॥ আট ॥
দুখুর দিকে এগিয়ে আসতে লাগল দৈত্যমানব
হঠাৎ দুখুর মনে হলো আচমকা আকাশে জমতে শুরু করেছে মেঘের পর মেঘ। আকাশের জমাট মেঘ ধেয়ে আসছে নিচের দিকে। ভোরের রোদে এত মেঘ এলো কোত্থেকে? কীভাবে মেঘ গিলে খেলো রোদ আর সূর্য! প্রলয়ের বিনাশী থাবায় ভয়ে কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল সে। চারপাশের মাটি আর কবরও। চটজলদি তার মনে হলো কঠিন জগতের মাটি ফুঁড়ে উঠে যাচ্ছে কবর। কবরের কপাট খুলে গেছে। বিরাট এক মানব, লম্বা লম্বা পাজোড়ায় ভর করে, দেহের মাটি ঝাড়তে ঝাড়তে দাঁড়িয়ে গেছে দুখুর সামনে। ময়লা কাপড়চোপড় থেকে ঝুরঝুর করে ঝরছে শুকনো মাটির কণা। আর তার হাতে ধরা আছে তালগাছের মতো মোটা এক লাঠি। শরীরটাকে একবার ঝাঁকি দিলো অদ্ভুত এ মানব। ঝাঁকির সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁকড়া চুলের মাথা, দেখতে বটগাছের মাথার ঝোপের মতো, একশ মাইল বেগে বাতাস বইয়ে দিলো। চারপাশের তালগাছের উড়াল পাতার দিকে তাকিয়ে বুঝল ঝড় বইছে। দৃশ্যমান সে-ঝড় তাকে উড়িয়ে নিচ্ছে না―আশ্চর্য হলো। ঝড় স্পর্শ করছে না। গায়ের পাঞ্জাবিটাও উড়ছে না। বসা থেকে চট করে উঠে দাঁড়াল সে। উপরের দিকে তাকিয়ে লোকটির মুখ দেখতে চাইল। মুখভরতি দাড়ি। যেন উপড়ে যাওয়া বটগাছের শেকড়ের শাখাপ্রশাখা ঝুলে আছে শূন্যে। দাড়ির আড়ালে ঢেকে গেছে মুখ। তবে চোখ দেখা যাচ্ছে, গোলাকার লাল সূর্যের মতো চোখজোড়া ফুঁড়ে আগুন বেরোচ্ছে না, বেরোচ্ছে ধোঁয়া। যেন চেরাগের ভেতর আটকে ছিল কোনো দৈত্য, ধোঁয়ার উদ্গিরণের মধ্য দিয়ে পাহাড়সমান দৈত্যাকৃতি মানুষটি দাঁড়িয়ে আছে সামনে!
জগৎজুড়ে কি ঘটতে যাচ্ছে ধ্বংস, প্রলয়? জরাগ্রস্ত মুমূর্ষুরা ভেসে যাবে প্রলয়োল্লাসে? অসুন্দরকে ছেদন করে কি তবে জেগে উঠবে নতুন শক্তি, নবীন প্রজন্ম? প্রলয়ের মধ্য থেকেই কি জেগে উঠবে নবীনের সৃজন-বেদনা? নিজের ভেতর থেকে ভয় পালিয়ে গেল। প্রলয়ের শঙ্কার মধ্য থেকে জয়ধ্বনি বেজে উঠল। সমগ্র সত্তার ভিত নাড়িয়ে ঘোষিত হতে লাগল ভেতরগত জয়ধ্বনি। সেই ধ্বনিতে টালমাটাল দৈত্যদানবের দল―এক পা-দুপা করে এগিয়ে আসতে লাগল দুখুর দিকে। বুক উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে রইল দুখু।
কবরমানব বলল, ‘আমাকে ভয় পাচ্ছ না? পালিয়ে যাচ্ছ না কেন?’
‘কে তুমি? কেন তোমাকে ভয় পাব? জানো না আমরা নতুন প্রজন্ম! আমাদের শক্তির সঙ্গে কি লড়াই করে জিততে পারবে? আসো সামনে, দেখবে কালবোশেখির ঝড়ের মতো উড়ে যাবে তোমার ধড়, উড়ে যাবে তোমার দাড়িগোঁফ আর লাল চোখ ঢেকে যাবে মেঘে। এসো কাছে।’
দুখুর হুংকার নয়, পাহাড়মানব যেন শুনল সিংহের গর্জন। সামনে এগোনোর পরিবর্তে থেমে গেল পাহাড়। দুখুর গর্জনের প্রলয়ঝড়ে উড়ে যেতে লাগল তার চুল-দাড়ি।
হঠাৎ দুখু দেখল এটা দৈত্য নয়, পাহাড়মানব নয়, মানবজাতিরই প্রতিনিধি, মানুষ।
দুখু এবার প্রশ্ন করল, ‘মানবরূপ ছেড়ে এবং দানবীয় রূপে মাটি ফুঁড়ে বেরোলে কেন? কে তুমি?’
‘চেয়েছিলাম তোমাকে ভয় দেখাতে। যেন তুমি ভয়ে এখান থেকে পালিয়ে যাও। উলটো আমাকেই ভয় পাইয়ে দিলে। আমাকেই পালিয়ে যেতে হচ্ছে।’
‘তোমার পরিচয় দিচ্ছ না কেন? কেন পালাতে বলছ আমাকে?’
‘আমার পরিচয়, আমি মানুষ। কালের স্রোতে, সাগরের জলের অণু-পরমাণুর সংখ্যার মতো পৃথিবীর গিজগিজ করা মানুষদেরই একজন। সময়ের স্রোতে, আমার সময়কাল পেরিয়ে, চলে এসেছি আমি কালের গর্ভস্রোতে। আমার কোনো শক্তি নেই। শক্তি থাকলে মরতে হতো না, বেঁচে থাকতাম পৃথিবীতে। অথচ দেখো আমার কবরজুড়ে কেমন ব্যবসা চলছে। রোগশোক থেকে মুক্তি পেতে আর ভাগ্য ফেরাতে দেখো কী হারে মানুষজন আসে আমার কবরে। কবরটাকে মাজারশরিফ বানিয়ে কীরকম রমরমা কাজ-কারবার চলছে! এটা সইতে পারছি না আমি কবরে থেকে।’
দুখুর কথাবার্তা আর চাউনি থেকে হঠাৎ করেই মিলিয়ে গেল প্রলয়ংকরী ঝড়। দৈত্যদানবের প্রতি ফুঁসে ওঠা প্রতিরোধশক্তিও নেমে এলো শূন্যের ঘরে। নিজেকেও অসহায় লাগতে শুরু করল। এতক্ষণের বোধের বিপরীত স্রোতে থাকা ভাসমান নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করে প্রশ্ন করল, ‘আপনি কি হাজি পালোয়ান?’
‘হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছ।’
‘কীভাবে আবার জেগে উঠলেন কবর থেকে?’
‘তোমার আত্মার মধ্যে যে-জমিন আছে, সেখানে দেখছি কেবলই সুন্দরের চাষাবাদ করার মতো পলিমাটি। আর দেখছি অসুন্দরকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করার মতো তোমার তেজ। সেই তেজস্বী চৌম্বক বলয়ের টানে কবর ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছি। বলতে চাই, এখান থেকে পালাও। অন্য পেশায় যোগ দাও। শিক্ষা গ্রহণ করো, নিজেকে গড়ে তোলো আর অন্যকে আলোকিত করো।’
‘ওঃ। বক্তৃতা দিচ্ছেন, উপদেশ দিচ্ছেন?’
‘না। বক্তৃতা দেওয়ার ক্ষমতা নেই আমার। উপদেশ দেওয়ারও ক্ষমতা নেই। অন্তর আলোকিত করারই শক্তি আছে। আত্মার ভেতর থেকে আত্মার সঙ্গে সংযোগ ঘটাতে পারি।’ কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দুম করে একটা বিস্ফোরণ ঘটল। সেই বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে কবরমানব গুঁড়ো হয়ে ঝরে যেতে লাগল। একবার দুখু দৌড়ে ধরতে গেল হাজি পালোয়ানকে। মাটির দেহ মিশে গেল মাটিতে। ধরতে পারল না। দৌড় দেওয়ার সময় একটা ঢুস খেলো কবরের দেয়ালের সঙ্গে। সঙ্গে সঙ্গে ঘুম ভেঙে গেল তার। আকাশে কড়া রোদ উঠেছে। দেখল মানুষের আনাগোনা বেড়েছে। তবে কি এতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিল সে দেয়ালে ঠেস দিয়ে!
চলবে...