বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

১৯৭১: নারীর ইতিহাস কেন বাদ পড়ে যায়

আপডেট : ১৬ ডিসেম্বর ২০১৯, ১৭:৫৫

বাংলাদেশের ইতিহাস চর্চা থেকে নারী অনেকটা বাদ পড়ে আছে। এটি বিশেষ করে লক্ষ করা যায় ১৯৭১-এর ইতিহাসের ক্ষেত্রে। এর একটি কারণ হতে পারে যে, নারী সমাজের অংশ ঠিকই, কিন্তু ইতিহাসের স্বীকৃতি সমাজের দিকে যায়নি, গেছে ক্ষমতাবান গোষ্ঠীর দিকে। যেহেতু নারী ক্ষমতার বলয়ের অংশ নয়, বিশেষ করে ৭১-এর ইতিহাসে, তাই তার ভূমিকা বাদ পড়ে যায়।

বাংলাদেশের ইতিহাসচর্চা থেকে নারী অনেকটা বাদ পড়ে আছে। এটি বিশেষ করে লক্ষ করা যায় ১৯৭১-এর ইতিহাসের ক্ষেত্রে। এর একটি কারণ হতে পারে যে, নারী সমাজের অংশ ঠিকই, কিন্তু ইতিহাসের স্বীকৃতি সমাজের দিকে যায়নি, গেছে ক্ষমতাবান গোষ্ঠীর দিকে। যেহেতু নারী ক্ষমতার বলয়ের অংশ নয়, বিশেষ করে ৭১-এর ইতিহাসে, তাই তার ভূমিকা বাদ পড়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে গবেষণা করতে গিয়ে আমাদের মনে হয়েছে, যেভাবে আমরা ক্ষমতাকে দেখি বা উপভোগ করি, সমাজকে স্বীকৃতি দিই তার মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে নারীর ভূমিকা বাদ পড়ে যাওয়ার আসল কারণ।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসচর্চায় যাদের কথা উঠে আসে—তারা হচ্ছে রাজনীতিবিদ, সৈনিক এবং বিভিন্ন শ্রেণির আমলা। অর্থাত্ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের একধরনের সরকারিকরণ ঘটেছে। যার মাধ্যমে এই গোষ্ঠীসমূহের বয়ানের ওপর ভিত্তি করে ইতিহাসচর্চা হচ্ছে। সরকার ও সমাজের এই ব্যবধান ইতিহাসচর্চার  ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছে।

এই ব্যবধান রক্ষা করার সচেতন ও অবচেতন দুই চেষ্টাই রয়েছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, যদি সীমাবদ্ধ পরিসরে স্বীকৃতির বিষয়টি থাকে তাহলে প্রাপ্তির বিষয়টিও অনেক সহজে ফয়সালা হয়ে যায়। স্বীকৃতি মানেই অধিকার এবং দাবি। আর নারীর ভূমিকা স্বীকৃতি দেয়া মানে হলো সমাজের স্বীকৃতি দেয়া। অতএব, যুদ্ধপরবর্তী চাওয়া-পাওয়ার হিসাবে এত অংশীদার হয়ে যেতে পারে যে সবাইকে ভাগ দিতে গেলে তাদের পাতে বেশি কিছু পড়বে না। এই সুবিধার পরিসরকে রক্ষা করার ন্যূনতম পথ হচ্ছে স্বীকৃতির পরিসরকে ছোট করে রাখা। সব স্বীকৃতির ক্ষমতা সরকারের হাতে। তাই সব সুবিধা প্রদানের সুযোগ তাদের হাতেই। এ কারণেই সমাজের স্বীকৃতিদানের প্রক্রিয়া ও ব্যবস্থা করার ব্যাপারে কারো আগ্রহ নেই। যতদূর সম্ভব সচেতনভাবে নিয়মকানুনের মাধ্যমে যদি ভূমিকা এবং স্বীকৃতির তালিকাকে ছোট রাখা যায় সেটা সুবিধাভোগীদের জন্যই সুফল বয়ে আনবে।

ইতিহাসে তাই সুবিধাবঞ্চিতদের কথা খুব একটা বলা হয়নি। আমাদের মূলধারার ইতিহাসচর্চা পূর্বোল্লেখিত কারণে সরকারি স্বীকৃতিপ্রাপ্তদের ইতিহাসে পরিণত হয়েছে। এই কারণেই মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেটের এত দাম এবং এটা নিয়ে এত রাজনীতি হয়। যেহেতু মুক্তিযোদ্ধারা দাবি করতে পারে স্বাধীনতা কেবল তারাই এনেছে, তাই সশস্ত্র হওয়াটা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মুক্তিযুদ্ধ বলতে কী বোঝায় সেটা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাবে। কারণ অস্ত্রের ভূমিকা কী আর নিরস্ত্র মানুষের ভূমিকা কী—তার সমঝোতা এখনো হয়নি ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে। এর ফলে মুক্তিযোদ্ধা বলতে, কেবল সশস্ত্র ব্যক্তিদের বুঝিয়েছে। সহজ সমীকরণে মুক্তিযুদ্ধ মানেই মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযোদ্ধা মানেই ক্ষমতা। এই সমীকরণে সমাজের কোনো ভূমিকা নেই। থাকলেও তা গৌণ। এই গৌণ ভূমিকার পরিসরে নারীর ভূমিকা আরো গৌণ হয়ে পড়েছে। তার ইতিহাস নিয়ে চর্চা করা বা তথ্য সন্ধান করার কোনো আগ্রহ সাধারণ মানুষ এবং ইতিহাস গবেষকদের মধ্যে নেই। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিসংগ্রাম এবং স্বাধীনতা যুদ্ধ যে একই কথা, তাও মানুষ ভাবতে পারছে না।

আমরা যখন ’৭১ সালের ত্যাগের কথা বলি, তখন সাধারণ মানুষের ত্যাগের বিষয়টি তেমন একটা আলোচনা হয় না বললেই চলে। এই ত্যাগের পরিসরকে ছোট করে ফেলা সহজ হয় যদি ‘ত্যাগ করার যোগ্যতা’ বিশেষ একটি বা দুটি অংশের হয়। তাই দেখা যায়, যে নারী নয় মাস ধরে সব বিপদ মাথায় রেখে পুরো সময় সবাইকে সাহায্য করেছে, সংসার বাঁচিয়েছে, সমাজ বাঁচিয়েছে, এক কথায় এমন একটি পরিসর সৃষ্টি করতে পেরেছে যাতে করে মুক্তিযোদ্ধারা লড়াই করতে পারে বা যৌথবাহিনী প্রবেশ করতে পারে। তাকে স্বীকৃতি দেয়ার জ্ঞান-শিক্ষা বা ইচ্ছা কোনোটিই আমাদের মাঝে নেই। এমনিতেই আমরা অস্ত্র দেখে নিজেকে বীর ভাবতে অভ্যস্ত। কিন্তু যে নারী গোটা সমাজকে রক্ষা করে—তাকে আমরা অবহেলা করছি যুগ যুগ ধরে। আমরা জানিও না কীভাবে তাকে স্বীকৃতি দিতে হয়। কীভাবে তার গৌরবগাথা বলতে হয়, গাইতে হয়।

আমাদের ইতিহাসচর্চায় সশস্ত্র বা রাজনৈতিক পরিসরে কে কী করেছে সে বিষয়ে অনেক আলোচনা হয়। কিন্তু সামাজিক পরিসরে কী হয় সেটা আমরা জানি না। লক্ষ করলে দেখা যাবে, যেসব সূত্র থেকে এ তথ্য আসে সেগুলো সবই সমাজের ওপরতলার মানুষের দখলে। এই তথ্যের পরিসরকে বড়জোর সে পর্যন্ত নেয়া যায়, যেখানে কোনো ভূমিকা কেউ রেখেছে সে ক্ষমতাবান গোষ্ঠীর সহায়ক হিসেবে। এর ফলে ইতিহাসে তার ভূমিকা প্রান্তিক থাকে। যেহেতু সাধারণ নারীসমাজ রাজনীতিও করেনি এবং অল্প কজন অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছে, আমাদের গৌণকরণ প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নারীর ভূমিকা। আমরা যে তাকে পরিচয় বা স্বীকৃতি দিতে জানি না তা-ই নয়, আমরা আসলে তাকে দিতেও চাই না। এই না দিতে চাওয়ার মূল সূত্রই হচ্ছে, একটি জাতির স্বাধীনতা বা মুক্তিতে গোটা সমাজের ভূমিকা থোকে কি না, তা মেনে নেয়া বা না নেয়া।

যদি আমরা মনে করি, এটি কেবল নেতৃবর্গের বা নেতৃত্বদানকারী বা ক্ষতাবানদের কারণে ঘটেছে, তাহলে নারীর ইতিহাসও লেখা হবে না এবং সামাজের ইতিহাসও কেউ জানতে পারবে না। আমরা যখন ইতিহাসের তথ্য অনুন্ধান করি, তখন শুধু সশস্ত্র যুদ্ধের তথ্যই সংগ্রহ করে থাকি। কিন্তু সমাজের সংগ্রামের কথাকে তেমন একটা গুরুত্ব দিই না। এর ফলে আমাদের তথ্যভাণ্ডারেও এর তেমন কোনো উদাহরণ জমা পড়েনি। তাই ইতিহাসচর্চার প্রথম পদক্ষেপ ‘তথ্য সংগ্রহ’ সেটিই করা হয়নি বাংলাদেশের ইতিহাসে।

পৃথিবীর অন্যান্য অনেক দেশেই এটা হয়নি। কারণ, অন্য দেশের অবস্থাও ব্যতিক্রম। অর্থাত্ ক্ষমতবানদের দখলেই ইতিহাসচর্চা থেকেছে সবসময়। যাতে করে ইতিহাসের ‘লাভের গুড়’ তারাই পায়। ইউরোপের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ যুদ্ধ ছিল সম্মুখযুদ্ধ। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল পুরো দেশজুড়ে। খুব কম দেশে এরকম একটি পরিস্থিতি হয়—যেখানে হাজার হাজার গ্রাম অংশগ্রহণ করেছে তাদের মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন পরিসরে। কিন্তু ইতিহাসচর্চা করতে গেলে অনেক ইতিহাসবিদ এখনো যুদ্ধ-সংঘাতের খবর নেন, কিন্তু সাধারণ মানুষ কীভাবে একাত্তর পার করেছিল, কীভাবে সমাজ টিকিয়ে রেখেছিল—সে কথা জানতে চান না। সমাজের কথা না জানলে নারীর খবর জানা সম্ভব নয়—এ খুব সহজ সত্য। 

যে ক্ষেত্রে আমরা নারীর ভূমিকা উল্লেখ করতে চাই, সেটি তখন তার নির্যাতিত হওয়ার অভিজ্ঞতাকেন্দ্রিক হয়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নারীর প্রধান ভূমিকা হচ্ছে—একজন নির্যাতিত অসহায় মানুষ হিসেবে। সে বারবার পুরুষের লালসার শিকার হচ্ছে, পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করছে, কখনো পারছে, কখনো পারছে না। এমনকি নির্যাতিত হওয়ার পর সামাজিকভাবে গঞ্জনার শিকার হতে হয়েছে তাকে। কালেভাদ্রে দু-একজন অস্ত্রধারী নারীকে পাওয়া গেলে তার কথা বলা হচ্ছে, কারণ ওই নারী ‘পুরুষের পাশে দাঁড়িয়ে অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করেছে’। অর্থাত্, পুরুষ যেটা করেছে, সে তাকে কোনোভাবেই ইতিবাচক স্বীকৃতি দেয়নি। নারী নির্যাতন, তার প্রধান বাস্তবতা এবং এর বাইরে দু-এক স্থানে সে পুরুষের পাশে দাঁড়ানো সহযোদ্ধা। এই প্রান্তিকরণ একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ারই অংশ, যাতে কেবল নারী নয়, বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর বা সমাজের প্রায় সব মানুষ পড়ে যায়। অর্থাত্, সেসব মানুষ বা গবেষক ইতিহাসচর্চায় ভূমিকা রাখার অনুমতিপ্রাপ্ত নয়। সরকারের সঙ্গে সংযুক্ত হলেই বোধ করি কোনো ভূমিকা পালনের অধিকার জন্মাবে তাদের।

একটি ঘটনার উল্লেখ করতে চাই, যেটি আমাদের সাধারণ মানুষের ভূমিকা সম্পর্কে সামান্য ধারণা দেবে। কুমিল্লার একটি নদী পার হচ্ছিল একদল হিন্দু শরণার্থী। নৌকা না পেয়ে তারা কচুরিপানা সংগ্রহ করে একে ভেলা হিসেবে ধরে ধরে পার হচ্ছিল হাত-পা ছুড়তে ছুড়তে। ওই দলের মধ্যে একজন মা ছিলেন, সঙ্গে ছিল ছোট্ট শিশু। যেহেতু অনেক মানুষ কচুরিপানার ভেলাটি ধরেছিল, তাই পানির নিচে চলে গিয়েছিল। মহিলাটি এই অবস্থা দেখে চিত্কার করে কান্নাকাটি করতে থাকেন। এক হাতে তার সন্তান, অন্য হাতে ভেলাটি ধরা। এই অবস্থায় নড়াচড়া চিত্কার সবাইকে ভীষণ ভয় পাইয়ে দেয়। আশঙ্কা ছিল, আওয়াজ শুনে পাকিস্তানের আর্মি বা রাজাকাররা চলে আসতে পারে। ওই মহিলার পাশে ১৪/১৫ বছরের একটি মেয়ে ছিল। ওই মেয়েটি মহিলাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু মহিলার কিছুতেই ভয় কাটছিল না। তখন ওই মেয়েটি ভার কমাবার জন্য নিজের হাত ছেড়ে দিয়ে পানির নিচে তলিয়ে যায়। ভেলার সবাই নিরাপদে পৌঁছেছিল শুধু সেই মেয়েটি ছাড়া। এরকম অসংখ্য ঘটনা ৭১-এ ঘটেছে। কিন্তু তার কোনো উল্লেখ নেই, স্বীকৃতি নেই, মানুষের মাঝে চর্চা নেই। আমরা যত দিন এই মেয়েটিকে আমাদের শ্রেষ্ঠতম মানুষের একজন বলে সম্মান দিতে না পারব, যতদিন তাকে মুক্তিযোদ্ধা বলে স্বীকৃতি দিতে না পারব—ততদিন পর্যন্ত নারীর ইতিহাস বা সমাজের ইতিহাস উপেক্ষিতই থেকে যাবে। সম্ভবত উপেক্ষার মেঘ কেটে কখনোই সূর্য হাসবে না আমাদের ইতিহাসের সোনালি আকাশে।

ইত্তেফাক/জেডএইচ