হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বিশ্বরাজনীতির অবিসংবাদিত কিংবদন্তি তথা বাংলা ও বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীতে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। আমরা শুনেছি, মানুষটি ছোটকাল থেকেই ছিলেন পরোপকারী। রাজনৈতিক জীবন শুরু হওয়ার আগেই গ্রামের হতদরিদ্র মানুষের দুঃখ-কষ্ট দেখে তার নিজের মধ্যেই তা প্রকটভাবে নাড়া দিত। তিনি শীতার্তদের নিজের চাদর দান করতে কুণ্ঠা বোধ করেননি। আজীবন সত্যনিষ্ঠ একজন ন্যায়পরায়ণ মানুষ ছিলেন তিনি। তার রাজনৈতিক জীবন পর্যবেক্ষণ করলে দেখতে পাই তার সততা, নিষ্ঠা ও একাগ্রতা। তিনি বক্তৃতা করতেন সহজ-সরল ভাষায়, সাধারণ মানুষের মুখের কথা তিনি তার বক্তৃতায় তুলে ধরতেন। তিনি সাধারণ মানুষকে ভালোবাসতেন। তিনি যেখানে গেছেন সাধারণ মানুষ তার আপনজন হয়ে যেত। আমি যখন রাজনীতিতে ঢুকি, তখন মুজিব ভাই আমাকে যে পথ দেখিয়েছিলেন তা কখনো ভোলার নয়। তিনি বলতেন, ‘রাজনীতি করলে মানুষের কাছে যেতে হবে, বারবার যেতে হবে।’
আমার রাজনৈতিক জীবনে একবার উত্তরবঙ্গে যাই। সেখানে গিয়ে মানুষের মুখে শুনতে পাই, সেই যে মুজিব ভাই এসেছিলেন আর তো কাউকে দেখিনি আমাদের কাছে আসতে। এতদিন পর আপনাকে দেখলাম। সত্যি আমার মনে জাগ্রত হয়েছিল—যারা রাজনীতি করেন তাদের অবশ্যই সাধারণ মানুষের মনে ঢুকতে হবে, সাধারণ মানুষের চিন্তা করতে হবে। যদিও এখন সে রাজনীতি নেই, আর নেই বলেই এরকম নেতা পাওয়া বিরল।
তার সম্মোহনী শক্তি খুব প্রখর ছিল। যার কারণে তিনি সমাদৃত। পৃথিবীতে সম্মোহিনী শক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব কয়েক যুগে জম্মায় আর এসব ব্যক্তিত্বের আঙুলের ইশারায় পৃথিবীর বুকে মহাবিপ্লব সংঘটিত হয়। তেমনি সম্মোহিনী শক্তি ছিল বঙ্গবন্ধুর মধ্যে। তার সততা, নিষ্ঠা তাকে করেছে কিংবদন্তি। যেখানেই তিনি গেছেন মনে হয় সবাই তার আপন, খুব কাছের মানুষ।
তাই তো বঙ্গবন্ধু শুধু একটি নাম নয়, একটি ইতিহাস। যার নাম বাংলাদেশ। বাংলাদেশ আর বঙ্গবন্ধু অবিচ্ছেদ্য। বাংলাদেশকে জানতে হলে বঙ্গবন্ধুকেও জানতে হবে। কীভাবে একজন নেতা হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে হয় তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ বঙ্গবন্ধু। তার দীর্ঘ সংগ্রাম ছিল বহু বিচিত্র। বারবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন কিন্তু আপস করেননি। সেই যে রাজনৈতিক জীবন, যে লক্ষ্য নিয়ে রাজনীতি করেছেন সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে কত ষড়যন্ত্রের ঘেরাটোপে পার হতে হয়! তিনি তা জেনেশুনেই নিজেকে উতরেছেন। আর উতরেছেন বলেই দীর্ঘসময় জেল-জুলুম-অত্যাচার সবকিছু মাথায় তুলে নিয়েছিলেন। একটাই লক্ষ্য—দেশের সাধারণ মানুষের মুক্তি। মানুষ যেন দুমুঠো ভাত খেতে পারে; শান্তিতে, স্বস্তিতে ঘুমাতে পারে—এ ছিল তার সার্বক্ষণিক চিন্তা।
যে মানুষটি সারাটা জীবন কাটিয়েছেন দেশকে পরাধীনতার হাত থেকে মুক্ত করার জন্য, একটা স্বাধীন সার্বভৌম দেশ দেখবার জন্য, স্বাধীনতার চার বছরের মাথায় সেই মানুষটিকে হত্যা করল বিপথগামী কিছু সেনা কর্মকর্তা।
আর একটি কথা বলেই শেষ করছি। বঙ্গবন্ধু কোনো দলীয় নেতা ছিলেন না। দলমতনির্বিশেষে তিনি সবার জাতীয় নেতা। তিনি একটি দলের প্রধান হলেও সব দল নিয়ে জাতীয় ঐক্য গড়েছিলেন দেশ মুক্ত করার জন্য। তিনি জানতেন, ঐক্য ছাড়া দেশ স্বাধীন করা যাবে না। সব দলের মানুষও তাকে শ্রদ্ধার আসনে অলংকৃত করেছিল। তাই তিনি একটি দলের হলেও সব দলের নেতা। তার যে দিকটা বড় ছিল, জাতীয় ঐক্য। দলের প্রধান হিসেবে নয়, দেশের জনগণের নেতা হিসেবে বিভিন্ন দলের নেতারা তাকে মেনেছেন, শ্রদ্ধা করেছেন।
লেখক: রাজনীতিক ও আইন বিশেষজ্ঞ
ইত্তেফাক/কেকে