মহামারি করোনায় বিপর্যস্ত দেশ। তার মধ্যে ঘূর্ণিঝড় বন্যার কারণে গ্রামীণ অর্থনীতিতে বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে। বন্যায় দেশের ২৫ শতাংশ এলাকা ডুবে আছে। নদনদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। দীর্ঘস্থায়ী বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে ৩ লাখ পরিবারের ১৪ লাখ ৫৭ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। পরিস্থিতি যে পর্যায়ে তাতে ১৯৯৮ সালের ৩৩ দিনের বন্যার রেকর্ড ছুঁয়ে যেতে পারে চলমান বন্যা। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যার পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী বন্যা ২৩ জেলায় বিস্তৃতি লাভ করবে এবং তা আগস্টের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত থাকবে।
ভারতের মেঘালয়, চেরাপুঞ্জি, আসাম ও ত্রিপুরা এবং চীন ও নেপালের পানি এসে বাংলাদেশে এই বন্যার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। করোনা ভাইরাস সংক্রমণের এই সময়ে দীর্ঘস্থায়ী বন্যা দেশের গ্রামীণ জনপদের খাদ্যনিরাপত্তা তো বটেই, স্বাস্থ্য ও অর্থনীতিতে বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
গত মার্চ থেকে করোনা দুর্যোগ মোকাবিলা করছে সরকার। সংকট মোকাবিলায় বিভিন্ন খাতে ১ লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা, বেকার হয়ে পড়া লাখ লাখ পরিবার ও সাড়ে ৩ কোটি মানুষকে নগদ সহায়তা দিয়েছে সরকার। ইতিমধ্যে বন্যার ছোবলে ঘরবাড়িসহ সহায়সম্পদহীন হাজার হাজার পরিবার।
ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, তিস্তা ও মেঘনার পানি বিপত্সীমা অতিক্রম করে গেছে। এছাড়াও নদনদীর পানি দুই কূল ছাপিয়ে উপচে পড়ার অবস্থা। ভারত, নেপাল, চীন থেকে আসা পানির পাশাপাশি টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। তলিয়ে গেছে বসতবাড়ি ও সড়ক। স্রোতের মধ্যে ঝুঁকি নিয়ে চলছে যানবাহন। বন্যায় যারা ঘরবাড়ি ছেড়েছে তাদের একত্রে থাকতে হচ্ছে। ফলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা অসম্ভব হয়ে পড়ছে। আগামীতে করোনা সংক্রমণের হার বাড়তেই থাকবে এমন আশঙ্কা রয়েছে। পানির চাপ অব্যাহত থাকলে সবজি চাষে মারাত্মক ক্ষতি হবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বন্যায় ৫০০ কোটি টাকার ফসলের ক্ষতি হয়েছে। বিভিন্ন জেলায় আউশ ও আমনসহ বিভিন্ন ফসলের ৪৩ হাজার হেক্টর ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বিভিন্ন ফসলের উত্পাদনে এই ক্ষতির পরিমাণ ১ লাখ ৪২ হাজার টন। প্রায় সাড়ে ৩ লাখ কৃষকের ৪৯৭ কোটি টাকার ফসল কেড়ে নিয়েছে মৌসুমের শুরুর এই বন্যা। এর আগে, ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে দেশের ৪৩ জেলায় আম, লিচু ও ধানসহ ২০টি ফসলের ৬৭১ কোটি ৭০ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়। ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় সাড়ে ৮ লাখ কৃষকের ২ লাখ ৬৫ হাজার ৬৭ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়।
বর্তমানে ১৭টি জেলা বন্যাকবলিত হয়েছে। বন্যাকবলিত জেলাগুলো হচ্ছে রংপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট, মানিকগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, সিলেট, বগুড়া, মাদারীপুর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, কুড়িগ্রাম, জামালপুর, গাইবান্ধা, ফরিদপুর, রাজবাড়ি, মুন্সিগঞ্জ ও নেত্রকোনা। এই মুহূর্তে বন্যাক্রান্ত ১৭টি জেলায় ২ লাখ ৯৪ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে আছে। বন্যায় মোট ক্ষতিগ্রস্ত লোকসংখ্যা ১৪ লাখ ৫৭ হাজার।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যাপূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী বন্যা ২৩ জেলায় বিস্তৃতি লাভ করবে এবং তা আগস্টের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত থাকবে। চলমান বন্যা ১৯৯৮-এর মতো হলেও বিস্তৃতির দিক থেকে এটি এখনো অতটা বড় আকার নেয়নি। তবে ইতিমধ্যে ১৭দিন অতিক্রম করেছে। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বন্যা হিসেবে পরিচিত ১৯৯৮-এর বন্যায় দেশের ৬৩ শতাংশ এলাকা ডুবে যায়। ১৯৮৮ সালের বন্যায় দেশের ৬৭ শতাংশ ও ২০০৭-এর বন্যায় ৫৩ শতাংশ এলাকা ডুবে যায়। তবে চলমান বন্যায় এখন পর্যন্ত দেশের ২৫ শতাংশ এলাকা ডুবেছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে দেশের ৪০ শতাংশ এলাকা ডুবে যেতে পারে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান বলেন, বেশি বন্যাকবলিত এলাকায় ১ হাজার ৩৫টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সেখানে ২০ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের রান্না করা খাবার দিতে সেই সব জেলার ডিসিদের ৫ লাখ টাকা করে দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, সরকারের ত্রাণসহায়তা চালিয়ে যাওয়ার মতো সক্ষমতা আছে। আরো যত বড় দুর্যোগ আসুক না কেন, দুর্যোগ যত দীর্ঘস্থায়ী হোক না কেন, দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের ত্রাণসহায়তা দেওয়ার মতো সক্ষমতা আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা সরকারের আছে।
ইত্তেফাক/এসি