বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

বাকশাল: স্বদেশ নির্মাণ ও জনকল্যাণমুখী সমাজ গঠনের পরিকল্পিত পদক্ষেপ

আপডেট : ১৫ অক্টোবর ২০২১, ০৭:০০

বাকশাল, যার পরিপূর্ণ রূপটি হলো 'বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ'। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি, জাতীয় সংসদে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী পাস হয়; ফলে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা থেকে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা চালু হয়। সংবিধানের নতুন এই সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির আদেশবলে একটি জাতীয় রাজনৈতিক দল গঠন করার সাংবিধানিক বিধান কার্যকর করা হয়। সংবিধানের এই ধারা মোতাবেক, ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৫ তারিখে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মোজাফফর) এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) একত্রিত হয়ে সর্বপ্রথম বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) গঠন করে। পরে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, সংসদ সদস্য, বিভিন্ন বাহিনীতে কর্মরত কর্মকর্তা ও কর্মচারী, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তিবর্গ, ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, সাংবাদিক, কৃষক-শ্রমিক কর্মচারীসহ অসংখ্য মানুষ বাকশালে যোগদানের আবেদন করেছিলেন। ১৯৭৫ সালের ৭ জুন এর গঠনতন্ত্র ও সাংগঠনিক কাঠামো ঘোষিত হয়। বাকশালের কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে এই সময় থেকে শুরু হলেও ১৫ই আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের কারণে এর অবসান ঘটে।

প্রথাগত রাজনৈতিক দলের চরিত্র থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সাধনের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাকশাল গঠন করেছিলেন। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংসদে তার ভাষণ, ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভাষণ, ১৯ জুন তারিখে অনুষ্ঠিত বাকশাল কেন্দ্রীয় কমিটিতে দেওয়া ভাষণ, নবনিযুক্ত ৬১ জন গভর্নরের প্রশিক্ষণ উদ্বোধনকালে প্রদত্ত ভাষণ, ৩ পার্বত্য জেলার বিভক্তি উপলক্ষে ১২ই ফেব্রুয়ারি এবং ৮ মার্চ তারিখে টাঙ্গাইল মওলানা মোহাম্মদ আলী সরকারি কলেজ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রদত্ত ভাষণ এবং ২৫ জানুয়ারি থেকে ১৪ই আগস্ট পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর গৃহীত বিভিন্ন সিদ্ধান্ত থেকে নতুন এই রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের একটি ধারণা স্পষ্ট হয়।

মূলত, শোষণহীন ও উন্নত আর্থ-সামাজিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে, জনগণের কল্যাণ ও অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করতে, বঙ্গবন্ধু সাংবিধানিক ধারার পরিবর্তন সাধনের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, শিক্ষা-সাংস্কৃতিক এবং জীবনবোধের পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনের নয়া ব্যবস্থা গঠনের লক্ষ্যে বাকশাল গঠন করেন। প্রতিষ্ঠাকালে দেশে জনগণের মধ্যে নতুন এই জাতীয় দলের প্রতি ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিল, লোকজন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের শুরু করা দ্বিতীয় বিপ্লব কর্মসূচির প্রতিও আস্থা স্থাপন করেছিল। এই লক্ষ্যগুলো অর্জনের জন্য পর্যাপ্ত সময়ের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশ রাষ্ট্রকাঠামোর গুণগত পরিবর্তনে স্থায়ী প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।

মূলে ফেরা: মুজিববাদ ও ১৯৭২-এর সংবিধান

১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের পর থেকে স্বাধীনতাবিরোধী, উগ্রডান, অতিবাম, হঠকারী এবং কট্টর-বিপ্লবী মতাদর্শে বিভক্ত বিভিন্ন গ্রুপের রাজনৈতিক সমালোচনা প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়ায় বাকশাল। এটিকে তারা গণতন্ত্র হত্যা বা এক দলীয় স্বৈরতন্ত্র আখ্যায়িত করে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভীতি এবং বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। তবে সেই সময়কার পরিস্থিতিতে, চার মৌলিক নীতির আদর্শে, একটি উন্নত আধুনিক বাংলাদেশ রাষ্ট্রগঠনের যে যাত্রা শুরু করেছিলেন বঙ্গবন্ধু; সেটিরই দ্বিতীয় পর্যায় হিসেবে বাকশাল কর্মসূচি ছিল একটি বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত।

স্বাধীনতার পর দেশ পুনর্গঠনের উদ্যোগ

বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের বিভিন্ন পর্যায়ে জেলে থাকা অবস্থায় ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রকাঠামো সম্পর্কে অনেক ধরনের ভাবনা-চিন্তা করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে ফিরে এসে সরকারের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন তিনি। শুরু হয় তার রাষ্ট্র গঠনের প্রথম পর্ব। এই পর্বে তিনি চার জাতীয় নীতির ভিত্তিতে সংবিধান প্রণয়ন, সংসদীয় গণতন্ত্র প্রবর্তন, নতুনভাবে প্রশাসনিক কাঠামো সৃষ্টি, মন্ত্রণালয় বিভাগ, বিচার বিভাগ, আইন বিভাগসহ অবকাঠামোগত প্রয়োজনীয় সকল দফতর প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের যাত্রা শুরু করলেন। জনগণের অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থানের নিশ্চয়তা বিধানের রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্য স্থির করে অগ্রসর হতে থাকলেন।

যুদ্ধ বিদ্ধস্ত দেশে এক কোটি মানুষের পুনর্বাসন, পাকিস্তান থেকে চার লাখ মানুষকে ফিরিয়ে আনা ও তাদের কর্মসংসস্থানের ব্যবস্থা করা, বাংলাদেশের নতুন মুদ্রা প্রবর্তন, অর্থনৈতিক পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়ন, শিক্ষানীতি প্রণয়ন ইত্যাদির মাধ্যমে একটি আত্মমর্যাদাশীল জাতির স্বাধীন রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার পদক্ষেপ নেন বঙ্গবন্ধু। ভারতীয় মিত্র বাহিনীকে তিন মাসের মধ্যেই চলে যাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। বিভিন্ন দেশের স্বীকৃতি, সাহায্য, সমর্থন আদায় করতে থাকলেন। তবে যুদ্ধবিদ্ধস্ত অর্থনীতি পুনর্গঠন ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি তখন ছিল অনেকটাই বৈরী এবং প্রতিকূলে। ১৯৭৩ সালে তেলের মূল্যবৃদ্ধি, ১৯৭৩-১৯৭৪ সালে পর পর দুটি বন্যা বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্র পুনর্গঠনের অভিযাত্রায় বড়ো ধরনের আঘাত দেয়।

কিন্তু এর চাইতেও বড় সংকট ছিল স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। তখন আওয়ামী লীগ, ন্যাপ (মোজাফফর) এবং সিপিবি ছাড়া অন্য কোনো রাজনৈতিক দলই রাষ্ট্র পুনর্গঠনে নিয়মতান্ত্রিক ধারার রাজনীতি চর্চা করেনি। স্বাধীনতা বিরোধীদের অনেকেই আত্মগোপন করলেও তাদের একটি অংশ উগ্র-বিপ্লববাদী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মিশে যায়। এছাড়া বেশ কিছু পথভ্রষ্ট বিপ্লববাদী রাজনৈতিক দল সরকার উৎখাতে গোপনে থানা-পুলিশ ফাঁড়ি লুট করা, পাটের গুদামে আগুন দেওয়া, রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের হত্যা করাসহ চরমপন্থায় দেশে একটি অরাজক অবস্থা তৈরি করতে থাকে।

সেই অবস্থায় বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানে চতুর্থ সংশোধনী আনার মাধ্যমে সংসদীয় পদ্ধতি থেকে রাষ্ট্রপতি শাসিত পদ্ধতির প্রবর্তন করেন। এই মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম সরাসরি রাষ্ট্র ও জনগণের সেবার সঙ্গে যুক্ত করা উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই সঙ্গে প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণরূপে বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে নবগঠিত জেলা পরিষদ, থানা পরিষদ,ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়। দেশে কৃষি উৎপাদন কয়েকগুণ বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে কৃষি সমবায়, উৎপাদিত পণ্যসামগ্রীর সরবরাহ নিশ্চিত করনে বহুমুখী সমবায় ব্যবস্থা, কলকারখানায় উৎপাদন ব্যবস্থা, পরিবার পরিকল্পনা, ঘুষ-দুর্নীতিমুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ব্যপক পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন বঙ্গবন্ধু। এর মাধ্যমে তিনি রাষ্ট্রব্যবস্থায় যে পরিবর্তন আনতে চাচ্ছিলেন, সেটিকে তিনি শোষিতের গণতন্ত্র এবং দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। এই ব্যবস্থাটি দুনিয়ার অন্যান্য দেশের সমাজতান্ত্রিক বা পুঁজিবাদী কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে হুবহু মেলানোর উপায় ছিল না। বরং বাংলাদেশের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক, শিক্ষা-সাংস্কৃতিক, জনগণের মনোজাগতিক বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তিনি একটি জনকল্যাণবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার কর্মসূচি উপস্থিত করেছিলেন। দ্বিতীয় বিপ্লব নিয়ে বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রচিন্তার গভীরে প্রবেশ না করে, দেশবিরোধী চক্র ও বিরোধী পক্ষ সবসময়ই এটি নিয়ে যেভাবে উগ্রভাবে আক্রমণ করে এসেছে  তা আসলে তাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা ছাড়া আর কিছুই নয়।

বঙ্গবন্ধু কেনো সামগ্রিক পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন  

স্বাধীনতার পর তিন বছর রাষ্ট্র পরিচালনার অভিজ্ঞতা থেকে বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারলেন যে, বাংলাদেশ দ্রুত উন্নতি লাভের ক্ষেত্রে জটিল সমস্যায় আক্রান্ত। এর একটি হচ্ছে মান্ধাতা আমলের কৃষি ব্যবস্থা, কৃষিজ পণ্য উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থায় নানা জটিলতা। অন্যটি হচ্ছে শিল্পের পশ্চাৎপদতা এবং অব্যবস্থাপনাজনিত কারণে সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও দেশের শিল্পখাত পিছিয়ে আছে। কিন্তু কৃষিখাতে যে উর্বর জমি বাংলাদেশে রয়েছে, তাতে আমূল পরিবর্তন সাধন করা গেলে কৃষিজ পণ্যের উৎপাদন কয়েকগুণ বৃদ্ধি করা সম্ভব, একইভাবে শিল্প খাতেও। বাংলাদেশকে তখন প্রতি বছর ২০-৩০ লক্ষ টন খাদ্যশস্য বিদেশ থেকে আমদানি করতে হতো। তাই অভ্যন্তরীণ খাদ্য সংকট মোকাবিলায় কৃষিব্যবস্থায় আমূল সংস্কার সাধন জরুরি।

বিশেষ করে ১৯৭৪ এর দুর্ভিক্ষ ভীষণভাবে পীড়িত করেছিল বঙ্গবন্ধুকে। পরপর ২ বছরের বন্যায় খাদ্যের সংকট তীব্রতর হয়েছিল, যা পূরণ করা সরকারের পক্ষে সম্ভব হয়নি। কৃষি ও শিল্প খাতের এই পরিবর্তন সাধনের জন্য প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল বড় ধরনের সংস্কার। সেটি বাস্তবায়ন করার জন্য ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, ঘুষ-দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা এবং আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের মনোজাগতিক-প্রশাসনিক সমস্যা তিনি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। ৩ বছর তিনি সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও প্রশাসনিক কাঠামো দাঁড় করিয়েও সামগ্রিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীভূত প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে বিকেন্দ্রীকরণ করার প্রয়োজনীয়তা গভীরভাবে অনুভব করলেন। তাই তিনি রাজনৈতিক দল, অরাজনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মরত যেকোনো নাগরিক, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক, শিক্ষা-সাংস্কৃতিক বিকাশে অবদান রাখার সুযোগ সম্বলিত একটি জাতীয় দলীয় ঐক্য গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন।

১৯৭৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের প্রাক্কালে জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া বেতার ও টেলিভিশনে প্রদত্ত ভাষণে দেশে বড়ো ধরনের পরিবর্তনের প্রয়োজনের কথা নিঃসংকোচে উল্লেখ করেন বঙ্গবন্ধু। তিনি বলেন, ''আমি জানি, নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় প্রতিটি জিনিসের অসম্ভব মূল্যবৃদ্ধিতে আপনারা কী নিদারুণ কষ্ট পাচ্ছেন। বিশেষ করে সীমাবদ্ধ আয়ের লোকদের দুঃখ-কষ্টে আমি অত্যন্ত ব্যথিত। আমাদের ঐকান্তিক চেষ্টা সত্ত্বেও কয়েক হাজার লোককে আমরা অনাহারের কবল থেকে বাঁচাতে পারিনি-এ সত্য স্বীকার করতে আমার কোনো লজ্জা নেই। কারণ আমি জানি, সীমিত সম্পদ সত্ত্বেও একমাত্র আমরাই এসব হতভাগা মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। সামান্য যা কিছু পেয়েছি, তা নিয়ে এ দেশের সেবায় এগিয়ে গিয়েছি। খাদ্য উৎপাদন বাড়িয়ে অনাহারে মৃত্যুর পুনরাবৃত্তি রোধ করার সুকঠিন চ্যালেঞ্জ আমাদের গ্রহণ করতে হবে।''

রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন

১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধ বিদ্ধস্ত বাংলাদেশ রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে শুরু করেন। নতুন সংবিধান অনুযায়ী চার জাতীয় মূল নীতি তথা গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং জাতীয়তাবাদের আদর্শে রাষ্ট্র, সমাজ ও অর্থনীতি গড়ে তোলার জন্য সংসদীয় পদ্ধতি প্রবর্তন করেছিলেন। সংবিধান গ্রহণের সময় তিনি তখন সংসদকে অবহিত করেছিলেন যে জনগণের কল্যাণে তিনি এই সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনতে উদ্যোগ নেবেন। তিন বছর সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থার বেশ কিছু সাফল্য থাকলেও; রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অস্ত্রের ঝনঝনানি, থানায় লুটপাট, পুলিশ ফাঁড়ি ও কলকারখানা গুদামে অগ্নিসংযোগ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি আক্রমণ ছাড়াও দেশে উগ্রপন্থীদের অপতৎপরতায় হত্যা-খুন, গোপন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বেড়ে যায়, এছাড়া ঘুষ দুর্নীতিও রোধ করা সম্ভব হয়নি। ফলে দেশে কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক স্থিতিশীলতা, রাজনৈতিক বিকাশ ঘটানো সম্ভব হচ্ছে না। এই অবস্থায় তিনি ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫ সালে সংবিধানে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশ পরিচালনায় রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রচলিত কৃষি, শিল্প, প্রশাসন, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং মানুষের মধ্যে জাতীয় ঐক্য গঠনের একটি নতুন ব্যবস্থা চালু করার উদ্যোগ নেন।

সংসদে মাত্র দুজন সদস্য ছাড়া বাকি সকলেই বঙ্গবন্ধুর উত্থাপিত সংশোধনীর বিল সমর্থন প্রদান করেন। সংসদে তিনি শোষণহীন সমাজ গঠন, বৈষম্য দূরীকরণ এবং জাতীয় ঐক্য গঠনের যে বিস্তারিত বিবরণ প্রদান করেন, সেটিকে দ্বিতীয় বিপ্লব বলে আখ্যায়িত করেন। বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বলেছিলেন, ''আমরা শোষিতের গণতন্ত্র চাই। যারা রাতের অন্ধকারে পয়সা লুট করে, যারা বড় অর্থশালী লোক, যারা বিদেশিদের পয়সা ভোট কেনার জন্য দেয়, তাদের গণতন্ত্র নয়-শোষিতের গণতন্ত্র চাই।'' এই ভাষণে তিনি সংসদ ও সরকার ব্যবস্থায় জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচন ব্যবস্থার পাশাপাশি জবাবদিহি করারও নিশ্চয়তা প্রদান করেন। ওইদিনই তিনি সংসদ ভবনে রাষ্ট্রপতি পদে শপথ গ্রহণ করেন।

২৬ জানুয়ারি ১৯৭৫, ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে প্রধানমন্ত্রী করে ১৭ সদস্যের একটি মন্ত্রী পরিষদ গঠন করেন বঙ্গবন্ধু। ২৭ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুর সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামকে পৃথক তিনটি জেলায় রূপান্তরিত করার ঘোষণা দেয়।

শেখ মুজিব মানেই বাংলাদেশ

এই উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১২ ফেব্রুয়ারি নবঘোষিত তিন পার্বত্য জেলার নৃ-জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধি এবং সাধারণ মানুষের উদ্দেশ্যে রাঙামাটিতে আয়োজিত জনসভায় বক্তৃতা করেন। সেখানে তিনি প্রতিটি নৃজাতিগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক,জাতিগত উন্নয়ন, শিক্ষা-সাংস্কৃতিক, সমান অধিকার বাস্তবায়নে তার সরকারের দৃঢ় অঙ্গীকারের কথা ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, ''স্থানীয় জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্যে কৃষি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সুযোগ সুবিধা দেওয়া হবে এবং উপজাতীয় এলাকাগুলোতে আদর্শ গ্রাম গড়ে তোলা হবে। আদর্শ গ্রামগুলোতে বসবাস ও আবাদের জন্য বিনামূল্যে জমি দেওয়া হবে। শিক্ষা ও চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে।''

রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুর সরকার ৩ এপ্রিল ১৯৭৫ তারিখে দেশের সকল গুপ্তহত্যাকারী ও সন্ত্রাসীদের ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ জারি করেন। এই সময়ে বেশ কিছু দুর্বৃত্ত গ্রেফতার হয়। দেশের কালোবাজারিদের হাতে সঞ্চিত অবৈধ অর্থ অকার্যকর করার উদ্দেশ্যে ৬ এপ্রিল ১০০ টাকার নোট বাতিল ঘোষণা করা হয়। ৮ এপ্রিল অচল টাকা জমাদানে কারচুপির অভিযোগে ৪ জন ব্যাংক ম্যানেজারসহ ১৬ জন ব্যক্তিকে সাময়িকভাবে চাকরি থেকে অপসারণ করা হয়। বিগত বছর গুলোতে দুর্বৃত্তরা পাটের গুদাম ও বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় রাতের আঁধারে অগ্নিসংযোগ করে জনগণের সম্পদ ধ্বংস করার যেসব নজির স্থাপন করেছিলো। তার পুনরাবৃত্তি করে ১৪ এপ্রিল তারিখে তারা ক্রিসেন্ট জুটমিলে নাশকতা ঘটায়। এখানেও বিপুল সম্পদ পুড়ে যায়।

বঙ্গবন্ধুর সরকার ১৯৭৫ সালের ১৬ এপ্রিল বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশন গঠনের একটি অধ্যাদেশ জারি করেন। সেদিনই ঢাকায় ফারাক্কা বাঁধ ইস্যুতে বাংলাদেশ-ভারত মন্ত্রী পর্যায়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় এবং ১৮ এপ্রিল ভারতের গঙ্গা নদীতে ফারাক্কা বাঁধ চালু করার ব্যাপারে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে একটি অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির শর্তানুসারে শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গা নদীর ৫৫ হাজার কিউসেক পানির মধ্যে ৪৪ হাজার কিউসেক পানি বাংলাদেশের জন্য সুনিশ্চিত করে ভারতকে মাত্র ১১ হাজার কিউসেক পানি ফারাক্কা বাঁধ হতে প্রত্যাহার করার অনুমতি প্রদান করা হয়।

২৫ এপ্রিল ১৯৭৫, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক জাতীয় শিক্ষা কাউন্সিল গঠন করে। ১১ মে বঙ্গবন্ধুর সরকার দেশে আড়াই হাজার নলকূপ বিদ্যুতায়নের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। বাংলাদেশ ও গণচীনের মধ্যে সরাসরি বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় ১৯ মে। যদিও তখনো চীন বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান করেনি। ৩ জুন ১৯৭৫, বঙ্গবন্ধুর সরকার আন্তর্জাতিক রুটে চালানোর জন্য বেসরকারি সংস্থা গুলোকে বিদেশি জাহাজ ভাড়া করার অনুমতি প্রদান করে।

অমর অবিনশ্বর বঙ্গবন্ধু

গণতন্ত্রকে বিকেন্দ্রীকরণের জন্য প্রশাসনিক কাঠামো হিসেবে দেশের ৬১টি মহকুমাকে জেলায় রূপান্তরিত করার একটি ঘোষণা ২২ জুন ১৯৭৫ তারিখে প্রদান করে। বঙ্গবন্ধু সরকার ২৮ জুন তারিখে একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাংলাদেশ টেলিগ্রাম ও টেলিফোন বোর্ড গঠন করে। পূর্বে ঘোষিত জেলাসমূহে ১৬ জুলাই তারিখে রাষ্ট্রপতির আদেশে ৬১ জন গভর্নর নিয়োগ করে তাদের নাম প্রকাশ করা হয়। এতে সংসদ সদস্য, রাজনীতিবিদ, উচ্চপদস্থ আমলাসহ বিভিন্ন পেশার ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সরকার গঠিত হওয়ার পর, ১৯৭৫ সালের ৫ মার্চ, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা আইডিএ বাংলাদেশে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি বাস্তবায়নে ১২ কোটি টাকা, আশুগঞ্জ সার কারখানা প্রকল্প খাতে ২৪ কোটি টাকা এবং ১২ই মার্চ তারিখে আরো কিছু উন্নয়ন প্রকল্পে আড়াই কোটি ডলার ঋণ প্রদান করে। বাংলাদেশ ও জাপানের সঙ্গে ২৮ মার্চ তারিখে ৩০ কোটি টাকার পণ্য বিনিময় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২৯ মার্চ, বিশ্ব খাদ্য সংস্থা বাংলাদেশের জন্য সাড়ে ১৫ লাখ মণ খাদ্য শস্য মঞ্জুর করে। সংযুক্ত আরব আমিরাত বাংলাদেশের জয়দেবপুরে নির্মাণাধীন মেশিন টুলস কারখানার নির্মাণে ৩ মে তারিখে বাংলাদেশ সরকারকে এক কোটি ডলার প্রদানের প্রস্তাব জানায়। বিশ্ব ব্যাংক ৫ জুন তারিখে বাংলাদেশকে ১৫ কোটি ডলার ঋণ প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ব্যাংকটি ৬ জুন তারিখে কনসোর্টিয়ামভুক্ত দেশগুলোকে বাংলাদেশকে ১২০ কোটি ডলারের সাহায্য ঋণ প্রদানের আবেদন জানায়। মিশর সুয়েজ খালের তীরে বাংলাদেশকে একটি ভূখণ্ড দান করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ২১ জুন তারিখে। বৃটেন এবং বেলজিয়াম ২৫ জুন তারিখে বাংলাদেশের জন্য পণ্য ও ঋণ সাহায্য মঞ্জুর করে। এর ফলে বাংলাদেশ পশ্চিমা দেশগুলোসহ চীন, জাপান, প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধি, আর্থিক সহায়তা লাভ এবং দ্বিপাক্ষিক সমস্যার সমাধানের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা নতুন ভাবে শুরু করার সুযোগ পায়।

বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) এর যাত্রা

১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গঠনের লক্ষ্যে একটি জাতীয় দল গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করায় সংবিধান অনুযায়ী অন্যসব রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত হয়ে যায়। ২৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মোজাফফর) এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) মিলিতভাবে বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) গঠন করে। এখান থেকেই বাকশালের যাত্রা শুরু হয়। বাকশালের ৫টি অংগ সংগঠন রাখা হয়। এগুলো হচ্ছে: ১. জাতীয় কৃষক লীগ, ২. জাতীয় শ্রমিক লীগ, ৩. জাতীয় যুবলীগ, ৪. জাতীয় মহিলা লীগ এবং ৫. জাতীয় ছাত্রলীগ। ৭ জুন তারিখে বাকশাল এবং এর অঙ্গসংগঠনগুলোর কেন্দ্রীয় কমিটির নাম ঘোষিত হয়। ৭ জুন তারিখে বাকশালের ১১৫ সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয়। বাকশালের সভাপতি হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং সাধারণ সম্পাদক হন প্রধানমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব) এম মনসুর আলী। জাতীয় কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান ফণিভূষণ মজুমদার, জাতীয় শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান অধ্যাপক ইউসুফ আলী, জাতীয় যুবলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান জনাব তোফায়েল আহমেদ, জাতীয় মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান সাজেদা চৌধুরী এবং জাতীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান শেখ শহিদুল ইসলাম।

১৯৭৫ সালের ২১ জুলাই বঙ্গবন্ধু গণভবনে নতুনভাবে প্রবর্তিত ৬১টি জেলার গভর্নরদের এক প্রশিক্ষণ কর্মশালার উদ্বোধন অনিষ্ঠানে ভাষণ প্রদান করেন। ভাষণে বঙ্গবন্ধু জেলা গভর্নরদের বহুমুখী দায়-দায়িত্ব পালনের বিষয়ে অবহিত করেন। তিনি গভর্নরদের এক বছরের মধ্যে প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে থানা ও গ্রাম পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা দেন। নতুন এই প্রবর্তিত ব্যবস্থাকে পরীক্ষামূলক বলেও অভিহিত করেন বঙ্গবন্ধু। এই ব্যবস্থায় সবাইকে দুর্নীতির ঊর্ধ্বে উঠে জনগণের কল্যাণে কাজ করার আহ্বান জানান।

ফিদেল ক্যাস্ত্রো, বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান | জাতীয় | The  Daily Ittefaq

বাকশাল প্রবর্তিত হওয়ার পর শুধু আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, বা সিপিবি এর নেতৃবৃন্দই নয়; অন্যান্য রাজনৈতিক দল এবং প্রবীণ সংসদ সদস্যগণও বাকশালে যোগদান করেন।

জাতীয় সংসদের প্রবীণ নেতা ও বাংলার সাবেক মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান, আব্দুস সাত্তার, খোয়াই বেয়োজর এবং সৈয়দ কামরুল ইসলাম মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন বাকশালে যোগদান করেন। ৮ জুলাই তারিখে মাদ্রাসা শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মওলানা খোন্দকার নাসির উদ্দিন বিভিন্ন জেলার ৫৫ জন নেতাসহ ৪৯০৫১ জন মাদ্রাসা শিক্ষকের বাকশালে যোগদানের আবেদনপত্র বাকশাল কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক এম মনসুর আলীর হাতে হস্তান্তর করেন। বাকশালে যোগ দেওয়া উল্লেখযোগ্য পেশা ও প্রতিষ্ঠানসমূহ হচ্ছে- ঢাকা বারের আইনজীবী, বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংকের কর্মকর্তা, বাংলাদেশ বিমানবন্দর উন্নয়ন সংস্থা, বাংলাদেশ গৃহনির্মাণ সংস্থা, ন্যাপ (ভাসানী) এর ৪৫০ জন নেতাকর্মী, বাংলাদেশ দমকল বাহিনী, আনন্দবাজার বণিক সমিতি, বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথ সমিতি, বিভিন্ন সংবাদ পত্রের সাংবাদিক নেতৃবৃন্দসহ অনেকেই বাকশালে যোগদানের আবেদনপত্র জমা দেন।

এছাড়াও বিভিন্ন সংবাদপত্রের সঙ্গে জড়িত সাংবাদিক-কর্মচারীদের নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত ৪টি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত করা এবং তাদের চাকরি ও বেতন সরকারি কোষাগার থেকে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছিল। সংবাদপত্র তথা গণমাধ্যমকে নতুন ব্যবস্থার সঙ্গে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পনার মধ্যে ছিল।

দৈনিক ইত্তেফাক | The Daily Ittefaq

শেষ কথা

১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসের পর থেকে আগস্ট পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক, ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় যেসব পরিবর্তন সাধনের প্রস্তুতি গ্রহণ করছিলেন; তা সব মহলেই আগ্রহের সৃষ্টি করছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে উঠছিল, তা তারা মেনে নিতে পারছিল না স্বাধীনতার পর থেকে আন্তর্জাতিক এবং দেশীয় একটি গোষ্ঠী। যুদ্ধ বিধ্বস্ত নতুন দেশ হওয়ায় এর সমস্যা ছিলো বহুমুখী। অনেক দেশের বিশেষজ্ঞদের ধারণা ছিল, বাংলাদেশ কঠিন এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে দাঁড়াতে পারবে না। কিন্তু বঙ্গবন্ধু দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রে অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো যেভাবে দাঁড় করিয়ে ফেলেছিলেন, সেটি অনেকের কাছেই বিস্ময়কর ছিল। বাংলাদেশ একটি আধুনিক অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রচরিত্র নিয়ে বিশ্বের মানচিত্রে পরিচিত হয়ে উঠছিল।

কিন্তু ষড়যন্ত্রকারী মহল বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের এই অদম্য পথচলাকে থামিয়ে দিতে, ১৫ আগস্ট ইতিহাসের বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড সংগঠিত করার মাধ্যমে ক্ষমতার রদবদল ঘটায়।এর ফলে বাংলাদেশ শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হারায়নি, একটি শোষণহীন সমাজব্যবস্থা তৈরির মাধ্যমে আধুনিক বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সুযোগও হাতছাড়া হয়ে যায়।

ইত্তেফাক/জেডএইচডি