শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

গল্প

ইঁদুর খেল বেড়ালকে

আপডেট : ০৭ নভেম্বর ২০২০, ২০:৪৪

এক ছিল অলস বেড়াল। অলস হলেও সে ছিল বেশ অহংকারী। গ্রামের এক মোড়লের বাড়িতে ছিল তার যাতায়াত। তিন বেলা বেড়ালটা আসত। বিশেষ করে মোড়লের বাড়ির সবাই যখন খেতে বসতো। সকাল, দুপুর এবং রাত্রে খাবারের সময় হলেই হাজির হতো বেড়ালটি। সেই বাড়িতে একটা গর্তে বাস করত একদল চতুর ইঁদুর। একদিন বেড়ালটাকে মোড়লের বাড়িতে আসতে দেখল, একটা পুঁচকে ইঁদুর। সে-ই প্রথম দেখল বেড়ালটিকে। এর আগে কখনো, কোনো ইঁদুর দেখেনি। ইঁদুরটির নাম ছিল বিষুপি। বেড়ালটিকে দেখে আড়ালে গিয়ে লুকিয়ে যায় সে। পরে বিষুপি নিঃশব্দে হাঁটতে হাঁটতে ঘরের পেছন দিয়ে একেবারে একটা সরু গর্তে গিয়ে ঢুকে পড়ল। সে-সময় গর্তে বসে ধ্যান করছিল ইঁদুর রানি ইকুনি। বাকিগুলো নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত ছিল। চঞ্চলা বিষুপিকে এমন নিঃশব্দে ঢুকতে দেখে তারই সহোদর বিষুজ বলল,

কিরে বিষুপি, কী হয়েছে?মুখখানা পাটকাঠির মতো শুকনা করে এমন নিঃশব্দে আইলি যে।

বিষুপি চোখ দুটো গোলগোল করে বলল,

দাদা, জানো, পানি আনতে গিয়ে দেখি ইয়া বড়ো মোটাতাজা একটা বেড়াল মোড়লের বাড়ির দিকে আসছে। তাকে দেখে কলতলার ওপাশে খড়ের গাদাটার আড়ালে লুকিয়ে গেলাম। কান দুইটা খাড়া খাড়া। বড়ো বড়ো গোঁফ। আর লেজটা পিঠের ওপর তুলে হেলে দুলে মোড়লের বাড়িতে ঢুকে পড়ল। একটুর জন্য প্রাণে বেঁচে গেলাম।

বলেই ক্যাঁচরম্যাচর করে কাঁদতে লাগল বিষুপি। বিষুজ ছোট বোনকে কাছে টেনে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,

ভয় করিস না। রানিকে এই বিষয়টা জানিয়ে একটা ব্যবস্থা নিতে হবে।

শতেকখানেকের মতো ইঁদুর বাস করত সেই গর্তে। বছরখানেক আগে ইকুনিকে সবাই রানি নির্বাচিত করে। এই ইঁদুরের দলটি একটা ভয়ংকর বিপদের বেড়াজালে পড়ে। হঠাৎ কোথা থেকে একটা অজগর সাপ এই গর্তে ঢুকে পড়ে। সাপ দেখে তো সবার ভেতর ধুকপুকুনি শুরু হয়। হার্টবিট বেড়ে গেল সকলের। সবাই ছোটাছুটি করতে লাগল মহামূল্যবান প্রাণ বাঁচাতে। অজগর ফণা তুলে ফুঁসফুঁসিয়ে উঠল। কেউ সাহস করে তার সামনে যেতে পারে না। সে সময় ইকুনি ধ্যানে ছিল। বয়স্ক হওয়ায় কোথাও যেত না। ধ্যানে মগ্ন হয়ে তার বেশির ভাগ সময় কেটে যেত।

সবার চিল্লাচিল্লি শুনে বর্ষীয়সী ইকুনি বের হয় তার ঘর থেকে। বেরিয়ে অজগরকে দেখে তারও চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। ভয়ের চোটে ঢোক গিলতে গিলতে কণ্ঠনালী শুকিয়ে কাঠ। ঘরে ঢুকে, ঢকঢক করে জলপানে গলা ভিজিয়ে নিল সে। তারপর বুকের ভেতর পাহাড় সমান সাহস নিয়ে অজগরের সামনে দাঁড়াল। ইকুনি মাথা নত করে কুর্নিশ করল অজগরকে। জোড়হাতে মিনতি করে বলল,

অজগর ভাই, আমরা নিরীহ ইঁদুরেরা কোনোরকমে এখানে থাকি। আপনার মতো বিশাল দেহের সাপকে কি আমাদের সঙ্গে থাকা সভ্য হবে?

অজগর সাপটি ছিল একটু আলাভোলা টাইপের। লেজ নাড়াতে নাড়াতে বলল,

আসলে, আমি এখানে থাকার জন্য আসিনি তো। এই পথ দিয়ে রাস্তার ওপারে মাকে খুঁজতে যাচ্ছিলাম। মা রাস্তার ওপারে খড়বনে খাবারের সন্ধানে গেছে অনেকক্ষণ হয়ে গেল। কিন্তু এখনো ফিরে আসছে না। এদিকে ক্ষুধায় আমার পেটও চোঁ চোঁ করছে। মা কোনো বিপদে পড়ল কি না, তাই খোঁজে যাচ্ছিলাম। কিন্তু হঠাৎ কোথা থেকে ব্যাটা পাজি বেজিটা সামনে পড়ে গেল। তাই জীবন বাঁচাতে প্রাণপণে দৌড়ে এই গর্তে ঢুকে পড়ি।

অজগরের মুখে এই কথা শুনে বয়স্ক ইকুনি ভয়কে জয় করে বলল,

অজগর ভাই, যখন এই গরিবের দরজায় পা পড়েছে, কিছু খেয়ে যান।

ইকুনি ব্যস্ত হয়ে পড়ল, অজগরকে খাওয়ানোর জন্য। ইকুনি কিচকিচ শব্দে সবাইকে ডেকে বলল,

যার ঘরে যে খাবার আছে, সবাই নিয়ে এসো। অজগর ভাইয়ের পেটে ভীষণ খিদে। তার উদর ভরে খাওয়ার ব্যবস্থা করো।

সবাই নিজ নিজ ঘর থেকে খাবার এনে অজগরের সামনে রেখে দিল। চেটেপুটে সব খাবার খেয়ে অজগর বিদায় নিল। সবাই স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল। ইকুনির সাহসিকতায় সবাই এই যাত্রা বেঁচে গেল। সকল ইঁদুর একত্রে বসে সিদ্ধান্ত নিলো, একজনকে দলপতি হতে হবে। তাকে সুখেদুঃখে যেন পাশে পাওয়া যায়। ইকুনি ছিল সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ। তাই তাকে সম্মান দেখিয়ে দলপতি অর্থাৎ রানি বানাল। আর এই একজন মুরব্বিকে ছাড়া কেউ রাজিও হয়নি। ইকুনি রাজি হলো। সেই থেকে সে দলপতি হয়ে গেল । কিন্তু তাকে সবাই রানি বলেই ডাকত। ইকুনিও অনেক বিচক্ষণ ও চালাক। সে শক্ত হাতে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে লাগলতার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি দ্বারা।

এদিকে বিষুজ আর বিষুপি দুই ভাইবোন ইঁদুর রানি ইকুনির কাছে গেল। রানিকে সবকিছু খুলে বলল বিষুপি। রানি শুনে, কিচকিচ শব্দ করতেই গর্তের সকল ইঁদুর হাজির হলো রানির সম্মুখে। রানি ইকুনি হুঙ্কার দিয়ে বলল,

হে প্রিয় ইঁদুরজাতি, তোমাদের জন্য এক বড়ো দুঃসংবাদ। এই মোড়লের বাড়িতে একটা বেড়ালের আগমন ঘটেছে। সবাইকে সর্তকভাবে চলাফেরার জন্য বলছি। তোমরা যখন আমাকে রানি হিসেবে সম্মানিত করেছো, আমি এটারও সুষ্ঠু পদক্ষেপ নেবো। তোমাদের যা করতে বলবো সেটা করে দেখাতে হবে। বেড়ালকে যেভাবেই হোক তাড়াতে হবে। না হলে, সে যেকোনো সময় আমাদের আক্রমণ করতে পারে। আমরাও পাল্টা জবাব দিতে চাই। প্রয়োজনে তার সাথে যুদ্ধ করতেও আমরা রাজি।

সবাই রানি ইকুনির কথায় সমর্থন জানাল।

সাবধানের মাইর কম। তাই সবাই সাবধানে চলাফেরা করতে লাগল। এভাবে দিনগুলো ভালোই যাচ্ছিল। হঠাৎ একদিন বিষুপিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না সকাল থেকে। বিষুজ চিঁচিঁ কুঁইকুঁই করে কাঁদতে কাঁদতে রানি ইকুনির কাছে গেল। রানিকে তার বোন বিষুপি হারিয়ে যাওয়ার কথা জানাল। রানি ইকুনি সান্ত্বনা দিয়ে বলল,

কেঁদো ভাই, সন্ধ্যা পর্যন্ত দেখি, সে ফিরে আসছে কি না। এদিক-সেদিক আর একটু খোঁজাখুঁজি করো।

সবাই অনেক খোঁজাখুঁজি করল। কোথাও খুঁজে পেল না। অবশেষে মাইকিং করল, তাতেও কোনো হদিস মিলল না। রানি ইকুনিকে সে কথা জানানো হলো।

রানি শুনে বলল,

আচ্ছা, তোমরা সকলেই প্রস্তুত থেকো। আমি বেড়ালের সাথে দেখা করে আসি।

সেদিন রাতেই রানি ইকুনি বেড়ালের সাথে দেখা করার জন্য কলতলায় গেল। সেই পথ দিয়েই বেড়ালটি মোড়লের বাড়ি যাচ্ছিল। রানি ইকুনি, বেড়ালের পথ আগলে দাঁড়ায়। ইঁদুরটিকে দেখে থমকে দাঁড়াল বেড়ালটি। তখন রানি ইকুনি বলল,

বেড়াল ভাই। কেমন আছো?

ভালো। কিন্তু তুমি, আমার পথ আগলে দাঁড়ালে কেন? খুব রাগান্বিত স্বরে বলল বেড়ালটি।

রাগছো কেন ভাই? আমাদের বিষুপিকে খুঁজে পাচ্ছি না। তুমি কি দেখছো?

কে বিষুপি? আমি কাউকেই দেখিনি । জোর গলায় বলে উঠল বেড়ালটি।

মিথ্যে বলছ। তুমি বিষুপিকে মেরে ফেলে খেয়ে নিয়েছ, তাই তো।

এবার বেড়ালটি রাগে গজগজ করে হুঙ্কার দিয়ে অহংকারের স্বরে বলল,

খেয়েছি। কী করবে আমার?

বলেই মোড়লের বাড়ির ভেতরে চলে গেল।

রানিও রাগে গিজগিজ কিচকিচ করতে করতে গর্তে গেল। এরপর সবাইকে ডেকে বুদ্ধি দিয়ে বলল,

বেড়াল যেমন বিষুপিকে খেয়েছে আমরাও তাকে খাবো। আর তাকে খেতে না পারলে আমাদেরকেও একে একে তার আহারের শিকার হতে হবে। এক্ষুনি তোমরা কাজে লেগে যাও। যেভাবে বললাম সেভাবে কাজ করো।

রানি ইকুনির কথামতো যাকে যে দায়িত্ব দিয়েছে, নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করতে লাগল।

বেড়ালটি যেপথ দিয়ে যাতায়াত করে, তার একপাশে দশ হাত লম্বা একটা গর্ত করল। গর্তের ওপর চিকন চিকন কিছু বাঁশের কঞ্চি জোগাড় করে বিছালো। তার ওপর কলাপাতা দিল। এরপর অল্প মাটি দিয়ে ঢেকে দিল। এই গর্তে ঢোকার জন্য অন্য একটা গর্ত সংযোগ করে দিল। একে একে সবাই গর্তে ঢুকে পড়লপ্রচণ্ড হিংস্র আর আক্রমণাত্মক মনোভাব নিয়ে। ইঁদুর রানি ইকুনিও সেখানে উপস্থিত হলো। শুধুমাত্র দুইটা ইঁদুর বাইরে রইল। তারা ঢেকে দেওয়া গর্তের আশেপাশে কিচকিচ, কুঁইকুঁই শব্দে ঝগড়া করার ভান করল।

মোড়লের বাড়ি থেকে খাওয়াদাওয়া করে খুব আনন্দচিত্তে বেরিয়ে এল বেড়ালটি। এসেই দেখল, দুইটা ইঁদুর ঝগড়া করছে। সেই সুযোগটাই সে নিতে গেল। ইঁদুর দুইটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ইঁদুর দুইটাও পালিয়ে ঢুকে পড়ল তাদের রাস্তা করা গর্তে। আর বেড়ালটি পড় কী পড় গর্তের ভেতর! গর্তে পড়ে তো বেড়ালটি লাফালাফি শুরু করে দিল। কিন্তু এত গভীর গর্ত থেকে বের হতে পারল না। ইঁদুরের দল এসে ধরল ঝাপটে। যে যার মতো করে পারছে কামড় দিচ্ছে বেড়ালকে। হাতে-পায়ে, চোখে-মুখে, কেউ গোঁফ ধরে, কেউ লেজ ধরে টানাহেঁচড়া করছে।

বেড়ালটি মিউমিউ করে চিৎকার করছে। ইঁদুরের ধারাল দাঁতের কামড়ে কামড়ে রক্তাক্ত হয়ে গেল বেড়ালটি। কিছুক্ষণ পরেই প্রাণ হারাল বেড়ালটি। এদিকে ইঁদুরেরা আনন্দ-ফূর্তিতে মেতে উঠল। আর বেড়ালের নিস্তেজ দেহটি খুবলে খুবলে খেল ইঁদুরের দল।