বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

নাটক বিষয়ে

দুখু মিয়ার নাটক

আপডেট : ০১ সেপ্টেম্বর ২০২০, ২০:৩১

ছোট্ট বন্ধুরা, তোমরা সব্বাই জানো যে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি কিন্তু বিদ্রোহ করেছিলেন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে। তাই তাঁকে বলা হয় বিদ্রোহী কবি। শুধু বিদ্রোহী নয়, তাঁকে সাম্যের, কুলি-মজুরের, স্বাধীনতাকামী, সর্বহারার, শিশু-কিশোরদের ইত্যাদির কবিও বলা হয়। আমাদের জাতীয় কবি শুধু কবিতাই লিখেননি। তিনি গল্প লিখেছেন, লিখেছেন উপন্যাস, নাটক, ছড়া, গান, চিঠি। এমনকি অনুবাদও করেছেন। গেয়েছেন গলা ছেড়ে গান। অভিনয়েও পটু ছিলেন তিনি।

 

আমাদের এই কবির ছোট্টবেলায় নাম ছিল দুখু মিয়া। তেমন একটা সচ্ছল ছিল না তাঁর পরিবার। আর দুখু মিয়াও ছিলেন বাউণ্ডুলে ধরনের। স্কুল-কলেজের শিক্ষা তেমন একটা গ্রহণ করেননি। শিখেছেন আশপাশের সবকিছু থেকে। ভেবেছেন দেশ, জাতি আর দেশের মানুষের জন্য। ছোট্টবেলা থেকে গল্প লিখতেন। এরপর লিখতে শুরু করেছিলেন কবিতা, নাটক, গল্প ও উপন্যাস। 

 

আমাদের এই প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম মাত্র বিয়াল্লিশ বছর বয়সে পিকস নামক একটি দূরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে লেখালেখির জীবন থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েন। তবে তাঁর এই বিয়াল্লিশ বছরের জীবনে শুধুমাত্র বড়োদের জন্য লেখেননি। লিখেছেন তোমাদের জন্যও। কেননা তিনি তোমাদের মতো কচি-কাঁচা শিশুদের খুবই স্নেহ করতেন, ভালোবাসতেন। দেশ, জাতি ও স্বাধীনতা নিয়ে ভাবলেও তোমাদের মতো আগামীর সৈনিকদের নিয়ে বেশকিছু লেখালেখি করেছেন। তোমাদের কথা চিন্তা করে বিদ্রোহী সেই কবি নরম কোমল ভাষায় লিখেছেন ছড়া, কবিতা, গল্প, উপন্যাস ও নাটক। 

 

তাঁর ছড়া পাঠে যেমন তোমরা দুলে ওঠো, কবিতা ও গল্পপাঠে তেমনি আলোড়িত হও, নাটক পাঠ করে ও দেখে হও আনন্দিত। 

 

নাটক হচ্ছে কোনো একটি ঘটনা বা বিষয়কে দর্শক-শ্রোতার সামনে বাস্তবায়ন করে দেখানো। এখানে ঘটনার চরিত্রগুলো তাদের ক্রিয়াকলাপ করে দেখান। তোমরা অনেকেই বানর নাচ দেখেছ। সেটাও কিন্তু নাটক। আর নাটিকা হচ্ছে নাটকের থেকে কম সময়ের।

 

আমাদের দুখু মিয়া তোমাদের মতো কচিমনের ভাবনা ও ক্রিয়াকলাপ নিয়ে সহজ ভাষায় পাঁচটি নাটিকা লিখেছেন। যেখানে ছোট্ট ছোট্ট শিশুরা হেসেছে, খেলেছে, কেঁদেছে, ঘুরে বেড়িয়েছে, নির্মাণ করেছে, ইচ্ছের বাস্তবায়ন করেছে। 

 

ছোট্ট বন্ধুদের জন্য আমাদের প্রিয় কবি ও নাট্যকার নজরুল সবথেকে সুন্দর নাটিকা উপহার দিয়েছেন ‘পুতুলের বিয়ে’ শিরোনামে। তোমরা কি পুতুল খেলো? আমি যা দেখি তাতে তোমরা তোমাদের বাবা-মা’র মোবাইল ফোনে নানাধরনের গেম খেলে থাকো। যেমন : পাবজি, ফ্রি ফায়ার আরো কত্ত গেম। তোমরা তোমাদের বাবা-মা বা দাদা-দাদিকে জিজ্ঞেস করে দেখবে যে, তারা পুতুল খেলতেন কি না? পুতুল খেলায় কত্ত যে মজা ও আনন্দ তা খেললে বুঝতে। 

 

সকালবেলা খাওয়া দাওয়া শেষ করে গ্রামের একটি বড়ো গাছের নিচে একে একে সব ছোট্ট ছেলেমেয়েরা পুতুল নিয়ে জড়ো হতো। অতঃপর চলত সেই পুতুল নিয়ে খেলা। পুতুলকে গোসল করানো, খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো আরো কত কী! আর মাঝে মাঝে পুতুলের বিয়ে দিত। ওসব পুতুল কিন্তু দাদি-মায়েরা তৈরি করে দিতেন। তোমাদের এখনকার টেডি বিয়ারের মতো শপিংমল থেকে কেনা হতো না। তাই সে পুতুলগুলোর প্রতি থাকত এক অন্যরকম ভালোবাসা।

 

কী, তোমাদের পুতুল নিয়ে খেলতে ইচ্ছে হচ্ছে না? পুতুল তৈরি করে বা কিনে নিয়ে কয়েকজন মিলে খেলে দেখো কত্ত মজা! তবে এখন শুনো আমাদের দুখু মিয়ার সেই পুতুলের বিয়ে নাটিকার ঘটনা। নাটিকাটিতে সাতটি চরিত্র আছে। যেমন : কমলি, টুলি, খেঁদি, বেগম, পঞ্চি, মণি ও পুরুত। কমলি আর মণি ভাই-বোন। কমলির দু’টো ছেলে পুতুল। একটা চীনা পুতুল, নাম তার ফুচুং। আর একটা দেখতে দেশীয় ছেলেদের মতো সুন্দর আর নাদুসনুদুস। নাম তার ডালিমকুমার। টুলির একটি মেয়ে পুতুল, নাম তার পুটু রানী। জাপানি গেঁইসা নামে একটি মেয়ে পুতুল ছিল বেগমের। 

 

যেহেতু ডালিমকুমার সুন্দর তাই টুলু তার পুটু রানীকে তার সাথে বিয়ে দিতে চায়। কিন্তু কমলি চায় যে, ফুচুং-এর সাথে বিয়ে হোক। কিন্তু মেয়ের মা মানে না। ছেলের মাও কষ্ট পায় তার ছেলে চীনা বলে কেউ তার কাছে মেয়ে দিতে চায় না৷ বেগমও তার জাপানি মেয়ে গেঁইসা-র জন্য ডালিমকুমারের মায়ের সাথে পাক্কা কথা নিয়েছিল, কিন্তু এখন কুমারের মা আর সেকথা রাখতে পারছে না। বাধ্য হয়েই চীনা ধরনের ফুচুং-এর সাথে জাপানি ধরনের গেঁইসা-র বিয়ে ঠিক হয়। তখন কমলির ভাই মণি এসে কী এক হিডিমিডি চাইনিজ ধরনের মন্ত্র পড়ে। বলে, এই মন্ত্রে তাদের বিয়ে হবে।

 

ডালিমকুমার আর পুটু রানীর বিয়ের জন্য লগ্ন দেখতে হবে। ডাকতে হবে পুরুহিত বা পুরুতকে। পুরুতকে ডেকে এনে লগ্ন ঠিক করে বিয়ে পড়ানো হলো। এখানে মণি ভিলেন ধরনের চরিত্র। 

 

বন্ধুরা, নাটিকাটি আমাদের যা শিখায়, তা হচ্ছে, আমরা মানুষকে মানুষ ভাবব। গোত্র বা ধর্ম দিয়ে আলাদা করব না। খেলার মাঠে থাকবে না কোনো ধনী-গরিব ভেদাভেদ। আর আপনজন যে ধরনের হোক না কেন-যেমন প্রতিবন্ধী বা দেখতে অসুন্দর তাদেরকেও ভালোবাসতে হবে। নাটকটি যদি তোমরা পড় বা দেখ তাহলে দেখবে বিয়ের কত্ত গান, আনুষ্ঠানিকতা।

 

আমাদের জাতীয় কবির আরেকটি শিশুদের জন্য নাটিকা হচ্ছে ‘জুজুবুড়ির ভয়’। মায়েরা সাধারণত তোমাদের ঘরে আটকে রাখতে চান। দুপুরে পড়াতে বসাতে চান। এমন মায়েরা তাদের শিশুদেরকে যে ডাইনি বুড়ি বা জুজুবুড়ির ভয় দেখান তা-ই এ নাটিকায় তুলে ধরেছেন। আসলে জুজুবুড়ি বলতে যে কিছু নেই তা তোমরা এ নাটিকা পড়লে বুঝবে।

 

আচ্ছা বন্ধুরা, তোমরা কি কানামাছি খেলো? কানামাছি খেলে দেখো হাসতে হাসতে পেটে খিল লেগে যায়। অন্যকে খুঁজতে যেয়ে যে কী পেরেশানি! আবার শক্ত কোনোকিছুর সাথে গুঁতো খাওয়ার আশঙ্কা আছে কিন্তু। এই আনন্দের খেলা নিয়ে সুন্দর একটি নাটিকা লিখেছেন নজরুল।

 

বন্ধুরা, বাবা কি তোমাদের শাসন করেন? যতক্ষণ বাড়িতে থাকেন শুধু পড়া আর পড়া। এরকম বাবাকে তোমরা কীভাবে ফাঁকি দাও, বাবা বাড়িতে না থাকলে কীরকম আনন্দ লাগে, ছুটির দিনে কী মজা হয় তা-ই না? আমাদের দুখু মিয়া কিন্তু সেই ভাবনা ভেবে ছোট্ট মানুষ সেজে মজার একটি নাটিকা লিখেছেন ‘নবার নামতা পাঠ’ নামে। এই নাটিকার শেষের ছড়ার কয়েকটি লাইন পড়ো আর হাসো,

 

‘আমি যদি বাবা হতুম, বাবা হত খোকা,

না হলে তার নামতা পড়া,

মারতাম মাথায় টোকা।’

 

সাগরের নিচে কত্ত ঝিনুক মুক্তো তা আজ তোমরা ডিসকভারি বা ন্যাশনাল জিওগ্রাফিতে দেখে থাকো। কিন্তু আজ থেকে একশো বছর আগে তো তা ছিল কল্পনার বাইরে। কিন্তু আমাদের জাতীয় কবি কী রকম জ্ঞানী মানুষ ছিলেন যে সেসময়ই কল্পনার জগতে ছোট্ট কঙ্কনকে ভাসিয়ে নিয়ে পরির মাধ্যমে সাগরতলের মণি-মুক্তা দেখিয়েছেন। নাটিকাটির নাম ‘জাগো সুন্দর চিরকিশোর’। দুই অঙ্কের নাটিকাটি পাঠে তোমরা নিজেদেরকে জাগিয়ে তুলবে। কাজ করবে বেশি বেশি। অলসতা করবে না।

 

তাই বন্ধুরা, আসো আমাদের জাতীয় কবির নাটিকা পাঠ করে নিজেদের খেলার মাঠে ফিরিয়ে নিয়ে যাই। ঘরে বসে আর থাকব না। জুজুবুড়ি বলতে কিছুই নেই। কানামাছি, গোল্লাছুট, কিৎ কিৎ, সাঁতার ইত্যাদি খেলায় মেতে উঠব। বাবা-মায়ের আদর নিয়ে ভালো মানুষ হব।