শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

কিশোর উপন্যাস

দুরন্ত দুখু

আপডেট : ২০ জুন ২০২১, ১৭:৫৮

॥ পাঁচ ॥

স্বপ্নের বীজ রোপণ

 

ছোটো হুজুর অর্থাৎ ছোটো মওলানা প্রতিদিন দুখুকে দেখেন আর অবাক হন। এই বালকের স্মৃতিশক্তি চমৎকার! চলনে-বলনে দুরন্ত আর ডানপিটে মনে হলেও বেয়াদব নয়। পড়ার সময় সে খুবই মনোযোগী। ছোটো মওলানা ভাবেন, ভালো পড়াশোনা করলে এ ছেলে বিশ্ব জয় করবে।

নিজেকেই প্রশ্ন করলেন ছোটো মওলানাএই অজপাড়াগাঁয়ে থেকে কি কেউ বিশ্ব জয় করতে পারবে? অলীক এই কল্পনা এ মুহূর্তে খানিক তৃপ্তি দিলেও, জীবনসংগ্রামের ঘানি টানতে টানতে কেউ আর উপরে উঠতে পারবে না, এমন ধারণায় আক্রান্ত হয়ে হারিয়ে ফেললেন বিশ্ব জয়ের কল্পনা।

আজ, এখনো এসে পৌঁছায়নি দুখু। ছোটো মওলানা ভেবেছিলেন দুখুর হাতে দায়িত্ব দিয়ে, অর্থাৎ ক্যাপ্টেন বানিয়ে নিজের কাজে একটু বাইরে যাবেন। এ সময় মক্তবে উপস্থিত হয়ে কাজী বজলে করিম, দুখুর চাচা (কাজী ফকির আহমদের চাচাতো ভাই) ছোটো মওলানাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘দুখু কোথায়?’

‘আমিই তো দুখুর অপেক্ষায় আছি। ভাবছিলাম মক্তবের দায়িত্ব ঘণ্টাখানেকের জন্য ওর হাতে তুলে দিয়ে জরুরি একটা কাজে বাইরে যাব।’

‘ওঃ! আমি তো ভেবেছিলাম আপনার কাছ থেকে ওকে আজকের জন্য হাওলাত নেব। আমারও একটা কাজে লাগবে ওকে।’ বললেন কাজী বজলে করিম। উর্দু ও ফারসি ভাষায় পারদর্শী বজলে করিম বাংলা গান, উর্দু গান ও গজল লিখে, গেয়ে গাঁয়ে সাড়া ফেলে দিয়েছেন। তবে তার সহায়ক হিসেবে তাদের বংশের গৌরব দুখুর উপস্থিতিতে বেশি মাত্রায় সৃষ্টিশীল হয়ে উঠেছেন তিনি। দুখুর মাথা ঝাঁকুনি, ডুগডুগি বাজানো, কাঁসার বাটিতে ঘর্ষণে ঘর্ষণে সুর জাগানো আর বাঁশির সুরের জমজমাট আসরে বজলে করিম নিজেকে যেভাবে আবিষ্কার করতে পারেন, একইভাবে ভাতিজার সহজাত নান্দনিক সৃষ্টিশীলতার ব্যাপারেও আশাবাদী হয়ে উঠেছেন। এ শিশুর পরিচর্যায় তাই তার নজর বেশি। এ মুহূর্তে জমজমাট একটি আসরে তাকে নিতে এসে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যেতে ইচ্ছা করল না। মক্তবের বারান্দায় একটা মোড়ায় বসে পড়লেন। ছাত্রের মুরুব্বি হিসেবে ছোটো মওলানাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘দুখুর পড়াশোনায় আগ্রহ কেমন? রোজ আসে তো?’

‘মাশাআল্লাহ! খুবই মনোযোগী। পড়ানো বিষয় সহজে ভোলে না। আর যখন যে কাজ করে, তাতে একশ ভাগ মন ঢেলে দেয় একশ ভাগ মগ্ন হতে পারে।’

‘বাঃ! বেশ ভালো লাগল শুনে। একটু নজর রাখবেন। নজর তো রাখেনই জানি, একটু বিশেষ নজর দাবি করি ওর প্রতি। এই আর কি।’

‘আমাদের বড়ো হুজুরও ওকে খুব আদর করেন। আপনি নিশ্চিত থাকুন। তবে ওর একটা অন্যরকম ভাব লক্ষ করি আমি। পাঠশালায় পড়া বাংলা বইয়ের প্রতি খুব বেশি যত্নশীল সে। মাঝে মাঝে স্লেটে চক দিয়ে বাংলায় কী যেন লেখে, আবার মুছে ফেলে। তার এরকমের অতিমাত্রার আগ্রহ হয়তো মক্তবের পড়া শেষ করতে বাধা হয়ে দাঁড়াবে, আমার মনে হয়েছে।’

হঠাৎ চিন্তার একটা মেঘ উড়ে এলো মাথায়। মুহূর্তেই তা ফকফকা হয়ে গেল। অন্যরকম রোদের আভাস পেলেন দুখুর চাচা, কাজী বজলে করিম।

ছোটো হুজুরকে আশ্বস্ত করে তিনি বললেন, ‘আমিও ওর এ গুণটি দেখেছি। সুযোগ পেলেই পদ্য লেখার চেষ্টা করে সে, শুধু বর্ণমালায় নয়, মুখে মুখেও বলে ফেলে অসাধারণ সব পঙ্‌ক্তি। গানের তালে তালেও সে ছন্দের ঢেউ তোলে, নিজের অজান্তেই। আত্মভোলা এ শিশুর এই ক্ষমতা নিশ্চিতই আল্লাহর দান। এটা বাধা হবে কেন মক্তবের পড়াশোনায়, হুজুর?’

প্রশ্নের আড়ালের প্রশ্ন চুপ করিয়ে দিলো ছোটো হুজুরকে। তিনি অন্যরকম চোখ মেলে তাকালেন বজলে করিমের দিকে।

বজলে করিম আবার বলা শুরু করলেন, ‘আমার তো মনে হয় দুখুর এই আগ্রহ একক বিষয় নয়। ফারসি, উর্দু এমনকি আরবির প্রতিও সে সমান উৎসাহী। বাংলা শব্দের মধ্যে এসব বিদেশি শব্দ ঢুকিয়ে কী সুন্দর সে মিল ঘটিয়ে ফেলে, টের পাননি আপনি?’

টের পেয়েছেন ছোটো হুজুর। কিন্তু এর মধ্যে উচ্ছ্বাসের কিছু দেখেননি তিনি। কাজী বজলে করিমকে অতি উচ্ছ্বাসী হতে দেখে তিনি বলেই ফেললেন, ‘চাচার বৈশিষ্ট্যগুলো দুখুর ওপর চেপে বসছে। এটা ভালো হচ্ছে না খারাপ হচ্ছে, বুঝা যাবে পরে।’

নিজের ওপর দোষের বোঝা চেপে বসছে দেখে আবারও বিনয়ের সঙ্গে বজলে করিম বললেন, ‘আমার গানের উৎসাহ আমারই। শিশুকাল থেকে আমাকে দেখে দেখে সে উৎসাহী হলে দোষ কী, হুজুর? আর মক্তবের বড়ো হুজুর, মৌলবি কাজী ফজলে আহম্মদও কি কম যান, তিনিও তো ফারসি আর আরবি ভাষায় পঙ্‌ক্তি রচনা করেন, বয়ান করেন। তাঁর প্রভাব কি পড়ছে না দুখুর ওপর?’

এবার চুপ হয়ে গেলেন ছোটো হুজুর। ভুল প্রশ্ন তোলেননি দুখুর চাচা। মক্তবের প্রধান শিক্ষক বড়ো মওলানার সান্নিধ্যেও দুখু উল্লসিত থাকে, খুশি খুশি থাকে। বড়ো মওলানার ফারসি শব্দের বয়ানগুলোও যেন গিলে গিলে খায় এই খুদে শিক্ষার্থী। ঘরে আর মক্তবে, মসজিদ কিংবা মাজারে তথা এ অঞ্চলের সবখানে ফারসির প্রভাব পড়ছে শিশুদের ওপর। কেউ আগ্রহভরে গ্রহণ করছে, কেউ কেউ বিরক্তি বোধ করে, আর এগোয় না এ পথে। এমনকি মক্তবও ছেড়ে দেয়। দুখু যা ধরে, পড়াশোনার ব্যাপারে, শক্ত করেই ধরে। পাঠশালার শিক্ষা এখনো বুক আগলে রেখেছে, বাবার হাতেই পাঠশিক্ষা নিয়েছিল সে, হাতেখড়ি হয়েছিল বর্ণমালারএকথা দুখু বলেছিল একদিন তাকে (ছোটো হুজুরকে)। হুজুর ভোলেননি সে-কথা। সবার প্রভাব তার ওপর পড়তেই পারে। নিজেদের গ্রাম নিয়ে বড়াই নেই নিজের, দরিদ্র এলাকা, বিত্তশালী গ্রাম নয়। কিন্তু আর্থিক দীনতা থাকলেও এলাকার মানুষের রুচি উন্নত, মার্জিত। তুলনামূলকভাবে শিক্ষিতও, অজপাড়াগাঁ এবং শহর থেকে অনেক দূরের চুরুলিয়া গ্রামকে কেউ অন্ধকারাচ্ছন্ন, অভদ্র সমাজ বলতে পারবে না, মূর্খদের গ্রাম তো নয়ইএই শিক্ষা ও রুচির আলোতেই দুখু আলোকিত হচ্ছে, হবেএটাই সত্য। এককভাবে কারো প্রভাবই আলাদা করা উচিত নয়, নিজের ভাবনার ভেতর থেকেই বেশ বুঝতে পারলেন ছোটো হুজুর।

বুঝেও কাজী বজলে করিমের মতো প্রশ্ন উপেক্ষা না করে বললেন, ‘দুঃখের সংসারে বড়ো হচ্ছে দুখু। একইসঙ্গে ধারণ করছে পুরো গ্রামের শিক্ষার আলোও। কেবল আপনি, বড়ো হুজুর কিংবা তার বাবার দেখানো পথেই সে চলবে, সে-ভরসা করা যায় না। আপন পথও আবিষ্কার করে নেবে দুখু।’

দুখুর চাচা একথার পিঠে পালটা কিছু বলতে চাইছিলেন, কিন্তু কণ্ঠ থেমে গেল। সামনে তাকিয়ে দেখলেন বাইরের হিজলগাছের পাশের সড়ক দিয়ে মক্তবের প্রধান শিক্ষক মৌলবি কাজী ফজলে আহমদের পেছন পেছন হেঁটে আসছে দুখু। দুখুর হাতে বড়ো একটা ব্যাগ। ব্যাগের ওজনে তার ডান কাঁধ ঝুঁকে আছে নিচের দিকে। দেহভঙ্গি দেখে বুঝা গেল বেশ কষ্ট হচ্ছে তার হাঁটতে। অবশ্য মুখ দেখে বুঝা গেল না সেই কষ্টের ছাপ। বরং মনে হচ্ছে ওস্তাদের ব্যাগ বহন করার সুযোগ পেয়ে সে তৃপ্ত।

মক্তবের কাছে এসে বারান্দায় চাচাকে দেখে কিছুটা ভড়কে গেল দুখু। ব্যাগ বহন করছে দেখে চাচা কী ভাবছেন, শিক্ষকের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দেন কি নাএ ভাবনা থেকে আগবাড়িয়ে সে বলল, ‘বড়ো হুজুর বাজার থেকে ব্যাগ টেনে হেঁটে আসছিলেন, দেখে ব্যাগটা আমিই কেড়ে নিয়েছি। ঠিক করিনি, চাচাজান?’

‘অবশ্যই ঠিক কাজ করেছ।’ মুখে জোর দিয়ে কথাটা বললেও কাজী বজলে করিমের মনটা একটু যেন ধাক্কা খেয়েছে। এত ভারী ব্যাগটা দুখুর হাতে ধরিয়ে দিতে বিবেকে কি একটুও বাধল না বড়ো হুজুরের! এই গোপন মনোভাবটি প্রকাশ না করে হাসিমুখে হুজুরের উদ্দেশে সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করে বললেন, ‘এখানে আসার কারণটা কি বলতে পারি?’

‘অবশ্যই।’

বলতে গিয়ে থেমে গেলেন বজলে করিম। এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখলেন দুখু নেই আশপাশে। হঠাৎ পুকুরপাড়ের দিকে চোখ গেল তাঁর। দেখলেন পিতলের বদনা হাতে পুকুরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দুখু। কী ব্যাপার? হুজুরের ওজু করার কাজে ব্যবহার করা হয় এ বদনা, জানেন তিনি। এখন তো নামাজের সময় নয়, তবুও কি ওজু করবেন তিনি?

বড়ো মওলানা বললেন, ‘কী যেন বলতে চাইছিলেন, বলুন। থেমে গেলেন কেন?’

কথাটা বলার সময় দুখু সামনে থাকলে ভালো হতো বোধ হয়।

বড়ো হুজুর প্রশ্ন করলেন, ‘আরে, চড়ুই পাখির মতো কোথায় সে উড়ে গেল ফুড়ুত করে?’

ছোটো হুজুর বললেন, ‘আপনার হাত-মুখ ধোয়ার জন্য পানি আনতে গেছে পুকুরে।’

‘ওঃ! দেখেছ, এত পিচ্চি একটা ছেলে! অথচ ওস্তাদের সেবা করার জন্য পাগলপ্রায় সে। নিজের তালে চলবে, মুক্ত পাখির মতো উড়ে উড়ে বেড়াবে, আবার পড়াশোনার প্রতিও সজাগ, অন্যদের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারেও সচেতন। নিয়মকানুন, শৃঙ্খলা বোধ হয় বেশি মানতে চায় না। তবে এটুকুন বয়সেই দায়িত্বের প্রতি সে দুর্দম, দুর্বিনীত। বড়োদের শ্রদ্ধা করে। সমবয়সী ছোকরারাও তার সঙ্গ পাওয়ার জন্য ব্যাকুল থাকে।’

প্রশংসা শুনে বিগলিত হয়ে গেলেন। প্রশংসার আড়ালেও দেখতে পেলেন ভাতিজার অনিয়ম আর উচ্ছৃঙ্খলতার চিহ্ন।

বড়ো হুজুর তাড়া দিলেন, ‘কী বলতে এসেছেন, বলে ফেলুন।’

তাড়া খেয়ে কাজী বজলে করিম বলেই ফেললেন ছোটো হুজুরকে বলা কথাটা।

‘দেখুন, আপনি ছেলের চাচা। আপন চাচা নন। তবুও আপনার অধিকার আছে ওকে নেওয়ার। তবে মক্তবে সব ছাত্র চলে আসছে। এখন ওকে ছুটি দেওয়াটা কি ঠিক হবে? আমি চাই না, ওর সহপাঠীদের তুলনায় একঘণ্টার জন্যও সে পিছিয়ে পড়ুক। বরং মক্তব ছুটি হলেই ওকে আপনার বগলদাবা করুন। আপত্তি নেই আমার।’

বড়ো হুজুর এরকম ঠোঁটকাটা কথা বলতে অভ্যস্ত। কাউকে ছাড় দেন না। নিজের বুঝে যেটা সঠিক সেটাতেই স্থির থাকেন। এ মুহূর্তে তাঁর দৃঢ় কথায় আঘাত পেলেন না। মোচড়ও খেলেন না। তবে আচমকা ধাক্কা খেলেন বড়ো মওলানার হৃদয়-কাটা কথায়। ‘আপন চাচা নন’ কথাটা তিরের মতো আঘাত করল তাঁকে। নিজেকে নানাভাবে নেড়েচেড়ে দেখে বুঝলেন, আপন না হলেও দুখুর সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক রয়েছে। তার চেয়ে বড়ো কথা নিজের ছেলের মতোই দুখুর প্রতি মমতা বোধ করেন, তার উন্নতি চান। ওর ভালো চাওয়ায় কোনো ঘাটতি নেই। দুখুর প্রাণখোলা হাসির উল্লাসে যেখানে পাড়ার সবাই মুগ্ধ, তার হাতের বাঁকা বাঁশির জাদুতে যেভাবে সবাই তাকে পছন্দ করে, তার চেয়ে বেশি মমতা ধারণ করা কি চাচাতো চাচার অন্যায়? না। উত্তর পেলেন। তবুও খুঁজলেন দুখুকে। দেখলেন এখনো ফিরে আসছে না দুখু। গেল কোথায় সে? ভাবতে ভাবতেই হুজুরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পুকুরের দিকেই এগিয়ে এলেন।

পুকুরঘাটে তার দেখা পাওয়া গেল না। অবাক হয়ে দেখলেন, হাতে করে নিয়ে আসা পিতলের বদনাটা পুকুরঘাটের এককোণে একা পড়ে আছে! দুখু কোথায়! তবে কি সে পানি তোলার নাম করে পালিয়েছে!

পুকুরপাড় দিয়ে হেঁটে হেঁটে অপর প্রান্তে গিয়ে চমকে উঠলেন বজলে করিম। কিছুটা দূর থেকে দেখলেন দুই বালক তালগাছের ছায়ার তলে বসে কী যেন খাচ্ছে।

পেছন থেকে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন, খুব কাছে গিয়ে বুঝলেন দুজনে পিঠা খাচ্ছে, আর গপ্প করছে। প্রকৃতির পুরো সৌন্দর্যছটা ছলকে-বলকে উঠছে দুই কিশোরের গল্প-উচ্ছ্বাসের জোয়ারে।

কাছে গিয়ে ডাকলেন, ‘দুখু!’

চাচার কণ্ঠস্বর শুনে দুজনই আপনভোলা জগৎ থেকে জেগে উঠল এবং দুম করে লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। প্রথমে ভয় পেলেও, চাচার মুখের দিকে তাকিয়ে মুহূর্তেই সহজ হয়ে বলল, ‘ওর নাম জানন্দ, আমার পাঠশালার বন্ধু। তালপিঠা বানিয়েছে ওর মা। নিজে না খেয়ে পোঁটলায় করে আমার জন্য নিয়ে এসেছে একসঙ্গে খাব বলে। খাবেন আপনি? আরও কিছু আছে।’ কথা শেষ করে মাটিতে রাখা একটা কাঁসার বাটি থেকে পিঠার ভাঙা একটা অংশ সে বাড়িয়ে ধরল চাচার দিকে।

বয়সের ব্যবধান আর রইল না। চাচাও মাটিতে বসে খেতে শুরু করলেন পিঠা। একফাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘পাঠশালা থেকে তোমাকে, অনেকটা জোর করে তোমার বাবা এখানে এনে ভর্তি করিয়েছেন, তাই মন খারাপ করেছ?’

একথার জবাব দিলো না দুখু। তাকে চুপ থাকতে দেখে এবার জানন্দের উদ্দেশে প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি কী বলো, তোমার কষ্ট হয়েছে বন্ধুকে হারিয়ে?’

জানন্দ মুখ তুলে তাকাতে পারল না। তার চোখ বেয়ে ঝরঝর করে নেমে এলো জলকণা, ডুকরে কেঁদে উঠল। তারপর একছুটে পালাল বজলে করিমের সামনে থেকে।

জানন্দের প্রতিক্রিয়া ছোঁয়াচে রোগের মতো ছড়িয়ে গেল দুখুর রক্তকণিকায়। সেও কেঁদে উঠে পালিয়ে গেল চাচাজানের সামনে থেকে।

বজলে করিম বলতে চাইলেন, ‘দুখু, আমরা একটা গানের দল করেছি– ‘লেটো’ নামের ওই দলে তোমাকেও থাকতে হবে।’

কথাটা শুনে পলায়নরত দুখু থমকে দাঁড়াল। গানের দলের কথা ভেতরের কান্না দমিয়ে দিলো। বাধ্য ছেলের মতো চাচার সামনে দাঁড়াল, যেন পলাতক আসামি ফিরে এসেছে।

‘দেখো, আমি যে কেবল উর্দু-ফারসি ভাষা জানি, তা নয়, বাংলায়ও কবিতা লিখি। জানো?’

মাথা দুলিয়ে দুখু জানান দিলো সে জানে। মুখ ফুটে বলল, ‘গোপনে আমিও শুনেছি আপনার গান, কবিতা।’

‘গাঁয়ের লোকের কাছে বড়োই কদর ওইসব রচনার, সেটা জানো?’

‘জানি।’

‘আর আমিও জানি তোমার আনন্দ আর আগ্রহের কথা, তোমার দক্ষতার কথাও জানি।’

মাথা নিচু হয়ে গেল দুখুর। বলার ইচ্ছা হলো আপনাকে দেখে দেখেই তো আগ্রহ জন্মেছে। তবে মুখ ফুটে বলল না সে-কথা।

‘খই ফোটানোর মতো পদ্য বেরোয় তোমার মুখ থেকে। মাঝে মাঝে মনে হয়েছে খই-ই ফুটছে তোমার মুখ থেকে। এত ছোটো বয়সে কেবল বাংলায় না, আরবি, ফারসি, ইংরেজি আর বাংলা মিশিয়ে সুন্দর সুন্দর পদ্য বলে ফেলতে পারো তুমি। তোমার এ গুণটি ‘লেটো’ দলকে সুনাম এনে দেবে, বিশ্বাস আমার। তুমি কি থাকবে আমাদের সঙ্গে?’

‘থাকব,’ গলার স্বর স্পষ্ট করে জবাব দিলো দুখু।

কাব্যরসিক চাচা জানান দিয়েই ভাতিজার মনে স্বপ্নের বীজ রোপণ করে দিয়েছেন, শুধু বীজই রোপণ করেননি, দুখুর কাব্যিক মনের মাঠে উর্বর পলিমাটির জোগান দিয়ে ফেলেছেন ইতোমধ্যে। চাচাকে দেখে দেখেই তো তার আগ্রহ আর উচ্ছ্বাসের ক্ষেত্র তৈরি হয়ে গেছে। সে-কারণে সহজে সে চাচার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেছে। বিষয়টা টের পেল না দুখু। কাজী বজলে করিমও টের পেলেন না।

চলবে...