শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

কিশোর উপন্যাস

দুরন্ত দুখু

আপডেট : ১৮ জুলাই ২০২১, ১৮:৩১

॥ দশ ॥

 

উপরি আয়

 

মুয়াজ্জিনের কাজ আর মক্তবের খুদে শিক্ষকের আয়েও সংসার চলে না। এ রোজগারে আর কয়টি পয়সা জোটে! অভাবের দুশ্চিন্তা আর স্বভাবকবির কাব্য-তাড়নার সঙ্গে বাস্তবের যুক্তি মিলেমিশে দুখুর ভেতরে নিরন্তর বইতে লাগল অন্য ঢেউ, অন্য সুর। ঢেউ আর সুর সামাল দিতে পারল না সে। রাতের বেলায় বসতে শুরু করল কবিগানের আসরে। আর এ আসরে ঢোকার পথে গোপন টান দিয়েছেন চাচা বজলে করিম। ফারসি ও উর্দু ভালো জানলেও তাঁর ‘লেটো’ দলের জন্য তিনি মাতৃভাষা বাংলায় কবিতা লিখতেন। পদ্যরচনায় তাঁর কাছে হাতেখড়ি হয় দুখুর। তাঁর সান্নিধ্যে স্বপ্নের বীজ রোপিত হয়ে গেলেও আসরে আসরে চাচার যোগ্যতার উঁচু সীমা ছাড়িয়ে যেতে লাগল। কবিতা আর গানের নেশায় মেতে মুখে মুখে ছড়া বানাতে শুরু করল। এ যাত্রাপথের টান কোত্থেকে আসছে টের পাচ্ছে না দুখু। একদিন অবাক হয়ে গেলসবাই তাকে কবি, আমাদের কবি বলে ডাকছে। রাতারাতি খুদে কবি বনে যাওয়ার আনন্দোল্লাস কিছুই টের পেল না নিজে। অথচ গ্রামের মানুষজনের চোখের ভাষা, মুখের কথা আর আচরণে বুঝতে পারল সবাই তাকে বেশ সম্মান দেয়, কদর করে। গাঁয়ের সবার গর্বের ধন হয়ে উঠল সে।

যাত্রাপালা, কবিগান, ঝুমুর নাচ সব আসরে ডাক পড়তে লাগল দুখুর। সূর্য ডোবার পরপরই খাওয়াদাওয়ার পাট চুকে যায় গ্রামে। গাঁয়ের মানুষজন, বিশেষ করে ছোকরারা, বিনোদনের জন্য ছুটে যায় এসব অনুষ্ঠানে। অচিরেই জনপ্রিয় হয়ে উঠল কবিগানের বিশেষ ধরন ‘লেটো’ গানের আসর। গানেই সীমাবদ্ধ ছিল না এ আসর। নাচও হতো একইসঙ্গে। গাইতে গাইতে নাচা কিংবা নাচের তালে ছন্দে ছন্দে গান গাওয়াএ কাজে থাকা চাই গলার সুর, হারমোনিয়াম বাজানোর দক্ষতা, ঢোল-তবলা, খোল-করতাল, এমনকি বাঁশি বাজানোর নৈপুণ্যও। দুখুর এ সব গুণই রয়েছে। আর এই গুণের সুবাদে চুরুলিয়া ও তার আশপাশের তিনটি দল ছুটে আসতে লাগল তার কাছে।

নিমশাহ গ্রামের লেটো দলের ওস্তাদ একদিন দেখা করলেন দুখুর সঙ্গে। আদর আর সম্মান দিয়ে বললেন, ‘গান লেখো না আমাদের জন্য। পারলে পালাগানও লেখো। একেবারে বিনে পয়সায় নয়, যা পারি কিছু দেবো।’

ওস্তাদের কথা শুনে দুখুর সব ইন্দ্রিয় ও অনুভব কৌতূহলে সচল হয়ে উঠল। পুরো পৃথিবীকে নিজের ভেতর শুষে নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। শ্রদ্ধাভরে ওস্তাদের উদ্দেশে বলল, ‘দেখি না চেষ্টা করে।’

চেষ্টা করার প্রয়োজন হলো না। কাজে হাত দিতে অচিরেই ফলে ফুলে ভরে উঠল ডালি। সেই ডালিতে উঠে এলো ‘চাষার সং’, ‘শকুনি-বধ’, ‘মেঘনাদবধ’, ‘দাতা কর্ণএমন সব পালা। গানের পর গান লেখা শুরু করল দুখু। চাহিদার পর চাহিদা বাড়তে লাগল। চুরুলিয়া গাঁয়ের লেটো দল তাকে ধরে রাখতে চাইল। আবার রাখাখুড়া গাঁয়ের দলও ছুটে এলো তার কাছে।

কেউ এসে বলল, ‘আমরা গান চাই।’

দুখু বলল, ‘ঠিক আছে। লিখে দিচ্ছি।’

কেউ চায় ছড়া, কেউ কবিতা, কেউ নাটক। কাউকে ফেরায় না দুখু। এভাবে লেটো দলের সঙ্গে মিশে গেল দুখু। এ এক নতুন জগৎ। নাচ! গান! কবিতা! বাঁশি! অভিনয়! অপরূপ হয়ে উঠল দুখুর দুঃখী জগৎএ জগতে উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে আনন্দ! সুনাম ছড়াচ্ছে। যৎসামান্য আর্থিক যোগও ঘটছে। এ আয়ে জোড়াতালি দিয়ে চলছে সংসারমা-ভাই-বোনের মুখে জুটছে অন্ন। দুঃখ আর দারিদ্র্যের ভেতর দিয়ে চলতে থাকলেও তার সামনে হঠাৎ উন্মোচিত হয়ে গেল এর আগে থেমে যাওয়া শিক্ষা অর্জনের সুযোগ, খুলে গেল আবার শুরুর সিংহদ্বার।

দুখুর জয়জয়কারে মা জাহেদা খাতুন খুশি। খুশিভরা মনের আড়ালেও লুকিয়ে ছিল এ মেধাবী সন্তানের সুশিক্ষার বিষয়টি। পড়াশোনা বাদ দিয়ে দুখু কেবল এসবই করে বেড়াক, মোটেই পছন্দ নয় মায়ের। তাকে নিয়ে গর্ব তৈরি হলেও শঙ্কা কম তৈরি হয়নি। কাজী ফকিরের কোনো ছেলেই কি সুযোগ পাবে না পড়াশোনার, এমনই চিন্তা থেকে খুলে গেল নতুন দরজা। স্বজনদের জানালেন নিজের মনের কথা। গ্রামের শুভানুধ্যায়ীরাও চিন্তা করতে লাগল দুখুর পড়াশোনা নিয়ে। অবশেষে এক আত্মীয় এগিয়ে এলেন সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে। দুখুরও পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার প্রবল ইচ্ছা। দুইয়ের যোগফলে বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোট থানার অজয় নদীর তীরে, মাথরুন গ্রামের কাশিমপুরে ‘নবীনচন্দ্র ইনস্টিটিউশন’-এ ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি করানো হলো দুখুকে। এটি ‘মাথরুন স্কুল’ নামে পরিচিত।

এভাবেই একদিন লেটো দলের সঙ্গে চুকেবুকে গেল দুখুর সম্পর্ক। নিমশাহ দলের খুদে ওস্তাদ দল ছেড়ে চলে যাওয়ায় মুষড়ে পড়ল দল। দলের সদস্যরা তাকে নিয়ে গান বাঁধল :

‘আমরা এ অধীন

হয়েছি ওস্তাদহীন

ভাবি তাই নিশিদিন,

বিষাদ মনে।

নামেতে নজরুল ইসলাম

কী যে দিব গুণের প্রমাণ।’

তাদের এই আকুল আবেদনও ঠেকাতে পারল না দুখুকে। চলে গেল সে দল ছেড়ে।

 

 

 

॥ এগারো ॥

 

মাথরুন স্কুলে দুখু

 

মাথরুন স্কুলে হেডমাস্টার হলেন একজন কবি, কুমুদরঞ্জন মল্লিক। এই কবির কাছাকাছি যাওয়ায় উসকে উঠল দুখুর কাব্যগুণ। স্কুলের প্রতিও বাড়তে লাগল আকর্ষণ।

শ্রেণিকক্ষে ঢুকেছেন কুমুদরঞ্জন স্যার। সবাই উঠে সমস্বরে চেঁচিয়ে বলল, ‘প্রণাম, স্যার।’

স্যার চেয়ারে বসার সঙ্গে সঙ্গে ছাত্ররাও বসে গেল। একমাত্র দাঁড়িয়ে রইল দুখু।

‘কী, তুমি দাঁড়িয়ে আছ কেন?’ প্রশ্ন করলেন হেডস্যার।

‘স্যার, আপনার অনেক কবিতা পড়ার সুযোগ হয়েছে আমার। আর আজ আপনাকে দেখছি কাছ থেকে। প্রাণের মধ্যে কী যে ঘটল, জানি না। ইচ্ছা করছে আপনার পা ছুঁয়ে প্রণাম করি। যদি অনুমতি দেন তো...’

‘কেন, প্রণাম করতে অনুমতি লাগবে কেন?’

‘আজই প্রথম দেখলাম সামনাসামনি আপনাকে। তাছাড়া এত ছেলের সামনে আমি একা প্রণাম করলে শোভন দেখাবে না, স্যার।’

‘সত্যিই আমার কবিতা পড়েছ?’

‘জি স্যার।’

‘দেখি, মনে আছে কি না তোমার? কয়েকটা লাইন বলো তো!’

কয়েকটা লাইন নয়, পুরো একটি কবিতা গড়গড় করে মুখস্থ আবৃত্তি করল দুখু। হতবাক হয়ে গেলেন কুমুদরঞ্জন মল্লিক। নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে দাঁড়ানো দুখুর মাথায় হাত রাখলেন। লাজুক দুখু অবনত হয়ে থাকলেও এ হাতের ছোঁয়া পেয়ে কেঁপে কেঁপে উঠল। ভূকম্পন নয়, এ কম্পন ঘটে গেল তার কাব্যপ্রতিভার মূল উৎসে, উৎসের প্রাণকেন্দ্রে।

নিজের চেয়ারে ফেরত গিয়ে সবার উদ্দেশে স্যার বললেন, ‘ওকে কি ওর ইচ্ছাপূরণের সুযোগ দেওয়া উচিত?’

সবাই জবাব দিলো, ‘ইয়েস স্যার।’

‘এসো। সবার ভোট পেয়েছ তুমি। গণতান্ত্রিকভাবে তুমি জয়ী হয়েছ। এসো। ইচ্ছাপূরণ করো।’

হেডস্যারের কথা শুনে লজ্জার খোলস থেকে বেরিয়ে ঠিকই সে এগিয়ে গিয়ে প্রণাম করল। স্যার হাসতে হাসতে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী নাম তোমার?’

‘দুখু।’

‘দুখু! না না, দুখু নামে মানায় না তোমাকে। তোমার নাম দিলাম সুখু।’

‘না স্যার। মা আমাকে দুখু নামেই ডাকেন। আপনিও ওই নামে ডাকলে খুশি হব আমি।’

তাজ্জব বনে গেলেন কুমুদরঞ্জন মল্লিক। কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন, তারপর গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘এই প্রথম আমার মুখের ওপর কথা বলল কোনো ছাত্র। আমার ইচ্ছার দাম না দিয়ে নিজের ইচ্ছায় অটল রইল।’

কথাটা শেষ করে থেমে রইলেন তিনি। ছাত্ররা বুঝল স্যার খেপে গেছেন। নিশ্চয় বড়ো শাস্তি অপেক্ষা করছে দুখুর জন্য। অথচ সবাই এর মধ্যে দুখুকে পছন্দ করে ফেলেছে। তার কীর্তি-কাহিনি জেনে ফেলেছে।

কুমুদরঞ্জন স্যার প্রশ্ন করলেন, ‘ওর কী শাস্তি হওয়া উচিত?’

সবার দম বন্ধ হয়ে গেল। কেউ কেউ ঘামতে শুরু করল। এক ছাত্র উঠে সাহস করে বলে ফেলল, ‘ওকে মাফ করে দেন, স্যার।’

‘কেন? মাফ করব কেন? ও কি কোনো অপরাধ করে ফেলেছে?’

আবারও শ্রেণিকক্ষে পিনপতন নীরবতা। স্যারের গলার স্বর আর কথার মধ্যে কী লুকিয়ে আছে, কেউ ধরতে পারছে না। হঠাৎ হো-হো হাসিতে ফেটে পড়লেন কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক। হাসতে হাসতে বললেন, ‘ও সাহসী। মনের আসল কথাটা বলতে দ্বিধা করেনি। বরং মায়ের কথাকে মাথার মুকুট বানিয়ে রেখেছে। ওর জন্য শাস্তি হচ্ছে জোরে একটা তালি।’

জোরে জোরে তালি দিতে লাগল ছাত্ররা। শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে মুক্তি পেয়ে উল্লাসে ফেটে পড়ল সবাই।

দুখু এবার বলল, ‘স্যার, আমি সত্যিই দুঃখী স্যার। বাবা মারা যাওয়ার পর পড়াশোনা করতে পারিনি দুই বছর। রোজগার করতে হয়েছে ঘরের অন্ন জোগানোর জন্য। মক্তবে চাকরি করেছি, মুয়াজ্জিনের কাজ করেছি। হাজি পালোয়ানের কবরের খাদেম হিসেবে কাজ করেছি। দুঃখের শেষ নেই স্যার আমার।’

দুখুর কণ্ঠের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে মায়াবী স্বর। প্রতিটি বর্ণ কাঁপিয়ে দিলো স্যারের মন। কঠোর খোলস ঝেড়ে মায়াবী কণ্ঠে এবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার আসল নাম কী?’

‘কাজী নজরুল ইসলাম।’

‘কোন গ্রাম থেকে এসেছ তুমি?’

‘চুরুলিয়া, স্যার।’

‘ওঃ! তুমি কি ‘নিমশাহ’ লেটো দলের খুদে ওস্তাদ কাজী নজরুল ইসলাম, দুখু?’

‘ওস্তাদ নয়, স্যার। সদস্য।’

‘আমি জানি। এরই মধ্যে তোমার অনেক প্রশংসা শুনেছি। বিখ্যাত কবিয়াল শেখ চকোর আমার কাছের লোক। সবাই তাকে ‘গোদা কবি’ বলে ডাকে; আমাকে জানিয়েছেন নিমশাহ দলের এক খুদে কবির গুণে মুগ্ধ তিনি। আদর করে তাকে ‘ব্যাঙাচি’ বলে ডাকেন তিনি। তুমি কি সেই ব্যাঙাচি?’

আবার মাথা নত হয়ে গেল দুখুর। সবাই ‘ব্যাঙাচি’ শব্দ শুনে হেসে উঠল।

কুমুদরঞ্জন স্যার এবার গম্ভীর হয়ে গেলেন। ভরাট গলায় সবার উদ্দেশে প্রশ্ন করলেন, ‘হাসলে কেন তোমরা?’

সবাই চুপ।

দুখুই জবাব দিলো, ‘শব্দটিই হাস্যকর, স্যার। হাসির শব্দে হাসবে সবাই, এটা কি অন্যায়, স্যার?’

‘না, অন্যায় না। মজাদার কথায় হাসবে, কিন্তু কথা তো শেষ হয়নি। ‘গোদা কবি’ শেখ চকোর আরও বলেছেন, ‘এই ব্যাঙাচি বড়ো হয়ে সাপ হবে। কথাটা শুনতে হবে না সবাইকে?’

আবারও হাসির রোল উঠল।

এক ছেলে দাঁড়িয়ে সাহস করে প্রশ্ন করল, ‘ব্যাঙাচি কীভাবে সাপ হবে, স্যার?’

‘এই ব্যাঙাচি সেই ব্যাঙাচি নয় গাধা। এ সাপ সেই সাপ নয়এর অর্থ এখন যাকে নেহাত সাধারণ ও সামান্য মনে করে অবহেলা করছ, ভবিষ্যতে সে-ই হয়ে উঠবে উল্লেখযোগ্য, অসামান্য, অপ্রতিরোধ্য।’

স্যারের কথা শুনে ভবিষ্যতের কবির উদ্দেশে সবাই জোরে হাততালি দিলো। সেই তালিতে অংশ নিলেন কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিকও।

 

চলবে...