শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

বড়রাই পেল প্রণোদনার টাকা

আপডেট : ১৩ জানুয়ারি ২০২১, ০৭:৩৭

করোনা ভাইরাসের ভয়াল থাবায় স্থবির হয়ে যাওয়া অর্থনৈতিক অবস্থা থেকে উত্তরণে সরকার যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে তার প্রায় পুরোটাই পেয়েছে বড় বড় কোম্পানি। সাধারণ উদ্যোক্তারা প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণ পেলে তাতে দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা হতো। আর সেটাই ছিল প্রণোদনার মূল উদ্দেশ্য। এই পরিস্থিতিতে প্রণোদনার মূল উদ্দেশ্য পূরণ হয়নি বলে সংশ্লিষ্টরা মত দিয়েছেন।

তথ্য মতে, প্রণোদনা প্যাকেজে ঋণের মধ্যে সবচয়ে বেশি টাকা ঘোষণা করা হয়েছে শিল্প ও সেবা খাতে। প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণে সুদের মধ্যে সরকার অর্ধেক ভর্তুকি দিচ্ছে। অর্থাত্ এ ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশের মধ্যে গ্রাহককে দিতে হবে সাড়ে ৪ শতাংশ। কম সুদের এ ঋণ নেওয়ার জন্য দেশের প্রভাবশালী গ্রুপগুলো খুবই সক্রিয়। তারা ইতিমধ্যেই এ খাতের প্রায় সব ঋণ সাবাড় করে দিয়েছে। ব্যাংকগুলোও মুখ দেখে দেখে তাদের ঋণ দিয়েছে। অন্যদিকে তুলনামূলক কম পরিচিত গ্রাহকরা বঞ্চিত হয়েছেন।

করোনার প্রকোপ শুরু হওয়ার পর দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব মিলিয়ে ১ লাখ ২১ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন। এর মধ্যে বড় প্যাকেজ হলো ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সেবা খাতের জন্য। প্রথমে এ খাতের ঋণের আকার ৩০ হাজার কোটি টাকা হলেও পরে বাড়িয়ে ৪০ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। এর বাইরে দেশি ও বিদেশি কোম্পানিগুলোর জন্য ৭ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা গেছে, শিল্প ও সেবা খাতের দেওয়া ঋণের এক চতুর্থাংশই নিয়ে গেছে ১৫টি কোম্পানি। এসব কোম্পানি প্রায় সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। আর ৭৫ শতাংশ ঋণ পেয়েছে প্রায় ৩ হাজার কোম্পানি। আর এসব ঋণের বেশির ভাগই গেছে চট্টগ্রাম অঞ্চলে। ঐ অঞ্চলের কোম্পানিগুলোই এ ঋণের সুবিধা পেয়েছে।

এখন পর্যন্ত যে তথ্য পাওয়া গেছে তাতে দেখা যায় গেছে যে, বেসরকারি খাতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঋণ পেয়েছে বহুল পরিচিত আবুল খায়ের গ্রুপ। তারা প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে রাষ্ট্রীয় মালিকানার সোনালী, জনতা, রূপালী ব্যাংক থেকে। এছাড়া বেশ কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে এ প্রতিষ্ঠানটি।

বেশ কয়েক বছর ধরে আলোচিত এস আলম গ্রুপ বেশি ঋণ নেওয়ার দিক থেকে বেসরকারি খাতে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে। চট্টগ্রামভিত্তিক এ গ্রুপটি নিয়েছে ৮৬৫ কোটি টাকা। ইসলামী ব্যাংকসহ বেশ কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংক, সরকারি জনতা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে এ শিল্পগ্রুপ। এ শিল্পগ্রুপের অধীনে রয়েছে বেশ কয়েকটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান।

এর বাইরে ইস্পাত খাতের বিএসআরএম ৬২০ কোটি টাকা, বসুন্ধরা গ্রুপ ৫৯৫ কোটি টাকা, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ ৫৪০ কোটি টাকা, সিটি গ্রুপ ৫০২ কোটি টাকা, কেএসআরএম ৩২৫ কোটি টাকা, জিপিএইচ ২৮৬ কোটি টাকা, এসিআই গ্রুপ ৩০৫ কোটি টাকা, নাভানা গ্রুপ ২৭৪ কোটি টাকা, জাবের অ্যান্ড জুবায়ের ২৩৪ কোটি টাকা, স্কয়ার গ্রুপ ২০১ কোটি টাকা এবং থারমেক্স গ্রুপ ১৯৭ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে।

এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যেভাবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতকেই প্রাধান্য দিয়ে উত্পাদক-ভোক্তা সবার হাতে নগদ অর্থ সরবরাহ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, এদেশে সেভাবে হয়নি। ফলে প্রণোদনা প্যাকেজ দেওয়ার মূল উদ্দেশ্য যথাযথভাবে পূরণ হয়নি।

প্রণোদনা প্যাকেজ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, এখন পর্যন্ত যেসব প্রতিষ্ঠান প্রণোদনার সুবিধা পেয়েছে তারা হলো কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠান। প্রণোদনার ক্ষেত্রে এটা কাম্য নয়। প্রণোদনা দেওয়ার ক্ষেত্রে মানদণ্ড ঠিক না থাকায় এ প্যাকেজের আসল সুবিধা মেলেনি বলেও তিনি মনে করেন।

প্রভাবশালীদের ঋণ দেওয়া বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, সরকারঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ঋণ দেওয়ার জন্য ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের কাছে আবেদন চাওয়া হয়েছে। সেসব আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঋণ পাওয়ার শর্ত পূরণ করলেই তাদেরকে ঋণ দিয়েছে ব্যাংকগুলো। এক্ষেত্রে কোন গ্রুপকে দেওয়া হবে না হবে—সে বিষয়টি খুব বেশি বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।

ভর্তুকি সুদ গ্রাহকের ওপর চাপাচ্ছে কিছু ব্যাংক

প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় দেওয়া ঋণে গ্রাহকদের সুদে ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার। তবে কিছু ব্যাংক তা গ্রাহকের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। সুদসহ পুরো টাকা পরিশোধের জন্য গ্রাহকদের সময় বেঁধে দিচ্ছে। এ কারণে ভর্তুকি সুদকে আলাদা হিসাবে সংরক্ষণের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গতকাল মঙ্গলবার এ নিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে দেশের সব ব্যাংকের কাছে পাঠানো হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, কিছু ব্যাংক আলোচ্য প্যাকেজের আওতায় দেওয়া ঋণের বিপরীতে নির্ধারিত সুদ গ্রাহকের ঋণের বিপরীতে আরোপ করছে। ফলে গ্রাহক আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। ব্যাংক পর্যায়ে একই হিসাবায়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এবং অতিরিক্ত সুদ আরোপের ফলে গ্রাহক যাতে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে জন্য নতুন সুদ আরোপের ক্ষেত্রে নতুন নির্দেশনা মানতে হবে।

নতুন নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ঋণের ওপর আরোপযোগ্য নির্ধারিত সুদের মধ্যে গ্রাহক কর্তৃক প্রদেয় অংশ গ্রাহকের ঋণ হিসাবের বিপরীতে আরোপ করা যাবে এবং অবশিষ্ট অংশ পৃথক হিসেবে সংরক্ষণ করতে হবে। তবে ঋণগ্রহীতা কর্তৃক প্রদেয় সুদ যথাসময়ে পরিশোধিত না হলে ব্যাংক সমুদয় সুদ গ্রাহকের ঋণ হিসেবের বিপরীতে আরোপ করতে পারবে এবং তা গ্রাহকের দায় হিসেবে বিবেচিত হবে।

ব্যাংকাররা বলছেন, অনেক ব্যাংক ৯ শতাংশ সুদ ধরে গ্রাহকের ঋণ পরিশোধের সময় বেঁধে দিয়েছে। নতুন নির্দেশনার ফলে সাড়ে ৪ শতাংশ সুদ ধরে ঋণ পরিশোধের সময় দিতে হবে। এতে কমে আসবে ঋণের পরিমাণ ও মাসিক কিস্তি, যা গ্রাহকদের স্বস্তি দেবে।

ইত্তেফাক/এএএম