, দেখো না শেষটায় কী হয়?

 

চাঁদ আরো বড়ো হতে লাগল। এবার UPHA ফাটতে শুরু করল। UPHA মানে লেখাটা ফাটতে শুরু করল। যেভাবে কম্পিউটারে ছবি বড়ো করলে ফাটে। আব্বু বলেছেন এটা রেজুলেশনের কারণে। উফা রেজুলেশন বোঝে না। আব্বু বুঝিয়ে দিয়েছেন। আব্বু অনেক কঠিন কথাও সহজ করে বুঝাতে পারেন।

একটি ছোট জিনিসের যে ক্ষমতা, বড়ো জিনিসের তুলনায় কম। ছোট কোনো কিছুকে বড়ো করলে তার সহন ক্ষমতা থাকে না। সে ফেটে যায়, অথবা ছিঁড়ে যায়, অথবা ভেঙে যায়। যার যে স্বভাব। চাঁদটি ধীরে ধীরে পূর্ণ চাঁদ হয়ে গেল। ফুটবলের মতো গোল। এখন লেখা বেশি করে ফেটে যাচ্ছে। মনে হলো লাল অক্ষর চারটি ফেটে রক্ত ঝরছে। চাঁদের গা ঘেঁষে গড়াতে লাগল। এরপর আকাশে ছড়াতে শুরু করল। যত ছড়াচ্ছে ততই যেন আকাশ ঝলমল করে উঠছে। আর মনে হলো লাল আগুন চাঁদের চারপাশে বেশি দূর ছড়িয়ে পড়ল। আকাশের খানিক অংশ বিভিন্ন রং ধারণ করল। লাল, হলুদ, নীল, সবুজ, ধূসর, বেগুনি, কমলা, টিয়া নানা রং। কিছু জায়গা হালকা রং, কিছু জায়গা গাঢ়। এত রঙের ছড়াছড়ি কেউ কখনো দেখেনি। আব্বু চিৎকার করে বললেন, কে কোথায়? সবাই দেখে যাও, আমার একটি মেয়ে কত রং বানিয়েছে?

 

সেখানে কেউ নেই। কে শুনবে আব্বুর কথা? কিন্তু আব্বু ঠিক কথা বলেছেন। বানানো রঙের মজাই আলাদা। উফা এত রং দেখে হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছে না। ও বলল, আব্বু চলো আমরা বাড়ি ফিরে যাই। আব্বু বললেন, কতদিন পরে চাঁদে মানুষ এল। সেই কবে নীল আর্মস্ট্রং, এডউইন অলড্রিন আর মাইকেল কলিন্স এসেছিল। চাঁদ কত খুশি হয়েছে দেখ। খুশিতে আলো ঢেলে দিচ্ছে। সেই আলো নীল-সাদা-ধূসর আকাশকে রাঙাচ্ছে। কত রঙে, কত ঢঙে। কী মজার শিল্প! আমি এমন ছবি জীবনেও আঁকতে পারিনি।

উফা বলল, এই ছবি দূর থেকে দেখলে আরো ভালো লাগবে। চলো আমরা পৃথিবী থেকে আকাশ দেখব।

উফার কথাটা মেনে নেবার মতো। আব্বু বললেন, ঠিক আছে চলো নেমে যাই। তখন দেখা গেল, যে মই বেয়ে তারা চাঁদে উঠেছিল, সেটা নেই। এখন কী উপায়? এত দূর থেকে পৃথিবীতে কী করে নামবে উফা? ওরকম মই বানানো সম্ভব নয়। আলোর মই কি সহজে বানানো যায়? আম্মু কান্না শুরু করলেন। দেখাদেখি নুফাও কাঁদতে লাগল। আব্বু তখন স্থির। হয়তো বুদ্ধি খুঁজছেন। নামতে হবেই। না হলে এখানে কী খেয়ে বাঁচবে তারা? উফা তো তখন খেতেই চাইছিল না। এখন খাওয়ার চিন্তাও করছে। আকাশ মানুষকে কত আপন ভাবে। কতকিছু শেখায়। আব্বু বললেন, চলো আমরা একসাথে লাফ দেই।

আম্মু চেঁচিয়ে বললেন, আমার মেয়ে দুটোর হাত-পা ভাঙবে না?

: হাত-পায়ের চেয়ে জীবন বড়ো। আগে বেঁচে থাকা।

আম্মুকে কোনোমতো রাজি করানো হলো। সবাই মিলে একসঙ্গে লাফ। চিৎকার দিয়ে উঠল উফা। কোথায় পড়েছে বুঝতে পারছে না। চোখেও কিছু দেখছে না। তখনই শুরু করল কান্না, আকাশ দেখব। আকাশ দেখব।

 

আব্বু-আম্মু দুজনেই ছুটে এলেন উফার ঘরে। উফা খাটের ওপর পা গুটিয়ে বসে আছে। ঘরের মেঝেতে কুদ্দুস সাহেবের আঁকা সেই ছবিটা। চারপশে অনেক রং পেনসিল। ছবিটা এখন একটু অন্যরকম। আকাশ শুধু নীল-সাদা আর ধূসর নেই। চাঁদটার চারপাশে নানা রং। চাঁদটাও ঈদের চাঁদের মতো বাঁকা নেই। পূর্ণ চাঁদ, গোলাকার। তবে সেটা চাঁদ কি না বুঝার উপায় নেই। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে কুদ্দুস সাহেব হাসলেন। তিনি খেলার নিয়ম বলতে বলেছিলেন—চাঁদের সাথে ‘UPHA’ লেখা থাকল। বাকিটা উফা নিজেই বানাবে। তারপর আবার আমি নতুন কিছু এঁকে দেবো।

উফা আব্বুকে কাছে ডেকে নিল। বলল, আব্বু, আলোর মই বানানো যায় না?

কুদ্দুস সাহেব বুঝতে পারলেন উফা এখনো আকশে আছে। চাঁদের সাথে। তিনি বললেন, আলোর গতি কত জানো মামণি?

উফা বলল, ১ লক্ষ ৮৬ হাজার মাইল প্রতি সেকেন্ডে। ২,৯৯,৩৩৮ কিলোমিটার।

 

বাবা-মেয়ে দুজনেই একসঙ্গে হেসে ফেলল। তার মানে কেউই ঘোরের মধ্যে নেই। আম্মু হেসে বললেন, এবার দুজন আলোর মই নিয়ে গবেষণা করো।