বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

নির্যাতনে বছরে গড়ে মারা যায় ৩০ জন

আপডেট : ১৪ জানুয়ারি ২০২০, ০৭:২৯

‘অধিকাংশ বাসা-বাড়িতে কখনো নিরাপদ নন গৃহকর্মীরা। নানা কাজের ফাঁকে হাতে করে মলমূত্র পরিষ্কার করতে হয়। রান্নাঘরসংলগ্ন দুই বা ছয় বর্গফুট আয়তনের অস্বাস্থ্যকর কক্ষে রাত কাটাতে হয়। সব ধরনের নির্যাতন সয়ে গড়ে তাদের বেতন জোটে মাসে ৫০০ থেকে সর্বোচ্চ এক হাজার টাকা। গৃহকর্মীর কাজে যুক্তদের প্রায় ৯০ শতাংশই নারী ও শিশু। গৃহকর্মীদের নিয়ে কাজ করা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) গবেষণায় এমন চিত্র উঠে এসেছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, প্রতি বছর গড়ে ৩০ জন গৃহকর্মী নির্যাতনের কারণে মারা যাচ্ছেন। বিভিন্নভাবে নির্যাতিত কর্মীদের সংখ্যা কয়েকগুণ।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের পরিচালক নাজমা ইয়াসমিন ইত্তেফাককে বলেন, ‘গত ৯ বছরের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে আমরা দেখেছি, নির্যাতনের মাত্রা কমছে না। এ বছরের চিত্রটা একটু ভালো। তবে এটা কোনো ট্রেন্ড না। ২০১১ থেকে গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শুধু পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যে ৯ বছরে ২৬৯ জন গৃহকর্মী নির্যাতনের কারণে মারা গেছেন। আর নির্যাতিতের সংখ্যা ৪৯১ জন। এর মধ্যে ৫ থেকে ১২ এবং ১২ থেকে ১৮ বয়সের গৃহকর্মীর নির্যাতনের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এ সংখ্যা প্রায় ৮০ শতাংশ।’

বিলসের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০১১ সালে মারা গেছেন ৩৮ জন। নির্যাতিত ২০ জন। ২০১২ সালে নিহত ৪৬ জন, নির্যাতিত ৩২ জন, ২০১৩ সালে নিহত ৩২ জন, নির্যাতিত ২৪ জন, ২০১৪ সালে নিহত ২৭ জন, নির্যাতিত ২৮ জন; ২০১৫ সালে নিহত ৩৯ জন, নির্যাতিত ৩৯ জন, ২০১৬ সালে নিহত ৩৮ জন, নির্যাতিত ২৩ জন, ২০১৭ সালে নিহত ২৭ জন, নির্যাতিত ২৩ জন, ২০১৮ সালে নিহত ১৭ জন, নির্যাতিত ২৪ জন এবং ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিহত ৫ জন ও নির্যাতিত ৯ জন। এর মধ্যে ১২ থেকে ১৮ বছর বয়সের গৃহকর্মী মারা গেছে সবচেয়ে বেশি ৭২ জন। বিলস বলছে, এটা উদ্বেগজনক চিত্র। সার্বিক চিত্র এই সংখ্যার চেয়েও অনেক বেশি। অনেক নির্যাতনের ঘটনা পত্রিকার পাতায় স্থান পায় না।

তবে আইন ও সালিশ কেন্দ্রে সিনিয়র উপপরিচালক নীনা গোস্বামী ইত্তেফাককে বলেন, ‘আমাদের কাছে যেসব তথ্য আছে তা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩৪ জন নির্যাতিত হয়েছেন। এর মধ্যে একজন মারা গেছেন। ৭ থেকে ১২ বছরের ৯ জন এবং ১৩ থেকে ১৮ বছরের ১৪ জন নির্যাতিত হয়েছেন। এর মধ্যে ধর্ষিত হয়েছেন ১২ জন। এর মধ্যে মাত্র ১৮টি ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে।

নীনা গোস্বামী বলেন, যেসব ঘটনা সরাসরি বা পত্রপত্রিকায় বরাত দিয়ে জানা যায় বাস্তবে গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনা আরো অনেক বেশি। এখানে আইনজীবী, খেলোয়াড়, শিল্পী, ডাক্তার, সাংবাদিক, ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ কোনো পেশার মানুষের বাসাতে বাদ নেই যেখানে গৃহকর্মী নির্যাতন হয়নি। এটা ধরেই নেওয়া হয় যে, তারা ‘বাসার দাস’।

সারা দেশে গৃহকর্মীর সংখ্যা কত? এর কোনো সঠিক পরিসংখ্যান কারো কাছে নেই। আইন ও সালিশ কেন্দ্র মনে করে এই সংখ্যা ২৫ লাখেরও বেশি। তবে অন্যান্য সংগঠন বলছে, সংখ্যাটি ২০ লাখের মতো হবে। পুলিশ সদর দপ্তর নথিপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, রাজধানীসহ সারা দেশে যেসব গৃহকর্মী খুন ও নির্যাতনের শিকার হয় তার বেশির ভাগ ঘটনায় গৃহকর্ত্রীরা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। কখনো কখনো গৃহকর্তা কিংবা গৃহকর্তার ছেলেমেয়ে আত্মীয়স্বজনদের দ্বারাও নির্যাতনসহ ধর্ষণের শিকার হচ্ছে এসব অসহায় গৃহকর্মীরা।

বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির সাবেক নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী ইত্তেফাককে বলেন, ‘আসলে নির্যাতনের যে চিত্রটা আমরা দেখছি, সেটা আসল চিত্রের চেয়ে অনেক কম। বহু ঘটনা আমরা অনুসন্ধান করে দেখেছি, মিডিয়াতে আসেইনি। গোপনে মিটমাট করে ফেলেছে। অনেক ক্ষেত্রে হুমকিধমকি দিয়ে গৃহকর্মী ও তার পরিবারের সদস্যদের মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ক্ষতিপূরণ তো দূরে থাক, কোনো প্রতিকারই পাননি।’

শ্রমিকনেত্রী মোশরেফা মিশু ইত্তেফাককে বলেন, ‘দেশে প্রতিদিন কত সংখ্যক গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হচ্ছে তার সঠিক পরিসংখ্যান কারো কাছে নেই। নির্যাতনের প্রায় ৯০ শতাংশ ঘটনা নানাভাবে চাপা পড়ে যাচ্ছে। শুধু হত্যাকাণ্ড বা মুমূর্ষু অবস্থায় কোনো গৃহকর্মী হাসপাতালে ভর্তি হলেই তা প্রকাশ পাচ্ছে। নির্যাতনকারীদের কোনো কোনো ক্ষেত্রে গ্রেফতার করা হলেও দুর্বল পুলিশি তদন্ত ও অর্থের প্রলোভনে তাদের শাস্তি হচ্ছে না।’

ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান ইত্তেফাককে বলেন, গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনায় পুলিশ তার সাংবিধানিক ও সামাজিক দায়িত্ব পালন করছে। তবে মনে রাখতে হবে সবকিছু আইন প্রয়োগ করে শোধরানো সম্ভব নয়। সামাজিকভাবে নিজেদের ভেতরে সচেতনতা এবং দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে এ ধরনের ঘটনাকে কমিয়ে আনতে হবে।

ইত্তেফাক/আরকেজি