বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

হঠাৎ আগুনের প্রকোপ নাশকতা, না দুর্ঘটনা

আপডেট : ২৭ নভেম্বর ২০২০, ০৬:৪০

হঠাৎ করেই আগুনের প্রকোপ বেড়ে গেছে। গত ১০ দিনের মধ্যে দুই বিদ্যুৎকন্দ্রের পাশাপাশি রাজধানীর তিনটি বস্তিতে আগুন লাগে। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, এই আগুনগুলো কী নিছক দুর্ঘটনা না কি, নাশকতা? 

নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, বস্তির অগ্নিদুর্ঘটনাগুলো স্বাভাবিক আগুন না। অনেক সময়ই হাতবদলের জন্য বস্তিতে আগুন লাগানো হয়। পাশাপাশি বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকেও মাঝেমধ্যে আগুন লাগে। সবগুলো আগুনের ঘটনায় তদন্ত চলছে। ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও তদন্ত শুরু করেছে।

সর্বশেষ গত ১৭ নভেম্বর সকালে সিলেটের কুমারগাঁও বিদ্যুত্ উপকেন্দ্রে আগুন লাগে। অন্ধকারে থাকে সিলেট, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ জেলা। এর আগে গত আট মাসে দেশে অন্তত চারটি উপকেন্দ্রে অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটেছে। এর ফলে বহুমুখী ভোগান্তিতে পড়েন স্থানীয় জনগণ।

রক্ষণাবেক্ষণে দুর্বলতা, দায়িত্বে অবহেলা, আর্থিক দুর্নীতি এবং ট্রান্সফরমারসহ উপকেন্দ্রের অন্যান্য কেনাকাটায় সঠিক মান বজায় না রাখা- এ দুর্ঘটনার কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এর আগে গত ৮ ও ১০ সেপ্টেম্বর দুই দফায় ময়মনসিংহ শহরের কেওয়াটখালী বিদ্যুত্ উপকেন্দ্রে আগুন লাগে।

পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ-পিজিসিবির ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইয়াকুব ইলাহী চৌধুরী জানান, কারিগরি ত্রুটি-দুর্বলতার কারণে এ অগ্নিদুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে। একে তো পুরোনো সাবস্টেশন, তার ওপর সময়মত রক্ষণাবেক্ষণের অভাব রয়েছে। তারপরও বিষয়টির তদন্ত চলছে।

এদিকে গত সোমবার রাত থেকে মঙ্গলবার সন্ধ্যার মধ্যে রাজধানীর তিনটি বস্তিতে আগুন লাগে। বস্তির এই আগুনগুলো নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অধিকাংশ বস্তি কোনো না কোনো সংস্থার জমিতে। নানাভাবে ঐ সংস্থাগুলো জমি উদ্ধার করতে না পারলেও অনেক সময় ভিন্ন পথে জমি উদ্ধারের চেষ্টা করে। এছাড়া মালিকানা হাতবদলের জন্যও নব্য প্রভাবশালী গ্রুপও অনেক সময় আগুন ধরিয়ে বস্তি নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা করে।

বস্তিতে কেন বারবার আগুন লাগে, জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সাবেক মহাপরিচালক ব্রি. জে (অব.) আবু নাঈম মো. শহীদুল্লাহ বলেন, নানা কারণেই বস্তিতে আগুন লাগে। এর আগে তদন্তে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট ও গ্যাসের পাইপের লিক থেকে আগুনের কারণ উঠে এসেছে। তবে দুই পক্ষের শত্রুতা ও দখল-পুনর্দখলের বিষয়টিকেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডের পরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটিতে ১৭ দফা সুপারিশ করা হলো। এরপর চুড়িহাট্টার ঘটনায় ৩১ দফা সুপারিশ করা হলো। এফ আর টাওয়ারের পরপরই দেখলাম সিটি করপোরেশনের অনেক মুভমেন্ট হলো। আইনের অভাব নেই, কিন্তু আইনের ব্যবহার নাই। এই কারণে এগুলো থামানো যাচ্ছে না।’

বস্তিবাসী বলছেন, আধিপত্য বিস্তার ও স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দখলদারিত্বের কারণেই একের পর এক বস্তিতে আগুন লাগানো হচ্ছে। আগুনে পুড়ে গত কয়েক বছরে পুড়েছে অনেকের ঘর, নিভেছে অনেক জীবনপ্রদীপ।

জানা গেছে, বস্তিতে নিয়মিত বিরতিতে এভাবে অগ্নিকাণ্ড ঘটলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মামলা হয় না। হতাহত হলেই কেবল মামলা হয়, তা-ও অপমৃত্যুর। এরপরও আবার তদন্ত হয় না। এখন পর্যন্ত যত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, তাতে দফায় দফায় তদন্ত কমিটি হয়েছে, ভারী হয়েছে সুপারিশের তালিকা। তবে দুর্ঘটনা প্রতিরোধে এসব সুপারিশ রয়ে গেছে কাগজপত্রেই। গত পাঁচ বছরে দেশের বস্তিগুলোয় ১ হাজার ২০০টির বেশি অগ্নিকাণ্ড ঘটলেও একটিরও অভিযোগপত্র দাখিল করেনি পুলিশ। স্বাভাবিকভাবেই এসব অগ্নিকাণ্ডে কাউকে দায়ীও করা যায়নি।

বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ২০১০ থেকে ২০১৮ সালের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সর্বোচ্চ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে রাজধানী ঢাকায়। এ ছাড়া সারা দেশে ছোটবড় ১৬ হাজার অগ্নিদুর্ঘটনায় মারা গেছেন ১ হাজার ৫৯০ জন। এতে ৪ হাজার কোটি টাকার ওপর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। শুধু গত বছরই রাজধানীসহ সারা দেশে অন্তত ৩২টি বস্তিতে আগুনের ঘটনা ঘটেছে। এসব আগুনে শিশু-নারীসহ মারা গেছেন অন্তত ২০ জন।

ইত্তেফাক/জেডএইচ