বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

পাশের মানুষটি হতে পারেন আপনার মৃত্যুদূত

আপডেট : ২৬ মার্চ ২০২০, ১০:৫৯

করোনা ভাইরাসজনিত রোগ সারা বিশ্বকে ওলট-পালট করে দিচ্ছে, যার শুরুটা হয়েছিল চীনের উহান প্রদেশে। এখন এই ভাইরাসের বিশ্বায়ন ঘটেছে। চীনের পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে বলে তারা দাবি করছে। এ পর্যন্ত তামাম বিশ্বের প্রতিটি মহাদেশে তা প্রবেশ করেছে এবং বিশ্বের প্রায় সব দেশের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা স্থবির করে দিয়েছে। সব দেশের বিমানবন্দর কার্যত বন্ধ, অনেক শহরে কারফিউ জারি করা হয়েছে অথবা সাধারণ মানুষকে রাস্তায় বের না হতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বিনা কারণে পরামর্শ অমান্য করলে মিলছে অর্থদণ্ড, বেত্রাঘাত ও জেল। এক দেশ থেকে অন্য দেশ, এক শহর থেকে অন্য শহর, এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় যাতায়াতের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। কয়েক দিন আগে ইতালিতে ৯ জন বাংলাদেশিকে বাড়ির বাইরে যাওয়ার অপরাধে প্রতিজনকে ৩০০ ইউরো করে জরিমানা করা হয়েছে। কুয়েতের কোনো কোনো শহরে যারা চলাচলের নিষেধাজ্ঞা মানতে চাইছে না, তাদের দশ ঘা বেত্রদণ্ড দিয়ে জরিমানা করা হচ্ছে, অন্যথায় মিলছে কারাদণ্ড। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক মসজিদে জামায়াতে নামাজ পড়া বন্ধ করা হয়েছে। পবিত্র কাবাগৃহ তাওয়াফ করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে বেশ কয়েক দিন আগে। গত শুক্রবার পবিত্র মক্কা নগরীর কাবাগৃহে ও মসজিদে নববিতে আজান হয়েছে, কিন্তু সাধারণের জন্য জুমার নামাজ হয়নি। অন্যান্য মসজিদেও একই অবস্থা। ইরান ও মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে আগেই মসজিদে জুমার নামাজ বন্ধ করা হয়েছে। খ্রিষ্টানদের ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস ভ্যাটিকানে বারান্দা থেকে প্রতিদিন জমায়েত হওয়া হাজার হাজার খ্রিষ্টধর্মের অনুসারীদের ঈশ্বরের বাণী আর শোনান না। কারণ সেখানে মানুষ জমায়েত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। থাইল্যান্ডের বড়ো বড়ো বৌদ্ধমন্দিরে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। ভারতের সবকিছু বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশেও সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বাড়ি থেকে অনেকে অফিস করছেন। ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত দেশের সব সরকারি অফিসে ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।

করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) মোকাবিলার জন্য যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়েছিল ইতালি। তবে একটি ভুলের কারণে আজ ইতালিতে মৃত্যুর মিছিল থামানো যাচ্ছে না। প্রথম দিকে করোনাজনিত সমস্যা মোকাবিলায় পারদর্শিতা দেখিয়ে ইতালি সারা ইউরোপে প্রশংসিত হয়েছিল। সে সময় এই ভাইরাসে যারাই আক্রান্ত হয়েছেন, তারা হাসপাতাল থেকে চিকিত্সা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। কিন্তু দেশটির মিলান শহর থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরের কডোনা এলাকায় করোনায় সংক্রমিত এক বাসিন্দা হাসপাতালে ভর্তির আগে কোনো সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেননি। উপসর্গ সম্পর্কে তিনি বা তার পরিবার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে সঠিকভাবে অবহিত করেননি। করোনা ভাইরাসবাহী ঐ রোগীর কারণে হাসপাতালটির অন্যান্য রোগী ও কর্মীর মধ্যে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। তার পরের ইতিহাস তো একটি সমগ্র দেশের মৃত্যুপুরী হয়ে ওঠার ইতিহাস। আমাদের বাংলাদেশি ভাইয়েরা, যারা ইতালি বা অন্যান্য দেশ থেকে দেশে ফিরে বাংলাদেশের মা-বাপ তুলে গালাগাল করেন, তারা কি এসব তথ্য জানেন? জেনেও না জানার ভান করে তারা শুধু নিজেদের পরিবার বা এলাকার মানুষকেই বিপদগ্রস্ত করে তুলছেন না, তারা সারা দেশের ১৭ কোটি মানুষকে বিপদগ্রস্ত করে তুলছেন।

দক্ষিণ কোরিয়ার ঘটনাও অনেকটা একই রকম। তাদের প্রথম করোনা ভাইরাস রোগী শনাক্ত করা হয় ২০ জানুয়ারি। তিনি ৩৫ বছর বয়সি এক মহিলা। তিনি চীনের উহান প্রদেশ থেকে সিউল বিমানবন্দরে অবতরণ করেন ঐ দিন। সঙ্গে সঙ্গে তাকে সেলফ কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়। এর পরের এক মাসে মাত্র ৩০ জন করোনা ভাইরাস রোগী শনাক্ত করা হয়। সবাই হাসপাতাল থেকে চিকিত্সা নিয়ে ভালো হয়ে বাড়ি ফেরেন। দক্ষিণ কোরিয়ার এহেন তাক লাগানো সফলতা দেখে সবাই বেশ খুশি। ফেব্রুয়ারির ৬ তারিখে মাঝ বয়সি এক মহিলা সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে চিকিত্সা নেন নিকটস্থ ডায়গু শহরের হাসপাতালে। চিকিত্সাধীন অবস্থায় ৯ ও ১৬ ফেব্রুয়ারি তিনি একটি গির্জায় যান প্রার্থনা করতে। এর মধ্যে ১৫ তারিখ তার জ্বর ধরা পড়ে। ডাক্তাররা তাকে করোনা ভাইরাসের পরীক্ষা করতে পরমর্শ দেন এবং তাকে একই সঙ্গে সেলফ আইসোলেশনে (কারো সঙ্গে দেখা করবেন না, কথা বলবেন না, অন্য কাউকে স্পর্শ করবেন না) থাকার নির্দেশ দেন। এসব পরামর্শ উপেক্ষা করে তিনি ১৬ তারিখ তার এক বন্ধুর সঙ্গে একটি রেস্তোরাঁয় যান দুপুরের খাবার খেতে। ১৭ তারিখ ঐ মহিলার অবস্থার অবনতি হলে তিনি করোনা ভাইরাসের জন্য পরীক্ষা করান। ১৮ তারিখ ফলাফল এলে দেখা যায় পরীক্ষায় পজিটিভ, অর্থাত্ তিনি এই ভাইরাসে আক্রান্ত। তিনি দক্ষিণ কোরিয়ার রোগী নম্বর ৩১। এর কয়েক দিনের মধ্যেই সমগ্র দক্ষিণ কোরিয়ায় এই ভাইরাস জ্যামিতিক হারে ছড়িয়ে পড়ে। প্রথম ধাক্কায় দেখা যায় ঐ মহিলা যে গির্জায় প্রার্থনা করতে গিয়েছিলেন, সেখানে দুই দফায় ৯ হাজার ৩০০ জন উপস্থিত ছিলেন, যাদের ১ হাজার ২০০ জন এই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন। রেস্তোরাঁয় কতজন উপস্থিত ছিল, তার সঠিক হিসাব পাওয়া যায়নি। মনে রাখতে হবে, দক্ষিণ কোরিয়ার জনসংখ্যা ৫ কোটির সামান্য বেশি।

বাংলাদেশের জনসংখ্যা বর্তমানে ১৭ কোটির বেশি। বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল। গত কয়েক সপ্তাহে বিদেশ থেকে যারা দেশে ফিরেছেন, তাদের একটি বড়ো অংশ ইতালি ও ইউরোপের অন্যান্য একাধিক দেশ থেকে এসেছেন। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, যতক্ষণ পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া না যাচ্ছে, ধরে নিতে হবে যে তারা প্রতিজনই করোনার মতো একটি ভয়াবহ রোগের ফেরিওয়ালা। সরকার তাদের বাড়িতে দুই সপ্তাহের মতো বন্দিজীবন যাপন করতে বলেছেন। কিন্তু তাদের বেশির ভাগই সরকারের এই নির্দেশ মানছেন বলে মনে হয় না। কেউ গিয়ে বসছেন বিয়ের পিঁড়িতে, কেউ বউ-বাচ্চা নিয়ে হাওয়া খেতে কক্সবাজারে যাচ্ছেন আবার কেউ কেউ কদিন জামাই আদরে থাকার জন্য পরিবারসহ যাচ্ছেন শ্বশুরবাড়ি। কোনো কোনো এলাকায় প্রশাসন বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের এসব কাজে বাধা দিতে গেলে হচ্ছেন অপদস্ত। এই অবস্থায় এগিয়ে আসতে হবে এলাকার মানুষকে। নির্মম শোনালেও সত্য, এদের প্রত্যেককে চিহ্নিত করতে হবে তাদের পরিবারের একাধিক ব্যক্তির সম্ভাব্য সংক্রামক হিসেবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা এসব মানুষকে নিবৃত্ত করতে এলে তাদের সহায়তা করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প তাদের কাছে নেই। তারা এই মুহূর্তে তাদের পরিবারের নীরব ঘাতক হয়ে উঠতে পারেন। বিপদের কারণ হতে পারেন এলাকাবাসীর এবং সব শেষে দেশের। আর সরকারকেও আরো কঠোর হতে হবে। সরকারের সস্তা জনপ্রিয়তার প্রয়োজন নেই। কিছুদিনের জন্য রাতে ও দিনের একটা সময়ের জন্য কারফিউ জারি করে দেখা যাক না। জনগণ বেশি বেয়াড়া হলে তাদের শান্ত করার অনেক ঔষধ সরকারের ঝুলিতে আছে। ইতিমধ্যে সরকার বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা করার জন্য সেনাবাহিনীকে মাঠে নামিয়েছে। ধরে নিতে হবে, অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও একটি চরম অস্বাভাবিক পরিস্থিতি চলছে। এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য সরকারের কঠোর হওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় আপাতত দেখা যাচ্ছে না।

সব শেষে কাছের দেশ মালয়েশিয়ার কথা বলে শেষ করি। ঐ দেশে এ পর্যন্ত ১ হাজার ৬২৪ জনের মতো করোনা রোগে আক্রান্ত হয়েছেন, যার অর্ধেকই কিছুদিন আগে তাবলিগ জামাতের ইজতেমায় যোগ দিয়েছিলেন। এ পর্যন্ত সেই দেশে ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাবলিগ জামাত এই কাজ ইন্দোনেশিয়া ও ব্রুনাইতেও করেছে। সেই সব দেশেও একই অবস্থা। বাংলাদেশেও একশ্রেণির ধর্মান্ধ মানুষের চিন্তাভাবনা এদের মতোই। অথচ হাদিসে পরিষ্কার বর্ণিত আছে এমন পরিস্থিতি এড়িয়ে চলতে। ইমানের চর্চা ঘরে বসেও করা যায়। সৃষ্টিকর্তা সব স্থানে বিরাজ করেন। সবাই সুস্থ থাকুন, পরিবারের সদস্যদের নিরাপদে রাখুন, অন্যকে নিরাপদে থাকতে সাহায্য করুন। এমন মৃত্যু আলিঙ্গন করবেন না, যেখানে আপনার জানাজায় নিজ পরিবারের সদস্যরাও অংশ নিতে পারবেন না।

 

লেখক: আবদুল মান্নান

বিশ্লেষক ও গবেষক

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন