শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

মেয়ে দেখতে কেমন, ফরসা তো!

আপডেট : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১২:০০

‘মেয়ে দেখতে কেমন?’, ‘গায়ের রং ফরসা না কালো বর্ণের?’, আমাদের সমাজে এমন ধরনের কথাগুলোর পরিচিতি এখনো রয়েছে। আমরা অর্থসম্পদকে বিতর্কের বিষয় করে শ্রেণি-বৈষম্যের চাকার পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তিতর্কে ভুলেই বসেছি সমাজে বর্ণ-বৈষম্যের মাত্রা এখনো কতটা গভীর! বেশ প্রসিদ্ধ একটা প্রবাদ রয়েছে: অভাব যখন দরজায় এসে দাঁড়ায়, ভালোবাসা তখন জানালা দিয়ে পালায়’ বলতে চাইছি অস্তিত্বকে টিকিয়ে রেখে কোনো রকম বাঁচার তাগিদে হোক কিংবা উচ্চাভিলাষ জীবনের স্বাদ ভোগ করার জন্যই হোক, সবকিছুর মূলমন্ত্র যেহেতু অর্থ সেখানে সুন্দর-অসুন্দরের তর্ক অনেকের কাছে নিছক অপ্রয়োজনীয় প্রসঙ্গ হতে পারে।

বর্তমানে সৌন্দর্য বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে বিভিন্ন প্রসাধনী বিক্রয়ের বাজারে একপ্রকার দারুণ প্রতিযোগিতায় নেমেছে বিশ্বের খ্যাতনামা কোম্পানিগুলো। সেই আসরে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন দেশের তরুণ যুবক-যুবতিরা। মেয়েরা মুখের কালো বা শ্যামবর্ণকে ঢেকে রাখতে ব্যবহার করছেন নানান ক্রিম এবং মেকআপ ফাউন্ডেশন। শুধু অনুজ্জ্বল নারীরাই নয় বরং ফরসাদের আরো উজ্জ্বল দেখাতে প্রয়োগ করে সে সব প্রসাধনীসমূহ। আমার ভাবনার বিষয়টি তাদের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধির বিপক্ষে নয়, তবে ফরসা বর্ণের মানুষই দেখতে একমাত্র প্রশংসার দাবিদার এমন মতাদর্শের নিন্দা জানাই।

জীবনব্যাপী জীবনানন্দ দাশ নারীর প্রেম, সৌন্দর্য ও উদার মহত্ত্ব খুঁজেছেন। তাই তো ঘুরেফিরে নারীর সৌন্দর্য ও অমল অন্তঃসারের কথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে তার কবিতার পঙক্তিতে, ‘তুমি জল’, ‘তুমি ঢেউ’, ‘সমুদ্রের ঢেউয়ের মতন তোমার দেহের বেগ’। নারীকে প্রকৃতির সঙ্গে তুলনা করেছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, পল্লীকবি জসীম উদ্দীনসহ অনেকেই। তারা মানবীর রঙকে ভিন্নভিন্ন আঙিনায় দেখেছেন। কখনো নারীকে ধানের সবুজ মাঠ, কেউ কেউ লাল গোলাপের পাপড়ির সঙ্গে সাদৃশ্য দেখিয়ে সৌন্দর্যকে বিশ্লেষণ করেছেন। আবার প্রচণ্ড কড়া রৌদ্রময় পরিবেশে ক্লান্ত কৃষকের ঘামেভেজা শরীর তাদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন।

কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য আমরা এখন নর-নারীর সৌন্দর্যের উপমা বলতে ফরসা বা সাদা বর্ণের হওয়াটাকেই বুঝি। বাঙালির অতীতে রীতিমতো মেয়েদের বিয়ের প্রচলন ছিল পায়ের বা হাতের রং যাচাই করে, অর্থাত্ যে নারীর এ দুটি অঙ্গ যত বেশি উজ্জ্বল সে তত বেশি সুন্দরী। কিন্তু প্রচলিত এ সংস্কৃতির পুরো প্রভাব বেশ কিছু গ্রামাঞ্চল ছাড়া এখন তেমন দেখা না গেলেও এর বর্তমান রূপান্তর ঠিকই সর্বত্র দৃষ্টিগোচর হয়। এখন পা কিংবা হাতের চেয়ে মুখের মাধুর্যতায় বেশি প্রাধান্য পায়। যার ফলে মুখের বিভিন্ন প্রসাধনী ব্যবহার করে কৃত্রিমভাবে ফরসা হওয়ার প্রতিযোগিতার প্রবণতা বেশি।

সৌন্দর্যের বিচার করা উচিত মানুষের আচার-আচরণ ও বুদ্ধিমত্তার দ্বারা। কেননা প্রকৃতির যে রূপ তা আগে থেকেই সাবলীল। একে সংজ্ঞায়িত করার কিছু নেই। তবে যখন এই রূপকে মানুষ তার আপন যৌক্তিক চিন্তার বা ক্রিয়াকর্মের দ্বারা নতুন আঙ্গিকে সৃষ্টি করবে তখনি তা হবে নান্দনিক। সেই নব উদ্ভাবন হবে সুন্দর। ঠিক একইভাবে চিন্তা করলে মানুষের সৌন্দর্যকে বর্ণনা করা যায়। জগতে মানবের রূপের যত সংজ্ঞা এসেছে তা আমাদেরই দেওয়া।

সময় এসেছে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর। আমাদের দেওয়া সুন্দরের এই অলিখিত সংজ্ঞাকে পরিবর্তন করতে হবে। এক জন শ্যাম বা কালো বর্ণের মানুষ দিনশেষে মানুষ বলেই গণ্য হয়। যার রয়েছে ন্যায্যবিচার করার সচেতন বিবেক ও মনুষ্যত্ব। আমাদের সৌন্দর্যের চেতনায় বৈচিত্র্য আনতে হলে বিবেকের রঙকে বদলাতে হবে। তবেই বর্ণবৈষম্যহীন সমাজ গড়ে তুলতে সক্ষম হব।

লেখক: সাজ্জাদ হোসেন

শিক্ষার্থী, সমাজ বিজ্ঞান অনুষদ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন