শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

শোক ও গৌরবের অমর একুশে আজ

আপডেট : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০১:২৫

আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি—ভোলেনি বাঙালি জাতি। একুশে ফেব্রুয়ারি জাতির জীবনে চিরভাস্বর একটি দিন। প্রতিটি বাঙালির বুকে আজ বেজে উঠবে আলতাফ মাহমুদের সুরে আবদুল গাফফার চৌধুরীর সেই চির অম্লান গানটি। সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারের মতো মৃত্যুঞ্জয়ী ভাষাসৈনিকের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আজ।

আজ ‘শহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’। মাতৃভাষা আন্দোলনের ৬৮ বছর পূর্ণ হলো। জাতিসংঘের উদ্যোগে বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে ভাষাশহিদদের স্মরণে দিবসটি যথাযথ মর্যাদায় পালন করা হচ্ছে। রাজধানী ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের বেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ এবং বিভিন্ন স্থানে আলোচনা সভাসহ নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে জাতি একুশের মহান শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছে। শহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদ পৃথক বাণী প্রদান করেছেন।

একুশের প্রথম প্রহরে রাত ১২টা এক মিনিটে শহিদ বেদিতে রাষ্ট্রীয়ভাবে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর থেকেই শোকের ও শ্রদ্ধার প্রতীক সাদাকালো পোশাকে, খালি পায়ে, শিশিরসিক্ত পথ মাড়িয়ে আবালবৃদ্ধবনিতা সবাই সমবেত হতে শুরু করেন শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য। শুধু ঢাকাতেই নয়, সারাদেশের স্কুল-কলেজে, জেলা ও থানা প্রশাসনের উদ্যোগে শহিদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে দেশের সর্বস্তরের জনগণ। এদিকে পাড়ায়-মহল্লায় শিশু-কিশোরদের নিজ হাতে গড়া শহিদ মিনারও আজ সেজে উঠেছে ভবিষ্যত্ প্রজন্মের কাছ থেকে পাওয়া ফুলেল শ্রদ্ধায়।

সেদিন যা ঘটেছিল :বাঙালির মননে অনন্য মহিমায় ভাস্বর, মাথা নত না করার চির প্রেরণার নাম একুশে ফেব্রুয়ারি। ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে পূর্ববঙ্গের প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমীনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জনসভায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন ঘোষণা করেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’ এই মন্তব্যটুকুই ভাষা আন্দোলনের দাবানল সৃষ্টির পক্ষে যথেষ্ট ছিল। এর প্রতিবাদে ৩১ জানুয়ারি মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা পরিষদ গঠিত হয়। ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা শহরের সকল স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করা এবং আরবি হরফে বাংলা ভাষার প্রচলনের চেষ্টার প্রতিবাদে ধর্মঘট পালন করে। আর একুশে ফেব্রুয়ারিতে প্রদেশব্যাপী ধর্মঘট করার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ২০ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা জারি করে সরকার। এতে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা পরিষদের বেশিরভাগ সদস্য পিছিয়ে গেলেও ছাত্রদের দৃঢ়তায় ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হয়। ছাত্রদের বিক্ষোভে পুলিশ গুলি চালায়। এতে রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার, সফিউরসহ নাম না জানা অনেকে নিহত হন। এরপর সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে ভাষা আন্দোলন। পিছু হটতে বাধ্য হয় নাজিমুদ্দীন সরকার। মায়ের ভাষার মর্যাদা পায় বাংলা। একুশে ফেব্রুয়ারি তাই বাংলাদেশের, বাঙালির চির প্রেরণার প্রতীক। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা (ইউনেস্কো) ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর তাদের ৩০তম সম্মেলনে ২৮টি দেশের সমর্থনে ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি বাঙালি জাতির এক অনন্যসাধারণ অর্জন।

রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী শ্রদ্ধা :রাজধানী ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের বেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ এবং বিভিন্ন স্থানে আলোচনা সভাসহ নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে জাতি একুশের মহান শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছে। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ আজ একুশের প্রথম প্রহরে ১২টা ১ মিনিটে সর্বপ্রথম কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এর পরপরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শহিদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

২১ ফেব্রুয়ারি জাতীয় ছুটির দিন। এ দিন সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সব সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি ভবনে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়েছে। এ উপলক্ষ্যে সংবাদপত্রগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেসরকারি স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো একুশের বিশেষ অনুষ্ঠান সম্প্রচার করছে। আজিমপুর কবরস্থানে ফাতেহা পাঠ ও কোরআনখানির আয়োজনসহ দেশের সব উপাসনালয়ে ভাষাশহিদদের রুহের মাগফেরাতের জন্য বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হয়েছে। এ ছাড়া দিবসটি উপলক্ষ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।

কর্মসূচি : আওয়ামী লীগের কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে রাত ১২টা ১ মিনিটে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, সকাল সাড়ে ৬টায় কেন্দ্রীয় কার্যালয়, বঙ্গবন্ধু ভবনসহ সব কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ, কালো পতাকা উত্তোলন, সকাল সাড়ে ৭টায় কালো ব্যাজ ধারণ, প্রভাতফেরি সহকারে আজিমপুর কবরস্থানে ভাষা শহিদদের কবরে শ্রদ্ধা নিবেদন। এছাড়া ২২ ফেব্রুয়ারি বিকাল ৩টায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আলোচনা সভার আয়োজন করেছে দলটি। সভায় সভাপতিত্ব করবেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় উদ্যাপন উপলক্ষ্যে বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, নজরুল ইনস্টিটিউট, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, জাতীয় জাদুঘর, গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর, শিশু একাডেমিসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। গণযোগাযোগ অধিদপ্তর ঢাকা মহানগরীতে ট্রাকের মাধ্যমে রাজপথে এবং নৌযানের সাহায্যে ঢাকা শহর সংলগ্ন নৌপথে সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজনসহ জেলা-উপজেলায় ভ্রাম্যমাণ চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছে। চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর তিন ধরনের পোস্টার মুদ্রণ করেছে।

জেপির বিবৃতি : ভাষা শহিদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে জাতীয় পার্টি-জেপির চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এমপি এবং দলের সাধারণ সম্পাদক শেখ শহীদুল ইসলাম গতকাল এক বিবৃতিতে বলেছেন, মহান ভাষা আন্দোলন ছিল আমাদের জাতিসত্তা রক্ষায় ও সুদীর্ঘ মুক্তির সংগ্রামের প্রথম পদক্ষেপ। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়েই বাঙালি জাতিসত্তা বিকাশের পথ উন্মোচিত হয় এবং বাঙালি জাতি তার স্বাতন্ত্র্যবোধ ও জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটায়। একপর্যায়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি জাতি তার নিজের মাতৃভূমি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে। ভাষা আন্দোলন তাই আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়। নেতৃদ্বয় আরো বলেন, একুশের এই অমর শহিদরা যুগ যুগ ধরে বাঙালি জাতিকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর শিক্ষা দিবে এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পথ দেখাবে। তারা সকল ভাষা সৈনিকের অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন এবং শহিদদের রুহের মাগফেরাত কামনা করেন।