শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

‘প্রতিরক্ষা কূটনীতি' দিয়ে বাংলাদেশকে চীন থেকে দূরে রাখতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র

আপডেট : ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৪:৩০

 চীনের অর্থনৈতিক প্রভাব থামানোর জন্য সাম্প্রতিক সময়ে নিজেদের সামরিক অস্ত্র অধিকহারে কিনতে বাংলাদেশকে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র। কারণ দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশকে  একটি ‘উদীয়মান’ শক্তি মনে করে দেশটি। আর এ কারণে বাংলাদেশের মতো উদীয়মান মিত্রের ওপর চীনের অর্থনৈতিক প্রভাব  থামাতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। জাপানের সংবাদমাধ্যম নিক্কি এশিয়ান রিভিউয়ে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে।  

 এ মাসের শুরুর দিকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যিনি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ও দেখাশোনা করেন, তাকে ফোন করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্ক এসপার। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে এভাবে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রীর ফোন করার ঘটনা বিরল।  ওই ফোনে তিনি দক্ষিণ এশিয়ার এ দেশটিকে ২০৩০ সালের মধ্যে সামরিক বাহিনীকে আধুনিকায়নে সহায়তার প্রস্তাব দেন। 

 এদিকে গত বছর অ্যাপাচে হেলিকপ্টার ও ক্ষেপণাস্ত্রসহ আধুনিক সামরিক অস্ত্র বিক্রি নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। যদিও বিস্তারিত কিছু প্রকাশ করা হয়নি এ নিয়ে, তবু ধারণা করা হয় একটি চুক্তির পর্যায়ে রয়েছে তা। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ডেপুটি এসিসট্যান্ট সেক্রেটারি লরা স্টোন বলেছেন, ‘বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে কংগ্রেসকে জানানো হয়নি’।
 
নিক্কি এশিয়ান রিভিউয়ের সাম্প্রতিক এক ইমেইলের জবাব দিয়েছেন লরা স্টোন। তাতে তিনি লিখেছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের নিরাপত্তা সহযোগিতা আরো গভীর করতে চাই। এই সহযোগিতা পারস্পরিক স্বার্থে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতার প্রতি পূর্ণ সম্মান দেখানো হবে। বাংলাদেশে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম বিক্রি করতে অংশীদার হিসেবে আমরা প্রস্তুত। 

১৯৯০ এর দশক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে অধিক পরিমাণ অস্ত্র কিনেছে বাংলাদেশ। ২০১৯ সাল নাগাদ ১০ বছরে ১১ কোটি ডলারের অস্ত্র কেনা হয়েছে। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্স ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, ২০১০ সাল থেকে চীনের কাছ থেকে অস্ত্র কিনতে ২৫৯ কোটি ডলার ব্যয় করেছে বাংলাদেশ। যা যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে অস্ত্র কেনার জন্য ব্যয় করা অর্থের চেয়ে অনেক বেশি।

যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রফেসর আলী রীয়াজ বলেন, ঢাকা যখন বেইজিংয়ের সঙ্গে উষ্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে, তখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ফোনালাপের সময়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

  বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে বিনিয়োগ  এবং বাণিজ্যে চীনের প্রভাব রয়েছে।  করোনা ভাইরাস মহামারির মধ্যে বাংলাদেশে মাস্ক এবং গাউনের মতো পিপিই সরবরাহ পাঠিয়েছে তারা। এছাড়া করোনা মহামারিতে কি কি করতে হবে, সে বিষয়ে পরামর্শ দিতে বাংলাদেশে পাঠিয়েছে একটি মেডিকেল টিম। এছাড়া বাংলাদেশে চীনের প্রাইভেট কোম্পানি সিনোভ্যাকের উদ্ভাবিত করোনা ভ্যাকসিনের চূড়ান্ত পর্যায়ের ট্রায়ালের প্রক্রিয়াও অগ্রসরমান। 

সম্প্রতি ভারত সীমান্তঘেঁষা উত্তরপূর্বের শহর সিলেটে বিমানবন্দরে ২৫ কোটি ডলারের টার্মিনাল নির্মাণকাজ নিশ্চিত করেছে চীন। এরপরই বাংলাদেশে আমদানিপণ্যের শতকরা ৯৭ ভাগের ওপর থেকে শুল্কহার প্রত্যাহার করেছে বেইজিং।তিস্তা নদীর পানিবন্টনের বিষয়টি ভারতের সঙ্গে বছরে পর বছর অমিমাংসিত রয়েছে। বিশেষ করে ভারতের দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গের বিরোধিতার কারণে এমনটা হচ্ছে। এ অবস্থায় তিস্তা নদী ব্যবস্থাপনার জন্য চীনের কাছ থেকে ১০০ কোটি ডলার ঋণ পাওয়ার চেষ্টা করছে বাংলাদেশ। ভারত ও চীনের সঙ্গে একটি ভারসাম্য অবস্থা বজায় রাখছে বাংলাদেশ। কিন্তু তার মধ্যে ওয়াশিংটন এখন বিশেষভাবে সক্রিয় হয়েছে।

নিক্কি এশিয়ান রিভিউয়ে এক ইমেইল বার্তায় প্রফেসর আলী রীয়াজ লিখেছেন, বিরোধপূর্ণ প্রত্যাশার স্থানে ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে বাংলাদেশকে।   

বিস্তৃত ইন্দো-প্যাসিফিকে ওয়াশিংটনের কৌশলের অংশ হলো প্রতিরক্ষা কূটনীতি।   ২০১৯ সালে এই কৌশল নিয়ে প্রথম রিপোর্ট প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। এতে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও মালদ্বীপের পাশাপাশি একটি ‘উদীয়মান অংশীদার’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। লরা স্টোন নিক্কি এশিয়ান রিভিউকে বলেছেন, ইন্দো-প্যাসিফিকে অঞ্চল নিয়ে  আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির কারণ হলো  বাংলাদেশের মতো, যুক্তরাষ্ট্রও ইন্দো-প্যাসিফিকের একটি দেশ। সব দেশের সুবিধার জন্য ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের স্বাধীনতা, উন্মুক্তরণ, শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ করার জন্য দক্ষিণ এশিয়ার নৌ ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্যই আমরা এমন সব উদ্যোগে জোর দিয়েছি, যা নিরাপত্তাকে সামনে এগিয়ে নেবে।

আলী রীয়াজ বলেন, এ অঞ্চলে চীনের প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভে (বিআরআই) অংশ নিয়েছে বাংলাদেশ। এর ফলে ইন্দো-প্যাসিফিক এজেন্ডা দৃঢ়তার সঙ্গে বাস্তবায়নজরুরি হয়ে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য। 

প্রফেসর আলী রীয়াজ পূর্বাভাষ দিয়েছেন দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন নীতির পরিবর্তন নিয়ে। তিনি মনে করেন নভেম্বরের নির্বাচনে যদি জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তাহলে যুক্তরাষ্ট্র আরো বেশি সংযুক্ত হবে এ অঞ্চলে। তবে তিনি বিশ্বাস করেন,   চীনের যে ক্রমবর্ধমান প্রভাব দক্ষিণ এশিয়ায় রয়েছে সেই তুলনায় যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলে প্রভাব ফেলতে পারবে না। 

সরকারি এক ডাটা অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র হলো বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় একক রফতানি গন্তব্য।২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশ ৭০০ কোটি ডলারের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত উপভোগ করেছে।    অন্যদিকে দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় ১৭ কোটি মানুষের এ দেশটির চীনের সঙ্গে রয়েছে জটিল বাণিজ্যিক ঘাটতি। ২০১৯ সালে এর পরিমাণ ছিল ১২০০ কোটি ডলার। চীন হলো বাংলাদেশের আমদানির সবচেয়ে বড় উৎস।

যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত ছিলেন এম. হুমায়ুন কবির। তিনি বর্তমানে ঢাকার থিংক ট্যাংক বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট। তিনি বলেছেন, এই অবস্থা বাংলাদেশকে একটি জটিল অবস্থানে ফেলেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীন উভয় দেশেরই বন্ধু বাংলাদেশ। ফলে বাংলাদেশের পক্ষে (এমন আহ্বানে) সাড়া দেয়া হবে জটিল বিষয়।

ইত্তেফাক/এআর