শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

বিশেষজ্ঞ কলাম

গর্ভবতী মায়েদের দুশ্চিন্তার কিছু নেই

আপডেট : ২৬ এপ্রিল ২০২০, ০১:৫২

করোনা ভাইরাস ইনফেকশনের জন্য গর্ভবতী মায়েদের আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। গর্ভবতী মেয়েদের মধ্যে কোভিড-১৯-এর সংক্রমণের জটিলতা সাধারণ মানুষের মতোই। শুধু গর্ভবতী হওয়ার জন্য কোভিডে আক্রান্ত হলে রোগের জটিলতা ও মৃত্যুভয় বেড়ে যাবে তা ঠিক নয়। তবে ইদানীং প্রকাশিত রয়েল কলেজ অব অবস্টেট্রিকস অ্যান্ড গাইনোকোলজি এক নির্দেশনায় গর্ভবতী নারীদের ‘ভালনারেবল গ্রুপ’, অর্থাত্ অধিক সংবেদনশীল শ্রেণি হিসেবে অভিহিত করেছে। কারণ গর্ভধারণ এমনিতেই মেয়েদের ইমিউন সিস্টেমে (রোগ প্রতিরোধক্ষমতা) প্রভাব ফেলে। এমনিতেই এ সময় তাদের শ্বাসতন্ত্রের ইনফেকশন সংক্রমণের হার বেশি থাকে। তাই গর্ভবতীদের অন্যদের তুলনায় কোভিডের সময় অধিক সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে।

তবে বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রেগন্যান্ট অবস্থায় করোনায় আক্রান্ত হলে গর্ভপাত হওয়ার অধিক কোনো সম্ভাবনা নেই। প্রসূতিরা এন্টি নেটাল চেকআপ তাদের নির্ধারিত বিশেষেজ্ঞদের সঙ্গে টেলিফোনেই করে নিতে পারবে। তবে জরুরি প্রয়োজন হলে কোভিড রোগী অথবা সন্দেহজনক কোভিড গর্ভবতী তার গাইনোকোলজিস্টের সঙ্গে পূর্বে কথা বলে হাসপাতালে পরামর্শ নিতে পারবে। এ ক্ষেত্রে রোগীকে আগেই তার ডাক্তার কিংবা হাসপাতালকে জানাতে হবে। তাহলে ঐ বিশেষজ্ঞ কী করে ঐ রোগীকে সেবা প্রদান করবেন, তা রোগী হাসপাতালে আসার আগেই নির্ধারণ করে রাখবেন।

সাধারণ জ্বর-কাশি হলে গর্ভবতীদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার কোনো দরকার নেই। শুধু তীব্র জ্বর ও শ্বাসকষ্ট হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।

আরও পড়ুনঃ ছুটির সময়ে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে যেসব ডিভাইস

করোনা ভাইরাস সাধারণত সরাসরি মা থেকে গর্ভস্থ সন্তানের দেহে সংক্রমিত হয় না। তবে কদিন আগে বিখ্যাত মেডিক্যাল জার্নাল ‘ল্যানসেট ইনফেকশাস ডিজিজে’ ২৪ মার্চ সংখ্যায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে মা থেকে সন্তানের কোভিড হয়েছে এ-সংক্রান্ত তিনটি কেস প্রকাশ করেছে। সুতরাং মা থেকে সন্তানের এই অসুখ হতে পারে (ভার্টিক্যাল ট্র্যান্সমিশন) সন্দেহটা কিন্তু থেকেই যায়। তবে সেই সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ। কিন্তু ঐ নিবন্ধে বলা হয়েছে, যেসব সদ্যোজাত শিশুর কোভিড হয়েছিল, তারা সবাই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছে।

প্রসব বেদনা নিয়ে কোনো কোভিড আক্রান্ত গর্ভবতী নারী জরুরি বিভাগে গেলে তার শারীরিক অবস্থা প্রথমে নিরূপণ করা উচিত। যদি অবস্থা অতটা জটিল না হয়, তবে তাকে শুধু কোভিড চিকিত্সার জন্য নির্ধারিত এমন কোনো হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া উচিত। কিন্তু রক্তপাত কিংবা অন্য কোনো কারণে যদি রোগীর জীবনাশঙ্কা দেখা দেয়, তাগলে ঐ হাসপাতালেই যথাযথ ব্যক্তিগত সুরক্ষাব্যবস্থা মেনে ঐ রোগীর স্বাভাবিক প্রসব কিংবা সিজারিয়ান সেকশন অপারেশন করা উচিত। তা না হলে রোগীকে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে স্থানান্তর করার সময় রাস্তায় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

করোনা সংক্রমণের সময় নতুন করে যাতে কেউ গর্ভধারণ না করে, সেদিকে তীক্ষ দৃষ্টি রাখা উচিত। অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি) এ সময় যাতে নতুন করে গর্ভসঞ্চার না হয়, সে ব্যাপারে নির্দেশনা দিয়েছে।

করোনা ভাইরাস মায়ের বুকের দুধ দিয়ে সংক্রমিত হয় না। তাই ইচ্ছা করলে মা তার সদ্যোজাত শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াতে পারেন। কিন্তু তা হতে হবে কঠোর নিয়মের মাধ্যমে। তিনভাবে মা তাকে দুধ খাওয়াতে পারেন—১. হাত ভালো করে সাবান দিয়ে ধুয়ে, মুখে মাস্ক লাগিয়ে, পরিষ্কার কাপড় পরে, হাতে গ্লাভস পরে বুকের দুধ খাওয়াতে পারবেন। বাচ্চাকে বুকের দুধ দেওয়ার সময় কাশি শিষ্টাচার মানা অত্যাবশ্যকীয়। ২. এক্সপ্রেসড মিল্ক পদ্ধতিতেও মা বাচ্চাকে নিজের বুকের দুধ খাওয়াতে পারবেন। এই পদ্ধতিতে ব্রেস্ট পাম্প দিয়ে বুকের দুধ বের করে অন্য একজনের মাধ্যমে ঐ দুধ বাচ্চাকে খাওয়ানো যেতে পারে। ৩. মা যদি বেশি অসুস্থ থাকেন, তবে ‘ওয়েট মাদার’ পদ্ধতি গ্রহণ করা যেতে পারে। এই পদ্ধতিতে অন্য আরেকজন মায়ের বুকের দুধ সাময়িক সময়ের জন্য বাচ্চাকে দেওয়া যেতে পারে।

কোভিড আক্রান্ত গর্ভবতীর চিকিত্সা আর সাধারণ আরেকজন করোনা আক্রান্ত রোগীর চিকিত্সায় কোনো পার্থক্য নেই। আমাদের ন্যাশনাল গাইডলাইন নির্দেশিত ওষুধ দুটি দিয়েই চিকিত্সা করতে হবে। ওষুধ দুটি হলো হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন (রেকোনিল, কোভিকিল) ও অ্যাজিথ্রোমাইসিন (অ্যাজিথ, অডাজ, জিম্যাক্স ইত্যাদি)। তবে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন ব্যবহারের সময় যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করার জন্য অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) নির্দেশনা রয়েছে। গর্ভধারণের প্রথম ২৮ সপ্তাহ এই ওষুধ ব্যবহার করা যাবে না। এতে বাচ্চার চোখে ও কানে পার্শ্বক্রিয়া দেখা দিতে পারে। কিন্তু গর্ভধারণের শেষ তিন মাসে রিস্ক বেনিফিট চিন্তা করে গর্ভবতীকে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন খাওয়ানো যেতে পারে। হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন এফডিএ রিস্ক ক্যাটাগরি-ডি ড্রাগ, তাই জটিলতা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু অ্যাজিথ্রোমাইসিন এফডিএ রিস্ক ক্যাটাগরি-বি ড্রাগ তাই ভয়ের কিছু নেই। তবে রোগীর জন্য যদি অত্যাবশ্যকীয় হয়, ঝুঁকি এবং লাভ বিবেচনা করে গর্ভধারণের যে কোনো পর্যায়েই দুটি ওষুধ দিয়েই গর্ভবতীর চিকিত্সা করা যাবে।

প্রফেসর অব অবস্টেট্রিকস অ্যান্ড গাইনোকোলজি

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল

 

ইত্তেফাক/এমএএম