গল্প
আমাদের টিয়া

টিয়া দু’দিন পরপর মাকে জিজ্ঞেস করে—স্কুল কবে খুলবে মা?
চৈতী চটজলদি উত্তর দেয়—যতদিন অসুখটা না যায় ততদিন।
এই এক প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে বেচারি কাহিল। উপায়ন্তর না দেখে শেষমেশ এ কথাটাই বলল।
কথাটা শোনার পর আমাদের ছোট্ট টিয়া করোনা মহামারির গোষ্ঠী উদ্ধার করে ফেলল।
—করোনা করোনা করোনা! আর ভালো লাগে না মা। কখন যাবে এ বদের হাড্ডি অসুখটা। স্কুলে যেতে পারি না। বন্ধুদের দেখি না। নিচেও খেলতে যেতে পারি না। শুধু বাসায় বসে বসে কতদিন কাটানো যায়। শয়তানটাকে পেলে আমি লাঠিপেটা করতাম।
চৈতী মেয়ের মনের অবস্থা বুঝল। মেয়েকে কাছে টেনে বলল—আমার টিয়াপাখিটা। রাগ করে না মা। একটু ধৈর্য ধরো। আমরা সবাই বাসায় থাকলে এ অসুখটা আক্রমণ করতে পারবে না আমাদের। আক্রমণ করতে পারবে না তোমাদের মতো ছোট ছোট ফুলপরিদের। স্কুলে গেলে তো মহাবিপদ হবে মা। অনেকে একসাথে জড়ো হবে। গাদাগাদি করে বসবে। আর এ অসুখটা ছড়ায় অনেক লোক যেখানে থাকে সেখানে। একজনের থেকে আরেকজনের মাধ্যমে। এইতো মাত্র আর ক’টা দিন। ভাইরাসটা চলে গেলেই স্কুলে যেতে পারবে, খেলতে পারবে। পার্কে, এখানে-ওখানে সবখানে যেতে পারবে।
—নানুবাড়িতেও যেতে পারবো?
—হুমম, অবশ্যই পারবে? কেন নয়? কিন্তু এ সময়টায় আমাদের খুব খুব সাবধানে থাকতে হবে। ঘরের বার হওয়া একদম বারণ।
—তো বাবা যে যায় মাঝে মাঝে।
—সেটা নিতান্ত প্রয়োজন হলে যায়। আর না হলে দেখো না বাসায়ই থাকে। অফিসেও যায় না।
টিয়া, আমাদের টিয়াপাখিটা সারাক্ষণ খলবল করে কথায় কথায়। হিবা, ইকরা, মুনতাহা—বন্ধুদের জন্য মনটা কেমন কেমন করে তার। মাঝে মধ্যে ফোনে কথা বলে। দেখতে মন চাইলে ভিডিও কল দেয়। কত গল্প পরিগুলোর। কথা যেন ফুরায় না। স্কুলগেটে বসা বুড়ো দারোয়ানটার জন্য তারা সবাই মিলে টাকা জমিয়ে ঈদের গিফট দেবে। স্কুল ছুটির পর মা-বাবারা আসতে দেরি করলে ঐ দারোয়ান দাদুর কাছ থেকে ফোন নিয়ে কল করে সবাই। দাদুর জন্যও তাদের মন খারাপ। স্কুল-মাঠটার জন্য মন খারাপ। ছুটি হলে শহিদ মিনারে বসে, মাঠে দৌড়াদৌড়ি করে—কত খেলা তাদের। ওসবের জন্য মন ভীষণ খারাপ হয়। ক্লাস টিচার নাসরিন ম্যাম এবং আরো সব টিচারদের জন্য মন খারাপ। কতদিন বকা শোনে না টিচারদের। হোমওয়ার্ক নিয়ে যায়নি বলে চোখ রাঙিয়ে ধমক দেয় না কতদিন। খুব মিস করে এসব ওরা।
করোনার এ সময়টায় এসে চৈতী বুঝতে পারে—টিয়ার ছোট্ট মনে স্কুল, তার বন্ধুরা, শিক্ষক, এমনকি দারোয়ান দাদুটাও কী গভীরভাবে জায়গা করে নিয়েছে। সত্যি বেশ ভালো লাগে। মেয়ের মনকে প্রফুল্ল রাখতে কেরাম বোর্ড কিনে আনল। ড্রইংয়ে খুব ঝোঁক টিয়ার। সময়-অসময়ে আকঁতে বসে দু পা মেলে—রাজ্যের সব জিনিস নিয়ে। পুরো ড্রয়িং রুমটা তার দখলে তখন। পা দেওয়ারও সাধ্য নেই তখন ওখানে কারো। স্টক ফুরিয়ে যাবার আগেই আর্ট পেপার, রং পেনসিল, কালার পেন, কসটেপ—যা যা লাগে সব নতুন করে আনিয়ে নিল টিয়া বাবাকে বলে। চারদিকে যে অবস্থা, শেষে যদি আবার না পায়। সাদিক মেয়ের কথামতো এ-দোকান ও-দোকান খুঁজে খুঁজে কালার পেন ও এটা সেটা কিনে আনল। করোনাকালের এ সময়টায় দোকানেও সব পাওয়া যাচ্ছে না। নেহাৎ প্রয়োজনীয় জিনিস ছাড়া তারা তেমন কিছুই রাখছে না। তবুও মেয়েটা একটু হাসিখুশিতে থাক—কোনোরকম পীড়িত যেন না হয় মনের দিক থেকে, সে ব্যাপারে চৈতী আর সাদিক দুজনেই বেশ সজাগ। এমনিতে ছোট মানুষ, ঘরের বার হতে পারছে না বলে মন খারাপ, তার ওপর ভালোলাগার বিষয়গুলোতে হস্তক্ষেপ করলে আরো মন খারাপে পেয়ে বসবে মেয়েটাকে। ওর যা ভালো লাগে, যা করতে মন চায়, তা-ই করার উৎসাহ জোগায় বাবা-মা দুজনেই।