মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

লকডাউন মানছে না বেশির ভাগ মানুষ

কারফিউ চান বিশেষজ্ঞরা

আপডেট : ০৯ এপ্রিল ২০২০, ০২:৪৫

করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে ঘোষিত লকডাউন মানছে না কেউই। সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে রাস্তাঘাট, বাজার, পার্ক ও চায়ের দোকানে ভিড় করছে সাধারণ মানুষ। পাড়া-মহল্লায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন যুবকেরা। রাজধানীসহ সারাদেশের গ্রাম পর্যন্ত অভিন্ন চিত্র। সারাদেশের গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও পণ্য পরিবহনের গাড়িতে যাত্রী বহন করা হচ্ছে। বাস, ট্রেন ও লঞ্চ চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হলেও থেমে নেই মানুষের চলাফেরা। রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে রিকশা, অটোরিকশাসহ ছোটো যানবাহন চলাচল করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সামনেই। পণ্যবাহী যানবাহনে যাত্রী পরিবহন নিষিদ্ধ করা হলেও কেউ তা মানছে না। ফেরি সার্ভিস চালু থাকায় ট্রাক ও পিকআপ ভ্যানে চড়ে গ্রামের বাড়িতে যেতে দেখা গেছে অনেককেই। এমন অবস্থায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কারফিউ চেয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলেন, রোগ হওয়ার আগে প্রতিকারই উত্তম ব্যবস্থা। এখনই করোনা রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে স্বাস্থ্য বিভাগ। আর পরিস্থিতি নাগালের বাইরে গেলে কে কার চিকিত্সা করবে? বাংলাদেশে চলতি মাসে করোনা ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও করছেন বিশেষজ্ঞরা।

চীন, সিঙ্গাপুরসহ যেসেব দেশ করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে, ঐ সব দেশে লকডাউন সবাই মেনেছে। লকডাউনে কেউ বাইরে বের হতে পারেনি, হয়নিও। চীনের সাংহাই উসান হাসপাতালের সংক্রামক ব্যাধি বিভাগের পরিচালক প্রফেসর ডা. জংয়ের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে কথা বলেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ। কীভাবে চীন করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছে তার সার্বিক চিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য রাখেন ডা. জং। 
তিনি বলেন, করোনার ক্ষেত্রে সবার আগে শনাক্তকরণ পরীক্ষা বাড়াতে হবে। কেউ চিহ্নিত হলে তাকে আইসোলেশনে রাখতে হবে। লকডাউন বলতে যা বোঝায়, তা-ই করতে হবে। তিনি বলেন, সামান্য সর্দি, কাশি, জ্বরের রোগীদের চিকিত্সা দিতে হবে, তবে হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন নেই। যাদের অবস্থা ক্রিটিক্যাল, তাদের হাসপাতালে ভর্তি রেখে চিকিত্সাসেবা দিতে হবে। ডা. জং বলেন, উহান প্রদেশে করোনা রোগীদের জন্য যে ৫ হাজার বেডের হাসপাতাল তৈরি করা হয়েছিল, এখন ঐ হাসপাতালের সব বেড খালি। বাংলাদেশ সরকার প্রয়োজন মনে করলে এগুলো কাজে লাগাতে পারে। এ ব্যাপারে চীন সহযোগিতা করতে প্রস্তুত আছে। এদিকে দেশে বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোর ১৪ হাজার বেড রয়েছে। করোনা রোগীদের চিকিত্সার জন্য এগুলোও প্রস্তুত করা যেতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, পুরো এপ্রিল মাসে কালো অধ্যায়ের সৃষ্টি হতে পারে। এ মাসে কী পরিমাণ করোনায় আক্রান্ত হবে এবং মারা যাবে তা কেউ বলতে পারছে না। ইউরোপ থেকে ১ লাখ ৯০ হাজার মানুষ দেশে এসেছেন। এরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। ইউরোপে করোনা ব্যাপক হারে দেখা দেওয়ার পর তারা ঐ সব দেশ থেকে বাংলাদেশে আসেন। তাদের কোয়ারেন্টাইনে রাখা যায়নি।

বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকেরা বলেন, ‘আমরা কী বলতে চাইছি, পলিসি মেকাররা তা বুঝতে পারছেন না। লকডাউন কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। লকডাউনে লোকজন চলাফেরা করতে পারবে না, যাতে ভাইরাসটি ছড়িয়ে না পড়ে। মানুষকে ঘরে রাখার মাধ্যমে দেশ রক্ষা করতে এখন কারফিউ বা অ্যাকশন শুরু করতে হবে। ভাইরাসটি ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়লে ডাক্তার-নার্স পাওয়া যাবে না এটাই স্বাভাবিক। ইতিমধ্যে ডাক্তার-নার্সরা করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। গতকাল বেসরকারি হাসপাতালের একজন শিশু বিশেষজ্ঞ আক্রান্ত হয়েছেন। তার ধানমন্ডির বাড়িটি লকডাউন করা হয়েছে।

তবে প্রতিবেশীরা তাকে উত্সাহ দিয়ে বলেছেন, ভয় নেই, যত ধরনের সহযোগিতা প্রয়োজন প্রতিবেশীরা ঐ ডাক্তারের জন্য করবেন। এভাবে প্রতিবেশীরা উত্সাহ দিচ্ছেন। বিশেষজ্ঞরা আরো বলেন, সরকারের হাইকমান্ডকে সঠিক কথা বলা হচ্ছে না। নীতিনির্ধারকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। বাংলাদেশ অনেক সময় পেয়েও সঠিক সময়ে পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞরা জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম থেকেই মানুষকে ঘরে থাকার কথা বলে আসছেন। প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করেন। কিন্তু মাঠপর্যায়ে তা সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। এছাড়া ত্রাণ দেওয়ার নামে দেশে অধিকাংশ এলাকায় জনসমাগমের ঘটনা ঘটছে। এটা বন্ধ করতে হবে। ত্রাণ মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করার জন্য বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দেন। শুরুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোয়ারেন্টাইনে থাকাসহ কয়েক দফা নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তার এই নির্দেশনা সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে করোনা পরিস্থিতির ঝুঁকি এড়ানো সহজ হতো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুখ্য চিকিত্সক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, সবারই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। নইলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। তাই সময় থাকতে এখনই কারফিউ বা অ্যাকশন যা প্রয়োজন তা-ই করতে হবে।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের (ঢামেক) অধ্যক্ষ ডা. খান মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, এপ্রিলের পুরো মাসটি ঝুঁকিপূর্ণ। এখনো সময় আছে লকডাউন কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। নইলে যখন ব্যাপক হারে আক্রান্ত হবে, তখন কেউ কাউকে খুঁজে পাবে না। ত্রাণ দেওয়ার নামে জনসমাগম এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে বাড়ি বাড়ি ত্রাণ পৌঁছে দিতে হবে। দরকার হলে কম খাওয়ারও পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, রোগ হওয়ার আগে প্রতিরোধ দরকার।

ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. শফি আহমেদ বলেন, করোনা রোগীদের সেবা দিতে এখনই স্বাস্থ্য বিভাগ হিমশিম খাচ্ছে। মহামারি দেখা দিলে কী হবে? ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়লে কে কার চিকিত্সা করবে? তাই সময় থাকতে মানুষকে ঘরে রাখতে হবে।

সরেজমিন রাজধানীর বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা গেছে, করোনা ভাইরাসের আতঙ্কে দেশ জুড়ে সবকিছু অঘোষিত লকডাউন থাকলেও রাজধানীর গলিপথ ও বাজারগুলোর চিত্র ভিন্ন। মুখে মাস্ক থাকলেও একে অন্যের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বাজার করছেন। বাজার করতে এসে নিরাপদ দূরত্বের তোয়াক্কা করছেন না নগরবাসী। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা জানান, বিনা কারণে কেউ বাসা-বাড়ি থেকে বের হলে তাদের বুঝিয়ে-শুনিয়ে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। তার পরও লোকজন শিক্ষা নিচ্ছে না। তাদের মধ্যে কোনো ধরনের ভয় কাজ করছে না। আমরা কঠোর হয়েছি। সামনের দিনগুলোতে আরো কঠোর হবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো।

ইত্তেফাক/বিএএফ