শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

১৪৪ ধারা ভাঙা হয় যেভাবে

আপডেট : ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০৬:৫২

১৯৫২ সালে একুশে ফেব্রুয়ারি। বেলা ১১টা। আমতলার সভায় সিদ্ধান্ত হলো ১৪৪ ধারা ভাঙা হবে। সভাপতির ভাষণ দিতে উঠে গাজীউল হক ছাত্রদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে দেন। তিনি বলেন, ‘নুরুল আমিন সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে পুলিশ মোতায়েন করেছে। ১৪৪ ধারা ভাঙা হলে নাকি গুলি করা হবে, ছাত্রদের হত্যা করা হবে। আমরা সরকারের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করছি। ১৪৪ ধারা আমরা ভাঙব। আমরা দেখতে চাই নুরুল আমিন সরকারের অস্ত্রাগারে কত বুলেট জমা আছে।’ তার বক্তৃতা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্লোগান ওঠে, ‘১৪৪ ধারা মানি না, মানি না।’ গগণবিদারী স্লোগানের সঙ্গে সঙ্গে ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভাঙার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। সত্যাগ্রহ করতে দশ জনের দল করে বাইরে যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু হয়। তবে কে প্রথম ১৪৪ ধারা ভাঙবে—এ নিয়ে সবার মধ্যে খানিক ইতস্ততা বোধ কাজ করছিল।

মোহাম্মদ সুলতানকে দায়িত্ব দেওয়া হয় যারা সত্যাগ্রহ করতে বাইরে যাবেন তাদের নাম-ঠিকানা লিখে রাখার। তাকে সাহায্য করেন আজহার ও হাসান হাফিজুর রহমান। নামধাম লিখে নেওয়ার জন্য মোহাম্মদ সুলতান এগিয়ে আসতেই মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান (পরবর্তীকালে প্রধান বিচারপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা) বলেন, ‘তুই আমার পঙ্খীরাজটা (সাইকেল) দেখিস, আমি চললাম।’ এরপরই গলা ফাটিয়ে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান দিতে দিতে তিনি এগিয়ে যান কয়েক জনকে সঙ্গে নিয়ে। এভাবেই ১৪৪ ধারা ভাঙার প্রথম দলের নেতৃত্ব দেন মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান।

এ প্রসঙ্গে মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান স্মৃতিকথায় বলেছিলেন, ‘তখন বেলা সোয়া ১টা। উত্তেজনায় সারা গা থেকে তখন আগুনের ভাপ বের হচ্ছে। প্রথমে পুলিশ আমাদের ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে এবং পরে রাস্তার একধারে ঘেরাও করে রাখে। আমরা এগিয়ে যাওয়ার পর যখন অন্য ছাত্ররা গেট পার হয়ে রাস্তায় নামতে শুরু করল তখন আমাদের কয়েকজনকে পুলিশ একটা ট্রাকে তুলে নিল। ট্রাকটা যখন তেজগাঁওয়ের দিকে চলতে শুরু করল তখন মনের অবস্থা হালকা করার জন্য আমি বললাম, ‘দূরে কোথাও কোন মজা পুকুরে আমাদের চ্যাংদোলা করে ছুড়ে ফেলা হবে।’ ট্রাকটা চলার সঙ্গে সঙ্গে ঠান্ডা হাওয়ায় মানসিক উত্তেজনা কিছু কমল, কিন্তু দুর্ভাবনা বাড়তে থাকল।’

এরপর দলে দলে মানুষ বের হতে শুরু করে। ১৪৪ ধারা ভাঙা ও গ্রেফতার বরণের এক প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। গাজীউল হক বলেন, ‘দ্বিতীয় দলের নেতৃত্ব দিয়ে ইব্রাহীম তাহা ও আবদুস সামাদ বাইরে বেরোলেন। তৃতীয় দল নিয়ে বেরোলেন আনোয়ারুল হক খান ও আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ। তিনটি সত্যাগ্রহী দলকেই পুলিশ গ্রেফতার করে এবং ট্রাকে তুলে নেয়। এসময় পুলিশের তরফ থেকে গেটে হামলা ও লাঠিচার্জ করা হয়। এর ফলে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম চতুর্থ দলটি যাবে সাফিয়ার নেতৃত্বে। এই দলে বেশ কয়েকজন ছাত্রী ছিলেন। রওশন আরা বাচ্চু, ডা. সাফিয়া, সুফিয়া ইব্রাহিম, শামসুন নাহার প্রমুখ।

পুলিশের লাঠিচার্জের ফলে ছাত্ররা উত্তেজিত হয়ে পুলিশের ওপর ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে। পুলিশ তখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে কাঁদানে গ্যাস ছাড়ে। ছাত্রদের রক্তে তখন বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে।

মোহাম্মদ সুলতান বলেন, ‘সত্যাগ্রহীদের নাম লেখার সময় পাওয়া যাচ্ছিল না। এসময় কাঁদুনে গ্যাসে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ অন্ধকার হয়ে পড়ে। কাঁদুনে গ্যাসের একটি শেল এসে সরাসরি আমার বুকে লাগে এবং আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি।’

এরপর পুলিশ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে প্রবেশ করে। এসময় কিছুক্ষণের জন্য ছাত্ররা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। তবে কিছুক্ষণের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজের মাঝখানের প্রাচীর টপকে মেডিক্যাল হোস্টেলের প্রধান ফটকের কাছে আবার জমায়েত হয়। গ্রেফতারবরণ চলতে থাকে দুপুর ২টা পর্যন্ত।

ইত্তেফাক/কেকে