শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় আইন মানা হচ্ছে না

আপডেট : ১২ জুলাই ২০২০, ০১:২২

দেশে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার প্রতিষ্ঠায় আইন মানা হচ্ছে না। রাজধানীসহ জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সরকারি হাসপাতালের সামনে ও আশপাশে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। আর এসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত বেতনভুক্ত দালালরা সরকারি হাসপাতালের রোগীদের ভাগিয়ে নিচ্ছে।

সরকারি হাসপাতালের এক শ্রেণির ডাক্তার, নার্স, ওয়ার্ড বয় ও আয়ারাও রোগী ভাগিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করে নির্ধারিত কমিশন পাচ্ছেন। অথচ সরকারি আইন অনুযায়ী সরকারি হাসপাতালগুলোর এক কিলোমিটার, কিছু কিছু ক্ষেত্রে আধা কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে কোনো বেসরকারি হাসপাতাল থাকতে পারবে না। কিন্তু সারা দেশে এই আইন মানা হচ্ছে না, চলছে রমরমা বাণিজ্য। এই বেসরকারি হাসপাতালগুলোর অধিকাংশেরই মালিক ডাক্তার ও স্থানীয় প্রভাবশালীরা। মাসোয়ারা পাওয়ার কারণে চুপ থাকেন সিভিল সার্জন অফিসসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার ঘিরে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এগুলোর অনুমোদন দিয়ে থাকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। কিন্তু খোঁজখবর না নিয়ে অর্থের বিনিময়ে অনুমোদন দেওয়া হয়ে থাকে। ফলে কোনো ধরনের নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা তারা করে না। সর্বত্রই সরকারি হাসপাতালের কাছাকাছি গড়ে ওঠা দালালনির্ভর এসব ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে নিরীহ মানুষ। এতে সরকারি হাসপাতালের প্রতি মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে।

আরো পড়ুন: বিক্রম দোরাইস্বামী বাংলাদেশে ভারতের নতুন হাইকমিশনার

অনুসন্ধানে জানা যায়, একশ্রেণির দালাল ও সরকারি হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলে সিন্ডিকেট করেই এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন। কোনো কোনো হাসপাতালে ডাক্তার-নার্স নেই। আবার গাইনি বিশেষজ্ঞ না থাকলেও অন্য ডাক্তার দিয়ে সিজার করানো হচ্ছে। এ কারণে তৃণমূলে ৫০ শতাংশ সিজার হচ্ছে ত্রুটিপূর্ণ। এসব ত্রুটিপূর্ণ সিজারের কারণে মা ও শিশু উভয়ের জীবন পরবর্তী সময়ে বিপন্ন হয়ে পড়ে। বেঁচে থাকলেও স্বাভাবিক জীবনে তাদের ফিরে আসার সম্ভবনা কম বলে গাইনি বিশেষজ্ঞরা জানান। সম্প্রতি একটি গবেষণায়ও এ তথ্য বেরিয়ে আসে। টাকার ভাগ পায় সিভিল সার্জন অফিস, বিভাগীয় পরিচালকের কার্যালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক শ্রেণির কর্মকর্তা।

বিভিন্ন সময় র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত এসব হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ভুয়া ডাক্তারের বিরুদ্ধে অভিযান চালায়, আটক করে জেলে পাঠায় এবং জরিমানার দণ্ডও জারি করে। অভিযুক্ত ক্লিনিকগুলো সিলগালাও করে দেওয়া হয়। কিন্তু নানা কৌশলে প্রতিষ্ঠানগুলো সচলই থাকে। মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের সমন্বয়ে একটি ভিজিলেন্স টিম আছে। তারাও এ ব্যাপারে দেখভাল করে না।

সরকারি মেডিক্যালে যেসব চিকিসক রোগী দেখে থাকেন তাদের অনেকেরই নিজস্ব চেম্বার রয়েছে। অনেকে সরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি নামে-বেনামে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ল্যাব, ডায়াগনস্টিক ও প্যাথলজি সেন্টারে রোগী দেখেন। এরাই প্রয়োজন ছাড়া কমিশনের লোভে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীদের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পছন্দের প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে পাঠাচ্ছেন। আর প্রেসক্রিপশন লেখার বিনিময়ে ল্যাবগুলোর কাছ থেকে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কমিশন নিচ্ছেন। অথচ সরকারি হাসপাতালে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সব ব্যবস্থা থাকলেও বলা হয়, মেশিন নষ্ট। সরকারি হাপসাতালে ৩০ থেকে ৯০ শতাংশ ওষুধসামগ্রী সরবরাহ করা হয় সরকারিভাবে। কিন্তু অধিকাংশ রোগী এই ওষুধ পান না।

সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা গেছে, রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে অবস্থিত সোহরাওয়ার্দী, কিডনি, পঙ্গু, হূদরোগ, চক্ষু, নিউরোসায়েন্স ও শিশু হাসপাতালকে কেন্দ্র করে মোহাম্মদপুরের বাবর রোড ও এর আশপাশের অলিগলিতে গড়ে উঠেছে অর্ধশতাধিক হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। সড়কের দুই পাশে শুধু হাসপাতাল আর হাসপাতাল। আধা কিলোমিটার রাস্তায় সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ৬০টি হাসপাতাল। শত শত রোগী আর দালালে গিজগিজ করে ঐ এলাকা। এসব সরকারি হাসপাতালে সেবা নিতে আসা রোগীদের দিকে দৃষ্টি থাকে ঐ এলাকার বেসরকারি হাসপাতালগুলোর। এজন্য নিয়োগ করা হয়েছে দালাল। রোগী ধরার ফাঁদ পেতে বসে থাকে দালালরা। ঐ এলাকার বেসরকারি হাসপাতালগুলোর নিজস্ব মার্কেটিং প্রতিনিধি আছে যারা বেতন হিসেবে আবার কমিশন হিসেবে কাজ করেন। দালাল চক্র সকাল থেকেই সরকারি হাসপাতালে শুরু করে জটলা। চলে গভীর রাত পর্যন্ত। এক-দুই জন নয়, কয়েকশ প্রতিনিধি। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, মিডফোর্ট হাসপাতাল, মহাখালীর বক্ষব্যাধি হাসপাতাল ও ক্যানসার হাসপাতালের আশপাশের পরিস্থিতিও একই। ঐ এলাকায়ও রয়েছে বেশ কিছু সংখ্যক বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। দালালরা রোগী ভাগানোর প্রতিনিধি নামে পরিচিত। রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু করেন তারা। লোভনীয় অফার আর হয়রানি। চলে টানাহ্যাঁচড়াও। অসহায় রোগী আর তাদের অভিভাবকরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাদের ফাঁদে আটকা পড়েন। হাসপাতালে ভর্তি করার পর শুরু হয় অন্যরকম হালচাল। টাকা আদায়ের যত কলা-কৌশল, চিকিৎসার বালাই নাই। উল্টো আদায় করা হয় বিভিন্ন অজুহাতে বড় অঙ্কের টাকা। আর এই চিকিৎসা সেবার ভার বহন করতে গিয়ে অনেকেই হারিয়েছেন মূল্যবান অনেক কিছু। টঙ্গী সরকারি হাসপাতালের রোগীদের ভাগিয়ে আনা হতো উত্তরার রিজেন্ট হাসপাতালে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, করোনার কারণে অভিযান একটু স্থিমিত আছে। অবশ্যই নিয়ম বহির্ভূতভাবে প্রতিষ্ঠিত ক্লিনিকগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সিলেট অফিস জানায়, সিলেট বিভাগের চার জেলার বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আশপাশে দেদারছে গড়ে উঠেছে প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়গনস্টিক সেন্টার। কোনো কোনো স্থানে দুই থেকে আড়াইশ ফুটের মধ্যেই গড়ে উঠেছে এসব প্রাইভেট চিকিৎসা কেন্দ্র। এই সব প্রাইভেট হাসপাতাল ক্লিনিকগুলোর সঙ্গে নামে-বেনামে জড়িত রয়েছেন সরকারি হাসপাতালের অনেক নামি ডাক্তার, টেকনিশিয়ান ও কর্মচারী। সরকারি হাসপাতালের কোনো কোনো ডাক্তার, নার্স ও কর্মচারীর গভীর বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে। কেউ ব্যবসায় অংশীদার। কেউ কাজ করেন কমিশনে। এদের কারণে অনেক ডাক্তার, নার্স ও কর্মচারীও অতিষ্ট। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলেছেন. ‘এদের কারণে চিকিৎসক সমাজ আজ সমালোচনার মুখে।’

কুমিল্লা প্রতিনিধি জানান, জেলার সরকারি সদর হাসপাতাল এবং কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ (কুমেক) হাসপাতালের আশপাশে অন্তত দুই ডজন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সরকারি হাসপাতালের কিছু চিকিৎসক ও প্যাথলজিস্ট এসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে রোগী পাঠিয়ে কলে (ডাক পেয়ে) গিয়ে চিকিত্সার নামে অধিক টাকা রোজগারে ব্যস্ত সময় পার করেন। সরকারি হাসপাতালের পাশে বেসরকারি এসব প্রতিষ্ঠান হওয়ায় সাধারণ রোগীরা নানাভাবে প্রতারিত হচ্ছেন। নগরীর নিম্নমানের অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকের নিয়োগ করা দালালরা রোগীদের প্রলোভন দেখিয়ে তাদের প্রতিষ্ঠানে নিয়ে ভর্তি করে। ফলে রোগীরা সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

কক্সবাজার প্রতিনিধি জানান, সরকারি হাসপাতালে প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবার অপ্রতুলতার অভিযোগ তুলে বেসরকারি হাসপাতালেই চিকিৎসার আশায় ছুটছে মানুষ। অনেক ক্ষেত্রে এসব বেসরকারি হাসপাতাল গড়ে উঠেছে আবার সরকারি হাসপাতালের কূল ঘেঁষেই। আর সেখানেই পরিচ্ছন্নতায় চিকিত্সাসেবা দেন সরকারি হাসপাতালের সেসব চিকিৎসকরাই, যারা সরকারি দায়িত্বপালনে ভালো মতো সেবা দেন না বলে অভিযোগ তুলেন রোগী ও তাদের স্বজনরা। দেখা গেছে, কক্সবাজার সদর হাসপাতালের ৩০-৪০ গজের ভেতর সাতটি বেসরকারি হাসপাতাল সেবা কার্যক্রম চালাচ্ছে।

পাইকগাছা (খুলনা) সংবাদদাতা জানান, পাইকগাছার সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা না পেয়ে প্রাইভেট ক্লিনিকে ছুটে যাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। করোনার ভয়ে অনেকে হাসপাতালে যেতে চান না। তাছাড়া হাসপাতালে সব সময় ডাক্তারও থাকেন না বলে জানান সেবা নিতে আসা উপজেলার বাসিন্দা মজিদা শাহাবাজ দম্পতি। পৌরসভার নাছিমা বেগম জানান, কোনো কিছু না ভালো করে দেখেই খুলনা শহরে পাঠিয়ে দেন ডাক্তাররা। তাছাড়া ৫০ শয্যা হাসপাতালের পাশে গড়ে উঠা পাঁচটা ক্লিনিক ও আটটা ডায়াগনস্টিক সেন্টার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চলেছে। তাদের সঙ্গে সরকারি হাসপাতালের ডাক্তাররা সরাসরি জড়িত।

খুলনা অফিস জানায়, খুলনার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে স্বাস্থ্যসেবা ভেঙে পড়েছে। করোনা ভাইরাসের দোহাই দিয়ে অধিকাংশ চিকিত্সকই হাসপাতালে রোগী দেখা বন্ধ করে দিয়েছেন। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বেসরকারি ক্লিনিকগুলো রমরমা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। ডুমুরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কাগজে-কলমে ২৪ জন চিকিৎসক থাকলেও বাস্তবে তিন-চার জনের বেশি দেখা যায় না। ফলে কাঙ্ক্ষিত সেবা না পেয়ে রোগীরা হাসপাতালের আশপাশে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা ক্লিনিকে যাচ্ছেন। অভিযোগ রয়েছে, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিত্সকরা হাসপাতালে হাজিরা দিয়ে রোগী দেখার উদ্দেশে ক্লিনিকে গিয়ে বসেন।

তেরখাদা সংবাদদাতা জানান, সরকারি নিয়মনীতি উপেক্ষা করে তেরখাদা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অনতিদূরে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে বেসরকারি ক্লিনিক। লাইসেন্সবিহীন এসব ক্লিনিকে নেই পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি, অপারেশন থিয়েটার, নেই পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ এবং বিদ্যুতের বিকল্প ব্যবস্থা। নেই দক্ষ চিকিত্সক, বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য নেই কোনো ভালো যন্ত্রপাতি। এখানে লাগামছাড়া অর্থ নিয়ে রোগী সাধারণের সেবা দান করা হয়। সরেজমিনে দেখা যায়, তেরখাদা উপজেলা সদরে উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কাছে কমপক্ষে পাঁচটি ক্লিনিক গড়ে উঠেছে। করোনার মধ্যেও কাক ডাকা ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত এসব স্থানে রোগীর সমাগম থাকে।

ইত্তেফাক/এএএম