বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

কিশোর উপন্যাস

দুরন্ত দুখু

আপডেট : ২৫ মে ২০২১, ১৯:৩৬

প্রথম পর্ব

 

॥ এক ॥

তালগাছ গীত গায়

দুখু ছুটছে খালি পায়ে। রোদে ঝলসানো কাঁকর-বিছানো পথের উপর দিয়ে। ছুটতে মোটেও কষ্ট হচ্ছে না তার। রুক্ষ এই পথ ধরে ছুটছে সে পুবমুখো হয়ে।

একদম অজপাড়াগাঁ। কেউ চেনে না এমন একটি গাঁ চুরুলিয়া। এই গাঁয়ের ছেলে দুখু কখনো শস্যশ্যামলা সবুজ প্রকৃতিঘেরা বঙ্গদেশের ছবি দেখেনি। ঝোপঝাড়, বনজঙ্গল দেখেনি। দেখেছে কেবল বিস্তীর্ণ ধু-ধু মাঠে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ঝাঁকড়া মাথা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছের পর তালগাছ। এখনো ছুটতে ছুটতে তালগাছের ছায়ায় এসে দাঁড়াল সে। কঠোর রোদকে উপেক্ষা করতে না পেরে ছায়ায় আশ্রয় নিয়ে তাকাল পেছনের দিকে। না, এখনো দেখা যাচ্ছে না বন্ধু জানন্দকে। নিশ্চয় পেছনে ফেলে আসা মাটির দেয়ালঘেরা খড়ের চালের কুঁড়েঘরটির আড়ালে রয়েছে সে। আরও দূরে রয়েছে লাল টালির ছাউনি (অনেকটা টিনের চালের মতো কিন্তু টিন নয়) দিয়ে ঘেরা ঘর। গরমের ভাপ থেকে বাঁচার জন্য সে-ঘরের আড়ালেও আশ্রয় নিতে পারে জানন্দ। একথা ভেবে অপেক্ষা করতে লাগল দুখু। হঠাৎ চোখ গেল উপরের দিকেপ্রচণ্ড গরমেও দেখল গাছের পাতা দুলছে। ঝাঁঝাঁ রোদ্দুরে পাতার দুলুনি থেকে ভেসে আসতে শুনল কোমল এক সুর। অন্তরে নাড়া খেলো দুখু। পাতা থেকে সুর বেরোচ্ছে কীভাবে? বিস্ময়ভরা চোখে আবার সে তাকাল উপরের দিকে। সুর আরও গভীর হচ্ছে। আরও স্পষ্ট হচ্ছে। কান খাড়া করে শোনার প্রয়োজন হলো না। মাটির দিকে চোখ নামিয়ে অনুভব করতে লাগল বুকে সাড়া জাগানো অচেনা গীতের অজানা সুরের কম্পন। তালগাছ কি জীবিত? গান গাইতে পারে? ঝাঁকড়া মাথা থেকে এমন সংগীত আসছে কীভাবে? মনে আরও প্রবল বেগে জোয়ার এল কৌতূহলের। কৌতূহল সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। জানন্দ বলেছিল পুবের পলাশরাঙা প্রান্তরে আছে শাল-তাল-তমাল, হরীতকী আর মহুয়ার বন। বিরাট ঋষির মতো দাঁড়িয়ে আছে ঝাঁকড়া বটের গাছ। আছে বনশ্রেণি আর আছে নাম-না-জানা গাছগাছালি। শিহরণ খেলতে লাগল রোমাঞ্চ অনুসন্ধানী দুখুর মনে। তালপাতার ছন্দময় সুরদোলায় আনন্দে ভাসতে লাগল সে। দুখুর মন আরও অশান্ত হয়ে বেপরোয়া ছুট দিতে চাইল সোজা পুবমুখো। কিন্তু জানন্দ ছাড়া এত দূর যাওয়া ঠিক হবে না ভেবে অস্থির হয়ে ওঠা চোখ মেলে আবারও তাকাল বন্ধুর আসার পথের দিকে।

সে কি পালিয়েছে? এতক্ষণেও আসছে না কেন? ভেতরে ভেতরে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠতে থাকা দুখু ধৈর্য হারিয়ে একদমে ছুটে এল কুঁড়েঘর পর্যন্ত। না, জানন্দ নেই। পালিয়ে গেছে তাকে রেখে? ভাবতেই পারল না দুখু। চট করে মনে জেগে উঠল ভয়। কিন্তু পলকে ভয় জয় করে আবার ঘুরে দাঁড়াল সে। তখুনি কুঁড়েঘরের মাটির দেয়ালের আড়াল থেকে হালুম করে দু হাত দিয়ে ঘাড় মটকানোর ভঙ্গিতে সে চেপে ধরল দুখুর দুই কাঁধ। চমকে গেলেও খুশি হলো দুখু। লুকিয়ে থাকার কারণ জিজ্ঞেস না করে বরং বলতে লাগল, ‘তালগাছ গান গায়, বাজনা বাজায়, না-জানা সুরে গান করে।’

‘কী বলছিস দুখু! গাছ গান গাইবে কেন? তোর মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে নিশ্চয়ই।’

‘চল। আয় আমার সঙ্গে। তুইও শুনতে পাবি মধুর সে-সুর।’

তালগাছের তলে এসে আবার কান পাতল দুখু। না, গান শোনা যাচ্ছে না এখন। হতবাক হয়ে তাকাল সে জানন্দের মুখের দিকে।

হো-হো করে হেসে উঠল জানন্দ। তার দেহের মোচড় দেখে দুখুর মনে হলো জানন্দ আসলেই শোলমাছের মতো। এজন্য ওর নাম শৈলজানন্দ। তবে গজার মাছ বললেও ওকে এ মুহূর্তে ভুল বিশেষণের চাদরে মোড়ানো হয়েছে বলা যাবে না। শোলমাছকে দুখুর বড়ো বড়ো গজার মনে হতে লাগল এখন। এ মুহূর্তে গজার মাছের মোচড় থামিয়ে জানন্দ বলল, ‘সবুজ গাছপালা না দেখতে দেখতে আমাদের মন রুক্ষ হয়ে গেছে। দুঃখী হয়ে গেছি আমরা। উঁচুনিচু, ঢেউখেলানো, এবড়োখেবড়ো, শুকনো আর খটখটে মাটি দেখতে দেখতে আমাদের মন পাষাণ হয়ে গেছে বোধ হয়। এ কারণে হঠাৎ তালগাছের ছায়ায় এসে তোর মনে শান্তির ছোঁয়া লেগেছে। তোর প্রাণেরই ডাক শুনেছিস তুই। নিশ্চয় তালগাছ গান গায়নি!’

‘নিজের মনের ডাক আর তালগাছের গান বোঝার বয়স হয়েছে আমার, জানন্দ। আমাকে শেখাতে আসিস না। নিশ্চয় ঝাঁকড়া মাথার তালগাছের প্রাণ আছে। সেই প্রাণ থেকেই বেরিয়েছে সুরলহরি। আমার বুকে ডাক পাঠিয়ে দিয়েছে। শুনেছি আমি।’

একটা মাটির ঢ্যালা হাতে নিয়ে গাছের ঝাঁকড়া মাথার দিকে ছুড়ে দিল জানন্দ।

‘ইট ছুড়লি কেন?’ জিজ্ঞেস করল দুখু।

‘ভেবেছিলাম পাতার ঝোপের মধ্যে কোনো পাখি বসে ছিল। সেই পাখিই গান গেয়েছে। সে-গানই তুই শুনেছিস।’

‘পরীক্ষায় হারলি তো? হার মেনে নে। তালগাছ গান গায়, মানতে বাধ্য এখন তুই।’

জবাব দিল না জানন্দ। বরং তার চোখ বড়ো হতে লাগল। লাটিমের মতো ঘুরতে লাগল চোখের তারা। কপালে ভাঁজ পড়ে গেল। দেহের রোম খাড়া হতে লাগল।

পেটে গুঁতো দিয়ে দুখু বলল, ‘এমন হুতুমপ্যাঁচার মতো তাকিয়ে আছিস কেন?’

গুঁতো খেয়ে হুঁশ হলো জানন্দের। ভয়ে ভয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ভূতটুতের ব্যাপার নয় তো?’

‘ভূত’ শব্দটা আচমকা খাড়া করে দিল দুখুর গায়ের রোমও। সে-ও তাকাল উপরের দিকে।

গাছের ঝাঁকড়া মাথায় আছড়ে পড়ছে রোদ। নিচে ছায়ায় দাঁড়িয়ে ছিল বলে খেয়াল করেনি ছায়ার পরিধি, ছায়ার বিস্তৃতি। হঠাৎ উপর থেকে নিচে তাকিয়ে দেখল ছায়া নড়ছে। ভূত নাড়াচ্ছে না তো গাছের মাথা! সেই নাড়ানিতে নড়ছে না তো মাটির উপর শুয়ে থাকা ছায়া? প্রশ্নগুলো ভেতরে জেগে ওঠা ভয়ের কেন্দ্রে ছুড়ে দিল ঢিল। আর তখনই ভয়ের বেলুন ফুটো হয়ে আবার মনে জাগিয়ে তুলল স্বস্তি। চঞ্চল মন বলল, ঢিল খেয়ে নিশ্চয় ভূতও পালিয়ে গেছে। ভূত পালানোর পরও ছায়া নড়ছে। আসলে ভূত বলে কিছু নেই। এই বিশ্বাস আরও জোরালো করে দুখু বলল, ‘ভূতটুত বিশ্বাস করি না। চল যেদিকে যাচ্ছিলাম, সেদিকে যাই।’

‘পুবের পলাশরাঙা এলাকায়?’

‘হ্যাঁ। ওখানে শাল-তাল-তমাল-হরীতকী আর মহুয়ার বনে আছে পাহাড়সমান সব বটগাছ। তুই বলেছিলি একসময়। চল। সেই বনের ভূত আবিষ্কার করে আসি।’

‘আমার আর যেতে ইচ্ছা করছে না’, বলল জানন্দ।  

‘আমার যেতে ইচ্ছা করছে। ওখানেও নিশ্চয়ই গাছেরা গান গায়। বটগাছেরও নিশ্চয়ই আছে নিজের ভাষা, নিজের গান। শুনে হয়তো নিজেই কেবল আনন্দে থাকে। চল, আমরাও গিয়ে ভাগ নিয়ে আসি সেই আনন্দের।’

 ‘তোকে ফেলে তো বাড়ি ফিরতে পারব না। এও বুঝেছি, তোর এই খ্যাপাটে ইচ্ছাও থামাতে পারব না। হয়তো যেতে হবে তোর সঙ্গে। শর্ত একটা, সন্ধ্যার আগেই ফিরতে হবে ঘরে।’

দুখু বলল, ‘আচ্ছা।’

 

 

 

॥ দুই ॥

আকাশ নেমে এসেছে গাছের মাথায়

জানন্দ আবিষ্কার করল, দুখুর মধ্যে লুকিয়ে আছে একটা কৌতূহলী মন। সে-মন ভয় পেয়ে পিছিয়ে আসে না, ভয় জয় করার জন্য সামনে এগোতে চায় কেবল। ভয় দেখিয়ে তাকে ঠেকানো যাবে না ভেবে তাকে সুখী আর তৃপ্ত করার জন্য বুদ্ধি আঁটল মনে মনে। শালগাছের তলে দাঁড়িয়ে খুশিতে চিৎকার করে বলল, ‘আয় দুখু, এদিকে আয়। দেখ কত বড়ো গাছ! উপরের দিকে তাকিয়ে দেখ আকাশ ছুঁয়ে দিয়েছে গাছের মাথা। কী সুন্দর! কী সুন্দর!’

কথাটা শুনে নতুন কিছু দেখার জন্য দুখুর কৌতূহলী মন এক চক্কর লাফ দিয়ে উঠল। কাছে এসে তাকাল উপরের দিকে। বুঝল, জানন্দ ঠিক বলেনি। গাছ আকাশ ছোঁয়নি। আকাশই নেমে এসেছে গাছের মাথায়। উল্লসিত হলো না দুখু। মনে আনন্দধারা বইতে শুরু করলেও সেই আনন্দে উচ্ছ্বাস দেখা গেল না। জানন্দ কিছুটা নিরুৎসাহিত হয়ে প্রশ্ন করল, ‘ঠিক বলিনি আমি?’

‘না। পুরোপুরি ঠিক বলিসনি।’

‘কোনটা ঠিক, আর কোনটা ভুল?’

‘দৃশ্যটা সুন্দর। কোনো ভুল বা খাদ নেই এ সৌন্দর্যে। কিন্তু গাছ আকাশ ছোঁয়নি, আকাশই নেমে এসেছে বনের মাথায়নিচ থেকে এমনই মনে হচ্ছে। তবে গাছের মাথায় উঠতে পারলে বুঝবি, আকাশ আবার উঠে গেছে আকাশের ঠিকানায়।’

চুপ হয়ে গেল জানন্দ। বুঝল স্বাভাবিক সৌন্দর্য দুখুকে বেশি উৎফুল্ল করে না। অতি উচ্ছ্বাস সে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। তবে যতক্ষণ ভয়াবহ কিছু দেখার বা আবিষ্কারের সফলতা না আসে, ততক্ষণ সে তৃপ্ত হয় না। আর এ রোমাঞ্চ খুঁজে বেড়ানোর ভেতরের ডাক জানন্দকেও রোমাঞ্চ অনুসন্ধানে আগ্রহী করে তোলে। নিজে বুঝতে না পারলেও সঙ্গগুণের কারণে বনের ভেতরে ভয়াবহ নতুনত্বের মুখোমুখি হওয়ার জন্য ওত পেতে থাকা তাড়নায় ঢুকতে লাগল বনের ভেতরের দিকে। কিছুদূর যাওয়ার পর মাথা ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে জানন্দ দেখল দুখু নেই। দেখা যাচ্ছে না তাকে!

ভয়ে ভয়ে ডাকল, ‘দুখু, এই দুখু!’

জবাব নেই। বনের নীরবতার মধ্যে দুখু শব্দটা চৌচির হয়ে ভেঙে যেতে লাগল। শব্দ থেকে বর্ণগুলো ছিটকে আলাদা হয়ে নতুন ধ্বনি ছড়িয়ে দিতে লাগল দ...উ...খ...উ...

এবার জোরে জোরে ডাকল, ‘দুখু...এই দুখু...আমার ভয় করছে...’

সাড়া নেই। জানন্দের সত্যিকারের ভয়েও সাড়া জাগাল না দুখুর মনে।

নির্জন বনে ভূতপ্রেত নেই তো? দুখু কি পেতনির কবলে পড়ল? আকাশ থেকে কোনো পরি এসে তুলে নিয়ে যায়নি তো ওকে! এমন ভাবনার জাল উড়ে এসে জুড়ে বসল জানন্দের মনের আঙিনায়। আর তখনই সে কাঁপতে লাগল। প্রায় কান্নাভেজা গলায় বলল, ‘কোথায় পালিয়ে আছিস। বেরিয়ে আয়, দুখু।’

তার কান্নার স্বরেও সাড়া মিলল না দুখুর। উপরের দিকে তাকাতে সাহস পাচ্ছে না জানন্দ। সে ধরে নিয়েছে বনপরি নিশ্চিত দুখুকে ধরে নিয়ে গেছে। একথা মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একবার দৌড়ে পালাতে চাইল বনের ভেতর থেকে। আরেক মন তাকে চেপে ধরে বলল, ‘বন্ধুকে বিপদে রেখে পালাতে চাস? কেমন বন্ধু তুই?’

মনের আসল কথা টের পেয়ে থেমে গেল জানন্দ। এ পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দেবে, বুঝতে না পেরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল।

আচমকা দুমদুম শব্দ শুনে ভয়ে লাফ দিয়ে উঠে জানন্দ জড়িয়ে ধরল শালগাছটাকে। মনে হলো আকাশ থেকে দুমদুম শব্দে পড়ছে ভয়াবহ একটা কিছু। হঠাৎ খিলখিল আওয়াজ কানের পর্দায় আছড়ে পড়ল তার। পেতনির ডাকের মতো ওই স্বর শুনে আরও জোরে সে জড়িয়ে ধরল শালগাছটাকে।

তখনই শুনল দুখুর কণ্ঠ, ‘চোখ খোল, জানন্দ। তোর পেছনের তালগাছের নিচে দেখ কী পড়েছে।’

দুখুর সাড়া পেয়ে বুকের খাঁচার পাখিটার ধড়ফড়ানি বন্ধ হয়ে গেল। চোখ খুলে দেখল, গাছের নিচে চারটি তাল পড়েছে। তাল অনুসরণ করে চোখ চলে গেল তালগাছের চূড়ার দিকে। গাছের মাথা থেকে হাত নাড়ছে দুখু। আর হাসছে। বিশ্বজয়ী সেই হাসি দেখে রাগ হলো না জানন্দের। মুহূর্তেই ভুলে গেল একটু আগে পাওয়া ভয়ের কথা। বরং নতুন ভয়ে আক্রান্ত হয়ে সতর্কবার্তা পাঠাল দুখুর উদ্দেশে, ‘সাবধানে নেমে আয়। শক্ত করে ধরে থাক।’

হো-হো করে হাসছে দুখু।

তালের ঝাড় থেকে আরেকটি তাল নামানোর সময় হঠাৎই দেখল চিকন দড়ির মতো সবুজ রঙের একটা সাপ। ভয় পেয়ে হাত সরিয়ে নিল সে। ভেতর থেকে একটা ভয়ার্ত চিৎকার বেরিয়ে এসেছিল। তবে গলার ভেতর থেকে বেরোতে দিল না, সজোরে ঠোঁট চেপে আটকে ফেলল। নিজের বিপদ তাকে কাহিল করলেও বিপজ্জনক চিৎকারটি যে জানন্দর জীবনও হরণ করে ফেলতে পারে, সেই ভয়ও উদয় হলো দুখুর মনে। ভাবনা মাথায় নিয়ে সরাসরি সে চোখ রাখল সাপের চোখের দিকে। সাপের চোখের মণি স্থির হয়ে আছে। যে-কোনো মুহূর্তে ছোবল দেবে, ভাবতে গিয়েই রোম খাড়া হয়ে গেল দুখুর। সে-ও পলক না ফেলে তাকিয়ে রইল সাপের চোখের মণির দিকে। আর মনে মনে বিপদ মোকাবিলার উপায় বের করতে লাগল।

জানন্দ ডাকছে, ‘নেমে আয় দুখু। আমার ভয় করছে। তাল পাড়তে হবে না। নেমে আয়।’

দুখু জবাব দিচ্ছে না দেখে জানন্দ আবার বলতে লাগল, ‘এমন পাথরের মতো বসে আছিস কেন? এমন ভূতুড়ে ভূতুড়ে লাগছে কেন তোকে? আয়, প্লিজ নেমে আয়। আমার বুক ধড়ফড় করছে।’

জানন্দর প্রতিটি কথা শুনছে। কিন্তু পালটা জবাব দিচ্ছে না দুখু। স্থির হয়ে আছে। তার জানা আছে, সাপের চোখের দিকে নির্বিকার তাকিয়ে থাকতে পারলে লেজ গুটিয়ে পালায় তারা। ব্যাপারটা জানা থাকায় সাহস হারাল না সে। সাপও ফণা তুলে আছে। লেজ গোটাচ্ছে না। বরং হঠাৎ দেখল তালপাতার মার্জিন থেকে লেজটা নিচে ঝুলিয়ে দিয়েছে। লেজ নড়ছে। মনে মনে দুখু নিজেকে প্রশ্ন করলসাপের মাথায় কি বিষ থাকে, নাকি দাঁতে? নাকি জিবেয়? নাকি লালায়?

উত্তর বাছাই না করে আবার প্রশ্ন করল নিজেকে, লেজে থাকে বিষ?

সঙ্গে সঙ্গে উত্তর পেয়ে গেল সে, না। লেজে বিষ থাকে না।

মাথায় চট করে বুদ্ধি জেগে উঠল। নতুন বুদ্ধির ঝলকে চট করে সে ধরে ফেলল সাপের লেজ। সজোরে ঘোরাতে লাগল সাপটিকে। অনেকক্ষণ ঘুরিয়ে হাতের মুঠি আলগা করে দিল। উড়ে গিয়ে সাপটি আছড়ে পড়ল পাশের এক বিশাল শালগাছের কাণ্ডের সঙ্গে। আছাড় খেয়ে নিচে পড়ে গেল সাপটা। ক্ষতবিক্ষত সাপটি দেখে জানন্দর চিৎকার আর থামে না।

গাছ বেয়ে নামতে নামতে নির্বিকার গলায় দুখু বলল, ‘মরা সাপ দেখে ভয় পাওয়ার কী আছে?’

‘ওটা মরা?’ চিৎকার থামিয়ে প্রশ্ন করল জানন্দ।

‘হাত দিয়ে ধরে দেখ, মরা না জীবিত। যাচাই করে দেখ, গাধা কোথাকার।’

 

[চলবে]