শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ভূমিপুত্র শেখ মুজিব

আপডেট : ১৭ মার্চ ২০২১, ১৪:১৪

গত ১০ ডিসেম্বর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুকে ভূমিপুত্র আখ্যায়িত করে যা বলেছেন, তার চেয়ে বড় বাস্তবতা আর কিছু হতে পারে না। বঙ্গবন্ধু যে ভূমিপুত্র, তা দুটি প্রেক্ষাপট থেকে বিবেচনায় আসে। প্রথমটি ঐতিহাসিক এবং দ্বিতীয়টি রাজনৈতিক-সামাজিক। উভয় মানদণ্ডেই তিনি ছিলেন ভূমিপুত্র। অনেক ইতিহাস গবেষক পণ্ডিত ব্যক্তি এটা মানেন যে বাংলাদেশ যে অঞ্চলের উপর প্রতিষ্ঠিত সে অঞ্চল, অর্থাত্ বঙ্গভূমি কখনো কোনো বাঙালির শাসনাধীন ছিল না। এই অমোঘ সত্য প্রকাশ করায় সত্য বিশ্বাসী ব্যক্তিদের একনিষ্ঠ প্রশংসা ও সাধুবাদ অর্জন করেছেন প্রধানমন্ত্রী, যিনি সত্যের একনিষ্ঠ সাধক।

নেত্রী যা বলেছেন, ইতিহাস তা প্রমাণ করে। একটি ঐতিহাসিক সত্য হলো এই যে, বঙ্গভূমি ধারাবাহিকভাবে একটানা দিল্লি সাম্রাজ্যের অংশ ছিল না, ব্রিটিশ আমল ছাড়া। ছিল না মৌর্য আমলে, গুপ্ত শাসনে, সুলতানি আমলে। সম্রাট আকবর থেকে আওরঙ্গজেবের শাসনামলে বাংলা দিল্লির মোগল সাম্রাজ্যের অংশ ছিল বটে, কিন্তু বিদ্রোহ লেগেই থাকত।

আলেকজান্ডারের আক্রমণের পূর্বে গোটা ভারত ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত ছিল। বাংলাও ছিল বিভিন্ন জনপদে বিভক্ত। গ্রিক-রোমানরা বঙ্গভূমিকে বলত গঙ্গারিদাই। অনেক সময় বঙ্গভূমি মগধের অধীন ছিল। আলেকজান্ডারের আক্রমণের পর চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের নেতৃত্বে মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা ও সমাপ্তির কিছু পরে গুপ্ত সম্রাটগণ বঙ্গভূমিসহ ভারতের বহুলাংশ শাসন করলেও গুপ্ত বংশের পতনের পর তা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় এবং সে সময় বাংলার গৌড় অঞ্চলের স্বাধীন অধিশ্বর হিসেবে উদিত হন রাজা শশাঙ্ক, ৫৯০ সালে। কিছু ঐতিহাসিকের মতে, শশাঙ্ক বাঙালি বংশোদ্ভূত হলেও বেশির ভাগ ঐতিহাসিক মনে করেন, শশাঙ্ক বাঙালি ছিলেন না। তখন ব্রহ্মী হরফ ছিল (দেব নাগরি তথা বাংলা হরফের পূর্বতন সংস্করণ)। তখনো চর্যাপদ শুরু হয়নি। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ দিলীপ কুমার গাঙ্গুলীর পরিষ্কার দাবি, শশাঙ্ক বাঙালি ছিলেন না। তারপর বাংলার সিংহাসনে বসেন যথাক্রমে পাল, সেন এবং ১৩৫২ সালে তুর্কি বংশীয় বাংলার শাহী শাসকগণ।

১২০০ সালে দিল্লির দাস বংশীয় সুলতান, তুর্কি রক্তের কুতুবউদ্দিন আইবেকের এক সেনানায়ক, ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি বাংলার সর্বশেষ সেনবংশীয় রাজা লক্ষণ সেনকে পরাজিত করে সেন রাজত্বের ইতি ঘটান এবং বঙ্গভূমিতে নিজ রাজত্ব স্থাপন করেন। তার সময় বঙ্গভূমিতে দলে দলে হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মীয় লোকেরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। ১২০৬ সালে আলি মার্দান খিলজি নামক আর এক খিলজি জাতের তুর্কি বখতিয়ার খিলজিকে হত্যা করে। ১৩২৫ সালে দিল্লির তুগলগ বংশীয় সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুগলগ বাংলাকে তিন ভাগে ভাগ করেন। যথা—(১) সোনারগাঁও (২) গৌড় (৩) সাতগাঁও। কিন্তু দিল্লি শাসন বেশি সময় টেকেনি। ১৩৫২ সালে তুর্কি রক্তের শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ গোটা বাংলা একত্রিত করে তার স্বাধীন শাসক হয়ে বাংলায় শাহী রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৩৫৯ সালে দিল্লির তুগলগ বংশীয় সুলতান ফিরোজ শাহ তুগলগ বাংলার শাহীরাজদের দ্বিতীয়জন, শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের পুত্র সিকান্দার শাহর কাছে পরাজিত হয়ে বাংলাকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকার করেন। ১৫২৬ সালে মোগল সম্রাট বাবর আফগান বংশোদ্ভূত সুলতান ইব্রাহিম লোধিকে পরাস্ত করে ভারতে মোগল রাজ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে দিল্লিতে সুলতান রাজ্যের যবনিকাপাত ঘটে। এরপর বাবর বাংলার শাহী বংশের নাসিরুদ্দিন নুসরাত শাহকে পরাজিত করেন। বাংলায় মোগল আধিপত্য প্রসারিত হয় ধীরে ধীরে।

সমসাময়িক গোটা বাংলা ছিল ১২টি আঞ্চলিক সামন্তপ্রধানের সমন্বয়ে একটি কনফেডারেশন। কিছু ঘটনাপ্রবাহের পর তুর্কি-আফসার বংশীয় জনগোষ্ঠীর লোক আলিবর্দী খান মুর্শিদ কুলির উত্তরসূরিকে হত্যা করে নবাব হয়ে স্বাধীনভাবেই রাজ্য চালাচ্ছিলেন। তার মৃত্যুর পর দৌহিদ্র সিরাজউদ্দৌলা নবাব হন। তিনিও অবাঙালি ছিলেন, ছিলেন তুর্কি আফসার গোষ্ঠীর, যার পিতার নাম ছিল মির্জা মোহাম্মদ হাশিম। নবাব সিরাজউদ্দৌলার মাতৃ ও ব্যবহারিক ভাষা ছিল ফার্সি। এরপর তো শুরু হয় ইংরেজ শাসন। ১৯৪৭ সালে ইংরেজ শাসনের অবসানের পর ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পূর্ব বাংলা পূর্ব পাকিস্তান নামে পাকিস্তানের একটি প্রদেশ ছিল বিধায় তা স্বাধীন ছিল না।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন করে বঙ্গবন্ধুই হন বাংলার প্রথম বাঙালি শাসক বা ভূমিপুত্র শাসক। এ কথা সচরাচর যারা বলে থাকেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন ’৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির, সহসভাপতি ইতিহাসের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিকিত্সাবিজ্ঞানী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব চিকিত্সা বিশ্ববিদ্যালয়ের যকৃত বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মামুন মাহতাব স্বপ্নিল, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের প্রাক্তন পরিচালক, বঙ্গবন্ধু গবেষণা পরিষদের প্রধান অধ্যাপক উত্তম কুমার বড়ুয়া প্রমুখ। কিন্তু এখন বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার মুখ দিয়ে কথাটি উচ্চারিত হওয়ায় এটি সর্বোচ্চ পর্যায়ে উল্লেখিত হলো।

বঙ্গবন্ধু সব অর্থেই ছিলেন এদেশের সাধারণ মাটির মানুষের, অর্থাত্ ভূমিসন্তানদের নিকটতম ব্যক্তি। রাজনীতিতে আভিজাত্যবাদ ভেঙে তিনিই প্রথম সাধারণ মানুষের দরজায় রাজনীতি পৌঁছে দিয়েছিলেন। শেরেবাংলা ফজলুল হক এবং মওলানা ভাসানীও রাজনীতিকে সাধারণ মানুষের মধ্যে আনার চেষ্টারত ছিলেন বৈকি, কিন্তু তারা সে উদ্দেশ্যে কোনো বিশাল শক্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। ব্রিটিশরাজের শেষ সময়ে বঙ্গীয় মুসলিম লিগে দুটি ধারা ছিল, একটি রক্ষণশীল, যা নিয়ন্ত্রণ করতেন বণিক, নবাব, জমিদারগণ; অন্যটি ছিল প্রগতিবাদীদের। বঙ্গবন্ধু ছিলেন প্রগতির ধারায়। ১৯৪৭ সালে বঙ্গবন্ধু ও হাশিম সাহেব মিলে একটি খসড়া মেনোফ্যাস্টো তৈরি করেছিলেন পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর তার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো স্থির করার জন্য। ১৯৪৯ সালে বঙ্গবন্ধুই খুলনার কৃষকদের দাওয়াল আন্দোলনের সমর্থনে এগিয়ে গিয়েছিলেন। ভারত বিভাগের পূর্বে তিনি নবাব পরিবারের খাজা নাজিমুদ্দিনের বিরুদ্ধে শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে সমর্থন করেছিলেন। আওয়ামী লীগকে অসাম্প্রদায়িক ও সার্বজনীন রূপ দেওয়ার জন্য দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দ বর্জনের জন্য সাফল্যের সঙ্গে চাপ দিয়েছিলেন।

১৯৪৩ সালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের সৃষ্ট দুর্ভিক্ষের সময় তিনি, তখনকার সময়ে বাংলার বেসামরিক সরবরাহমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে চাপ দিয়েছিলেন অন্যান্য এলাকা থেকে খাদ্য আমদানি এবং জরুরি ভিত্তিতে দ্রুততম সময়ে খাদ্য উত্পাদনের জন্য। তিনি সে সময় উল্কার মতো সমগ্র বঙ্গভূমিতে বিচরণ করেছেন, সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন বুভুক্ষ মানুষের হাহাকার লাঘব করার, বিভিন্ন জায়গায় লঙ্গরখানা খুলে দিন-রাত পরিশ্রম করেছেন ভুখা মানুষের মুখে খাবার তোলার জন্য।

বঙ্গবন্ধুর চাপে সোহরাওয়ার্দী সাহেব রাতারাতি বিরাট সিভিল সাপ্লাই ডিপার্টমেন্ট গড়ে তুললেন, ‘কন্ট্রোল’ দোকান খোলার বন্দোবস্ত করলেন, গ্রামে গ্রামে লঙ্গরখানা করার হুকুম দিলেন। দিল্লিতে গিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে ভয়াবহ অবস্থার কথা জানালেন এবং সাহায্য দিতে বললেন। চাল, আটা ও গম বজরায় করে আনাতে শুরু করলেন। ইংরেজের কথা হলো, বাংলার মানুষ যদি মরে তো মরুক, যুদ্ধের সাহায্য আগে। যুদ্ধের সরঞ্জাম প্রথম স্থান পাবে। ট্রেনে অস্ত্র যাবে, তারপর যদি জায়গা থাকে তবে রিলিফের খাবার যাবে। যুদ্ধ করে ইংরেজ, আর না খেয়ে মরে বাঙালি; যে বঙালির কোনো কিছুরই অভাব ছিল না। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন বাংলাদেশ দখল করে মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতায়, তখন বাংলার এত সম্পদ ছিল যে, একজন মুর্শিদাবাদের ব্যবসায়ী গোটা বিলাত শহর কিনতে পারত।

সেই বাংলাদেশের এই দুরবস্থা চোখে দেখে স্থির থাকতে পারেননি বঙ্গবন্ধু। মা মরে পড়ে আছে, ছোট বাচ্চা সেই মরা মায়ের স্তন চাটছে। কুকুর ও মানুষ একসঙ্গে ডাস্টবিন থেকে কিছু খাওয়ার জন্য কাড়াকাড়ি করছে। বাড়ির দুয়ারে এসে চিত্কার করছে, ‘মা বাঁচাও, কিছু খেতে দাও, মরে তো গেলাম, আর পারি না, একটু ফেন দাও’। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে জানা যায়, তিনি হোস্টেলে যা বাঁচে, দুপুরে ও রাতে বুভুক্ষুদের বসিয়ে ভাগ করে দিতেন। এই সময় শহীদ সাহেব লঙ্গরখানা খোলার হুকুম দিলেন। বঙ্গবন্ধুও লেখাপড়া ছেড়ে দুর্ভিক্ষপীড়িতদের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়লেন। দিনভর কাজ করতেন, আর রাতে কোনো দিন বেকার হোস্টেলে ফিরে আসতেন, কোনো দিন লীগ অফিসের টেবিলে শুয়ে থাকতেন। তার সঙ্গে ছিলেন আরো কয়েক জন সহকর্মী। তিনি সাধারণ মানুষের বাংলা ভাষার দাবিতে সোচ্চার ছিলেন এবং সে কারণে জেলও খেটেছেন। জমিদারপ্রথা বিলুপ্তির জন্য আইন প্রণয়নে তার দাবি ছিল অত্যন্ত সরব, যার ফলশ্রুতিতে জমিদারি উচ্ছেদ এবং প্রজাসত্ব আইন প্রণীত হয়। পঞ্চাশের দশকে তিনি আদমজির শ্রমিকদের আন্দোলনের একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক হয়ে তাদের সঙ্গে মিলে গিয়েছিলেন। ১৯৫৪ সালে পশ্চিম পাকিস্তানিরা ষড়যন্ত্র করে আদমজিতে পাঁচ শতাধিক লোককে হত্যা করলে বঙ্গবন্ধু আহার-নিদ্রা পরিহার করে, নিজের জীবন বাজি রেখে নেমে পড়েছিলেন আদমজির শ্রমিকদের রক্ষায়।

তিনি ১৯৬৯ সালের ঘূর্ণিঝড়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন হতভাগা ভুক্তভোগীদের সহায়তায়, সোচ্চার হয়েছিলেন তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসার দাবিতে। তার সমস্ত জীবনের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু ছিল সাধারণ মানুষ, যে কারণে তিনি পেয়েছিলেন অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা, যা এই উপমহাদেশের অন্য কারো পক্ষে লাভ করা সম্ভব হয়নি। এমনকি ইন্দিরা গান্ধী ৬ নভেম্বর কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বলেছিলেন, শেখ মুজিব তার (ইন্দিরার) চেয়ে অনেক বেশি জনপ্রিয়। তার গণমুখী ও গণহিতৈষী রাজনীতির কারণেই ১৯৭১-এর ৭ মার্চ তার জনসভায় নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এত লোক যোগ দিয়েছিলেন, যা ছিল অতীতের সমস্ত রেকর্ড ভঙ্গকারী। তার সবচেয়ে বড় প্রত্যাশা ছিল দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। আর সেই লক্ষ্য সামনে রেখেই তিনি বাকশাল সৃষ্টি করেছিলেন সংশ্লিষ্ট সমস্ত মানুষকে একত্রিত করে।

বাকশাল করার পেছনে তার ব্যক্তিগত বা দলীয় কোনো ফায়দা ছিল না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি বড় বড় শিল্প রাষ্ট্রীয়করণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, দেশের অর্থনীতিতে উচ্চবিত্তদের একচ্ছত্র আধিপত্য ভেঙে সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য। একই উদ্দেশ্যে তিনি ভূমি মালিকানার সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করেছিলেন এবং সরকারি খাসজমি ভূমিহীনদের ইজারা দেওয়ার নিয়ম প্রচলন করেছিলেন। সাধারণ জেলেরা যাতে মহাজনদের দ্বারা শোষিত হতে না পারে, তার জন্য ‘জাল যার জলা তার’ নীতির প্রবক্তা ছিলেন বঙ্গবন্ধু, যে নীতি অনুযায়ী সরকারি জলমহালের ইজারা জেলেদের দেওয়া হয়।

আজ যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গৃহহীন জনগণকে ঘর তৈরি করে দিচ্ছেন, সেই ইচ্ছা বঙ্গবন্ধু প্রথম ধারণ করেছিলেন। কিন্তু তার হত্যাকারীরা বঙ্গবন্ধুকে তা করতে দেয়নি, যার জন্য সেই দায়িত্ব এসে পড়েছে তার যোগ্য কন্যার ওপর। বঙ্গবন্ধু সব মানুষের মধ্যে গণশিক্ষা প্রচলনের জন্য ড. কুদরত-ই-খোদার নেতৃত্বে শিক্ষা কমিশন গঠন করেই শান্ত হননি, কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করার উদ্যোগও নিয়েছিলেন। তিনি সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূল নীতি হিসেবে যে কথাগুলো সন্নিবিষ্ট করেছেন, তার দ্বিতীয় শীর্ষস্থানেই রয়েছে শোষণমুক্তির কথা। আরো রয়েছে উত্পাদন যন্ত্র, উত্পাদনব্যবস্থা, বণ্টন প্রণালিসমূহের জনগণভিত্তিক মালিকানা। মূলনীতিতে তিনি কৃষক-শ্রমিকের মুক্তির কথা বলেছেন, গ্রামীণ উন্নয়ন ও কৃষি বিপ্লবের কথা বলেছেন, অবৈতনিক বাধ্যতামূলক শিক্ষার কথা বলেছেন, জনস্বাস্থ্যের কথা বলেছেন। দেশে-বিদেশে তার সমস্ত বক্তৃতায় প্রাধান্য পেত কৃষক-শ্রমিকদের কথা।

২৭ জানুয়ারি বিশ্বখ্যাত লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসে এক আলোচনা সভায় বিশ্বনন্দিত নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন বঙ্গবন্ধুকে ‘বিশ্ববন্ধু’ আখ্যায়িত করে বলেছেন, তার অসাম্প্রদায়িক চেতনা থেকে ভারত ও বিশ্বকে অনেক কিছু শেখার আছে। অমর্ত্য সেন আরো বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ অনুসৃত হলে শ্রীলঙ্কায় রক্তপাত, গৃহযুদ্ধ হতো না। তিনি বলেছেন, বঙ্গবন্ধু যে ঐতিহ্যগত মূল্যবোধ ধারণ করতেন, তা বিশ্বকে বদলে দিয়েছে। একই সভায় অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেছেন, বঙ্গবন্ধু রেলগাড়িতে তৃতীয় শ্রেণিতে যাতায়াত করতেন কৃষকদের সাথে, যাদের তিনি বুঝতে পারতেন। অবশ্য ১৯৭৩ সালের মে মাসে বিশ্ব শান্তি পরিষদ বঙ্গবন্ধুকে জোলিও কুরি শান্তি পদক প্রদানকালে তাকে বিশ্ববন্ধু বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। বিশ্বের ১৪০টি দেশের প্রতিনিধিগণ চিলির রাজধানীতে একত্রিত হয়ে বঙ্গবন্ধুকে জোলিও কুরি শান্তি পদক প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। পদকপ্রাপ্তিকালে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘নিপীড়িত, নির্যাতিত, শোষিত স্বাধীনতাকামী সংগ্রামী মানুষ যে কোনো স্থানে হোক না কেন, তাদের সাথে আমি রয়েছি।’

অমর্ত্য সেনের দাবি যে কতখানি যৌক্তিক, তা বোঝা যায় সারা বিশ্বে বঙ্গবন্ধুর চলমান জনপ্রিয়তা নিরীক্ষা করলে। সারা পৃথিবীর কাছে তার পরিচিতি বিশ্বের সব অঞ্চলের নির্যাতিত মানুষের মুখপাত্র হিসেবে। ইতিহাসে তিনি সেই পরিচয় নিয়েই চিরকাল বেঁচে থাকবেন, যার প্রমাণ ৪৫ বছর পরেও অমর্ত্য সেনের মতো একজন বিশিষ্ট নোবেল বিজয়ীর মুখে বঙ্গবন্ধুর অকৃত্রিম প্রশংসা। বঙ্গবন্ধু যেভাবে মাটির মানুষের সঙ্গে মিলে গিয়েছিলেন, তাদের স্বার্থ রক্ষায় নিজের জীবন উত্সর্গ করেছিলেন, তার নজির কখনো ছিল না। তাই তো ভূমিপুত্র কথাটি বঙ্গবন্ধুর বেলায়ই প্রযোজ্য, শুধু ঐতিহাসিক অর্থেই নয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, দার্শনিক, তাত্ত্বিক এবং সামাজিক অর্থেও।

লেখক: আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি

ইত্তেফাক/জেডএইচডি